ভাস্কর্যে মগ্ন এসএনইউ-এর ছাত্রী
একতলায় সিঁড়ির রেলিংটা যেখান থেকে শুরু হচ্ছে, যেখানে আগে পল্টুদার দোকানটা ছিল, সেই গোল হাতলে হাত রেখে একরকম প্রতিজ্ঞাই করেছিলাম। প'ড়বোই একদিন এই কলেজে!
তা সেই স্বপ্ন সত্যি করতে, চার বার ভর্তির পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল। শেষবার তালিকায় সবার প্রথমে নামটা দেখে, বাইরে এসে চারটে সিঁড়ি টপকে একটা লাফ দিয়েছিলাম! ছেলেমানুষী আর কাকে বলে...
ওয়েস্টার্ন পেইন্টিং-এর ঐ কুড়িটা সিট্-এর জন্য সেই ’৯৪ সালের ডিসেম্বরে কম করে শ’তিনেক ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল। তখন এ’রকমই হত। এখনকার খবর সঠিক জানি না...
তবে জ্ঞানীগুণীরা যাই বলুন, কিছুদিন আগে পর্যন্তও পশ্চিমবঙ্গের বেশীর ভাগ শিল্প-শিক্ষার্থীর প্রথম লক্ষ্য থাকতো এই বিশেষ কলেজে ভর্তি হওয়া। অবশ্য কোনও কারণে সুযোগ না পেলে, তাদের অনেকেই পরবর্তীকালে অন্যরকম কথা বলতেন। সে যাই হোক...
পরিস্থিতি আজ অনেকটাই অন্যরকম। বহু নতুন নতুন শিল্প-শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে গত দেড়-দশকে। আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
এখন প্রশ্ন হল, এই উন্মাদনা বা আবেগ কেন? ছবি আঁকতে গেলে কি আর্ট কলেজে প'ড়তেই হয়! আমাদের অতীত আর বর্তমান তো সে কথা বলে না! প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পের ইতিহাস আর কতদিনের! তার আগে বা তার সমসাময়িক কালেও তো বিশুদ্ধ শিল্পের চর্চা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের গন্ডির বাইরে - সবসময়! এমন কি আজও...
তবে?
আসলে, কথাটা একটু সহজ করে বুঝে নেওয়া দরকার বলে মনে হয়।
আমরা জানি যে, যারা খালি চোখে ভাল দেখতে পান না, তাদের চশমা পরার প্রয়োজন হয়। যে কোনও কারণেই হোক না কেন, আমরা যারা মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্ট শিখতে আসি, ধরে নেওয়াই যায় যে তাদেরও চশমার দরকার আছে। শিক্ষা, অর্থাৎ শিল্পশিক্ষার চশমা — হাতে-কলমেও বটে, খাতায়-কলমেও বটে — যা কিনা আমাদের দৃষ্টি আর দর্শনকে স্পষ্ট করে তুলতে সাহায্য করে।
এখন চশমা যদি পরতেই হয়, তবে তো সঠিক পাওয়ারের লেন্স করিয়ে নেওয়াই ভাল, তাই না! খামোখা জেদ করে আমরা যদি বলি, এর থেকে বেশি আমাদের দরকার নেই - তা হলে আমাদের দৃষ্টি তো অস্বচ্ছ থেকেই যায়, চশমাটাও বিশেষ কোনও কাজে লাগে না। তাই প্রতিষ্ঠানে আর্ট শিখতে এসে, আমরা শুধু তার কারিগরির দিকটাই শিখব, ইতিহাস বা দর্শন নিয়ে চর্চা করবো না, তা হয় না। কেননা, একজন শিল্প-শিক্ষার্থীর অন্তর্দৃষ্টিকে স্বচ্ছ করে তুলতে পুঁথিগত বিদ্যারও যে যথেষ্ট প্রয়োজন আছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
এ কথা সকলেই স্বীকার করবেন যে অর্ধশিক্ষার চেয়ে অশিক্ষা বহুগুণে ভাল। কিন্তু আমরা যারা আর্ট কলেজে শিক্ষালাভ করতে এসেছি, তারা তো আর অশিক্ষিত থাকতে চাই নি! তাই বোধ হয় আমাদের আর বাছবিচার করারও কোনও জায়গা নেই। অর্থাৎ পূর্ণশিক্ষার মাধ্যমে পূর্ণদৃষ্টি লাভ করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত বলেই মনে হয়। আর তাই আর্ট কলেজে যদি পড়তেই হয়, প্রতিষ্ঠানের কাছে যদি শিল্পের পাঠ নিতেই হয়, তবে তার চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সবটুকু নিঃশেষে নিয়ে নেওয়ার মধ্যেই আমাদের সার্থকতা।
তা না হলে, ঝাপসা চোখে যেটুকু দেখতে পাবো, তাকেই আমরা সত্য বলে জানব। আর যাদের দৃষ্টি স্বচ্ছ - এমনিতেই, বা সঠিক লেন্সের ব্যবহারে - দূর থেকে তারা আমাদের দুরবস্থা দেখে, মৃদু মৃদু হাসবেন শুধু।
আমরা দেখতে পাব না, জানতেও পারব না...