প্রবেশ নিষেধ। পোস্টার পড়েছে গ্রামের বাইরে। নিজস্ব চিত্র
‘‘ফেব্রুয়ারির শেষে খবর এল অজানা অসুখ হানা দিয়েছে চিনে। এ দেশেও আসতে চলেছে। বস্তির সবাই বসলাম,” বলছিলেন পুরা বুডা, হিজা বস্তির গাঁও বুড়ো। বাঁশ দিয়ে তৈরি খান পঞ্চাশেক গা ঘেঁষা বাড়ি নিয়ে এক একটি বস্তি। প্রতিটি বস্তি একটি গ্রাম। এক বস্তি থেকে অন্যটির দূরত্ব একশো মিটার। এমন খানচল্লিশ বস্তির যোগফল জ়িরো শহর। অরুণাচলপ্রদেশের দক্ষিণ সুবানসিরি জেলার প্রাণকেন্দ্র। জীবনানন্দ দাশের ঝালোকাটির ধানসিরি যেখানে ব্রহ্মপুত্রের আঁচল ছোঁয়, তার থেকে কয়েকটি খাঁড়ি দূরে মেশে সুবানসিরি নদী।
রাস্তা যদি উন্নয়নের মাপকাঠি হয়, তা হলে জ়িরো উপত্যকাকে নম্বর দেওয়ার কারণ নেই। ইটানগর থেকে চিনের সীমান্তে দাপরিজো পর্যন্ত চারশো কিলোমিটার রাস্তায় পিচ খুঁজতে মাইক্রোস্কোপ লাগে। ধুলো-পাথরে দুলতে দুলতে ১০০ কিলোমিটার যায় পাঁচ ঘণ্টায়। তবেই দেখা মেলে ‘আপাতানি’ জনজাতির। পাইন বনের মাঝে ধান ক্ষেত, শস্যগোলা আর সামাজিক সংহতির সবুজ কার্পেটে হাঁটা আপাতানিরা অরুণাচলের সমৃদ্ধির কান্ডারি।
গত সপ্তাহে সেখানেই গিয়েছিলাম করোনা-যুদ্ধের পথ খুঁজতে। সরকারি নানা বিধিনিষেধ সত্ত্বেও সংক্রমণের বাড়বাড়ন্ত যেখানে ঠেকানো যাচ্ছে না, সেখানে ভারত তো বটেই বিশ্ব জুড়েই অনেক জনজাতিগোষ্ঠী এই সংক্রমণমুক্ত। মার্চে লকডাউনের পর থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০ হাজার জনসমষ্টির এই উপত্যকায় আক্রান্ত হন মাত্র এক জন, তার পর লকডাউন সম্পূর্ণ উঠে যাওয়ার পর, মেলামেশা আগের মতোই শুরু হওয়ার পর এ যাবৎ আক্রান্ত ৩৫০। প্রাণ হারাননি এক জনও। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সাফল্যের উৎসে কী?
সত্তরোর্ধ্ব পুরার কথায়, ‘‘আপনার যাকে লকডাউন বলেন, সেটা আমাদের প্রথা। অজানা অসুখ হানা দিলে বস্তি থেকে ঢোকা-বেরোনো বন্ধ করে আত্মরক্ষা করি।” গ্রামের দেখভাল করার সরকার স্বীকৃত দায়িত্ব এই বৃদ্ধের ঘাড়ে। তাঁর কথায়, “মাস্ক পরা, দূরত্ব-বিধি মানা এ সব আপনাদের। তবে এলাকার দরজা বন্ধ করাটা আমাদের থেকে ধার করছেন।”
বয়স আটষট্টির হাগে তাকি চিকিৎসক হিসেবে এলাকাতেই জীবন কাটিয়েছেন। “ছেষট্টিতে এসেছিল গুটিবসন্ত। গা ঘেঁষা তিনটে বস্তি―হং, তাজং আর হেরুতে বহু মানুষ মারা গিয়েছিলেন। বাকি বস্তির বাসিন্দারা এই তিনটিকে বেড়া দিয়ে দেন। টিকা তো এল অনেক পরে। ওই তিন বস্তিতে দাপাদাপি করেই মাস দেড়েকের মধ্যে জ়িরো উপত্যকা ছেড়েছিল বসন্ত। সেই শিক্ষা থেকেই গ্রাম ঘেরার পথ ঠিক করেছিলেন মানুষই।”
হেরু গ্রামেরই বাসিন্দা হাগে তারুন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বলছিলেন, “সরকার আগেই সতর্ক করেছিল। কিন্তু২৩শে মার্চের আগেই প্রতিটি বস্তিতে মানুষই ঢোকা-বেরনো বন্ধ করেছেন।”
সরকারের গর্জন যা শুনতে আমরা অভ্যস্ত, না কি সংস্কৃতি-ঐতিহ্য― মৃত্যুহীন উপত্যকা গড়তে কোনটা কার্যকর? প্রশ্ন ছিল হাগে তারুনকে। “সরকারের বিধি মানুষ শুনেছেন, মিলিয়ে দেখেছেন বহু দিন ধরে বয়ে চলা নিজেদের ভাবনার সঙ্গে। বেছে নিয়েছেন ভাল থাকার পথ। অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, লোকস্বাস্থ্যের আঙিনায় সরকার মানুষকে সঙ্গে নিলে ফল ভাল হয়।”
হিজার বাসিন্দা, বছর চল্লিশের তাকু চাটুং দিল্লিতে আইন পড়েছেন। করোনা-যুদ্ধের শুরু থেকেই স্থানীয়দের নিয়ে জ়িরো উপত্যকায় কাজ করছেন তিনি। “বেড়া দেওয়া গ্রাম পাহারা দিতেন পুরুষেরা। তখন খাবার জোগাতেন স্বনির্ভরগোষ্ঠীর মহিলারা। সঙ্গে থাকত ‘ইউথ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’। গ্রামের মানুষকে বাইরে থেকে নিয়ে আসা, তাঁদের প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার কিনে তা বিনা পারিশ্রমিকে পৌঁছে দিত স্থানীয় ওই সংগঠন।”
স্বনির্ভরগোষ্ঠী মানেই আর্থিক উদ্যোগে যুক্ত পুরুষ নির্দেশিত একদল মহিলা― এই ভাবনা থেকে প্রশ্ন এল শিক্ষা বা স্বাস্থ্যে এই মহিলারা কী করবেন? জানা গেল গোষ্ঠীর প্রধান একষট্টি বছরের হাগে নানিয়ার সঙ্গে কথা বলে। ষাটোর্ধ্ব সব সদস্যই ব্যস্ত করোনা প্রতিরোধে। টিকা আসলেই সমস্যার সমাধান তো? স্কুল না পেরোনো নানিয়ার উত্তর, “কম্পিউটারে কথা বলা, টিকা, ওষুধ― এ সব দিয়ে করোনার দাপট মেটানোর চেষ্টা করার Aপাশাপাশি সরকার যদি স্থানীয়দের কথা শুনে করোনা না ছড়ানোর পথ তৈরি করে, তা হলে ভাল হবে। এখানে গুটিবসন্ত কিন্তু চলে গিয়েছিল টিকা আসার আগেই।”
শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, লোকস্বাস্থ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা সরকার জানে না, তা তো নয়। লোকস্বাস্থ্য, সামাজিক ক্ষেত্রে মহিলাদের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনাও হয়। তবে ছায়ায় ঢাকা, ভাল থাকার কাহিনি শেষে জায়গা পায় আলমারিতে।