—প্রতীকী চিত্র।
লতাপাতা আঁকা সস্তার কাপ। চায়ে চিনি গোলার মৃদু শব্দ উড়ে আসছে রান্নাঘর থেকে। হেঁশেলের টিনের চালায় ছায়া ছড়িয়ে চুপ করে আছে বাতাবি লেবুর গাছ। ঠিকানা— গদাধরপুর গ্রাম, জেলা যশোহর, বাংলাদেশ।
হাত দশেক দূরত্ব ভেঙে এনামেলের টোল খাওয়া থালায় সেই চায়ের কাপ ফিরে এল যে উঠোনে, ঠিকানা তার— গদাধরপুর, জেলা উত্তর ২৪ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
হেঁশেল আর উঠোনের মাঝে ঝিরঝিরে বৃষ্টি ঘোমটায় ঢেকে, কাদা মাখা উঠোন ভেঙে বাড়ির মধ্যেই ‘দেশ’ থেকে ‘দেশান্তরে’ চলাচল করছেন রুবিনা। উঠোনের এক কোণে সীমান্তের পুরনো পিলার ফ্যালফ্যাল করে দেখছে দেশভাগের এই অদ্ভুত বিভাজন!
পুকুর-আলপথ-ধানজমি আর দু-দেশের প্রায় আড়াইশো মানুষের অবিরাম চলাচল নিয়ে দেশভাগের অনুশাসন ভুলে দিনযাপন সীমান্তের এমনই অজস্র প্রান্তিক জনপদের। রুবিনা বিবি বলছেন, ‘‘মাঝে মাঝে বড় ভুল হয়ে যায়, বুঝতে পারি না আমরা ঠিক কোন দেশের মানুষ!’’ রুবিনার সাবেক পরিচয় ভারতীয়। তাঁর ভোট, আধার কার্ড, বাড়ির টিন ছাওয়া শোওয়ার ঘর, এক ফালি উঠোনের ঠিকানা এ রাজ্যের বাগদা মহকুমার সরকারি সিলমোহর পড়েছে। আর সাত সকালে, মেয়েদের ইস্কুলে পাঠানোর আগে মোটা চালের ভাত আর সরপুঁটির ঝোলটুকু রেঁধে আনেন যে হেঁশেল থেকে, তার ঠিকানা
‘জিলা যশোহর’।
ঘরের অন্দরেই দু’দেশের এমন লুকোচুরি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছেন কেন্দ্রীয় সমীক্ষক দলের কর্তারা। দিল্লি থেকে আসা সেই দলের কর্তা অমিত রাঠৌর অস্ফুটে বলে ফেলছেন, ‘কুছ সমঝমে নাহি আতা!’ তাঁর দিকে চায়ের কাপ আর পড়শি দেশের ‘প্রাণ’ কোম্পানির বিস্কিট এগিয়ে রুবিনা বলছেন, ‘‘সাহেব, জানেন তো আমাদের কোনও সোয়াসতিও
(স্বস্তি) নাই অসোয়াসতিও (অস্বস্তি) নাই।’’ বাঘ বা সিংহ, সরকারি সিলমোহর যে দেশেরই পড়ুক, তাঁদের উঠোন আর হেঁশেল, দাওয়া আর গোয়ালঘরের বিভাজন মোছেনি আজও। সেটুকু মানিয়ে নিয়ে স্বস্তি আর অস্বস্তির দিনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন তাঁরা।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আঁচ এ গ্রামে এসে পড়েনি ঠিকই, তবে গ্রামের ফকির আলি (যাঁর সরকারি ঠিকানায় যশোহর জেলা কর্তার সিলমোহর) বলছেন, ‘‘এগডু ভয় তো করত্যাসিলই। না জানি কী হয়!’’ বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডসের ভারী বুট ঘনঘন টহল দিয়েছে গ্রামে। তারই পাল্টা গদাধরপুরকে স্বস্তি জুগিয়ে গিয়েছে বিএসএফের অভয়বাণী, ‘ডরনে কা কৌই বাত নেহি!’
শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, অসম, ত্রিপুরা, মিজ়োরাম ও মেঘালয় জুড়ে দু’দেশের প্রায় ৪০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ভূ-সীমানার সাড়ে ছ’শো কিলোমিটার সীমান্তে এখনও কাঁটাতারের অনুশাসন পড়েনি। যার সিংহভাগই রয়ে গিয়েছে এ রাজ্যের সাতটি জেলার আনাচকানাচে। যেখানে কোথাও ধানি জমি আধাআধি ভাগ হয়ে পড়েছে দু’দেশে, কোথাও বা অদৃশ্য সীমানা আঁকা রয়েছে ঘরের উঠোন বরাবর। বাংলাদেশ জুড়ে সাম্প্রতিক তোলপাড় এবং সরকার পতনের পরে ‘বর্ডার ডিমারকেশন দফতরের’ কর্তারা রাজ্যের এমনই বহু গ্রাম ঘুরে দেখে ঠারেঠোরে জানিয়ে দিয়েছেন— এমন বেপরোয়া বিভাজনের কোনও সমাধান খোঁজা প্রায় অসম্ভব। সেই ধারণার খেই ধরে গদাধরপুরের রেজাউল মণ্ডলের পরিবারের লোকজন জানাচ্ছেন, তাঁদের ১৬ বিঘা জমির ৯ বিঘা পড়েছে ভারতের ভূমিতে, বাকি সাত বিঘা বাংলাদেশের যশোহর জেলায়। রেজাউলের চার মেয়ে, সবারই বিয়ে হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাম্তে। তবে তাঁর ছেলে রাজ্য পুলিশের কর্মী। তাঁর প্রশস্ত ভিটের অনেকটাই বাংলাদেশের মাটিতে। সেখানে হাঁসের ঘর, ধানের গোলা, খামারের জিনিসপত্র ডাঁই করে রাখা। এক পাল হাঁস রোজ সকালে চরতে বেরোয় যশোহরের পুকুরে।
(চলবে)