অসহায়: তখনও নিশ্চিত নয় বাড়ি ফেরা। বড়বাজারে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আশ্রয়ে অন্ধ্রপ্রদেশের বৃদ্ধা লক্ষ্মী আম্মা। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
সাগরমন্থনে উঠে এসেছিলেন দেবী লক্ষ্মী। সাগরস্নানে এসে বাড়ির পথ হারিয়ে ফেললেন সত্তর ছুঁইছুঁই লক্ষ্মী আম্মা। দেবী লক্ষ্মীর বিষ্ণুলোকে যেতে সমস্যা হয়নি। ঘরের রাস্তা হারিয়ে ঘোর সঙ্কটে পড়েন লক্ষ্মী আম্মা। শেষে তাঁর পাশে দাঁড়ায় বজরং। সহায় হন দেশোয়ালি জেলাশাসক।
বড়বাজারের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বজরং পরিষদকে অন্ধ্রপ্রদেশের পুলিশ বলেছিল, অলকাপল্লি স্টেশনে পুলিশ থাকবে। বৃহস্পতিবার রাতে কলকাতা থেকে ইস্ট-কোস্ট এক্সপ্রেসের মহিলা কামরায় তুলে দিলে শনিবার সকালে আনারি লক্ষ্মী আম্মাকে নামিয়ে নেবে তারাই।
যত সহজে লিখে ফেলা গেল, লক্ষ্মীদেবীর ঘরে ফেরার পথরেখা তত সহজ নয়। একে তেলুগু ছাড়া আর কোনও ভাষা জানেন না তিনি। তার উপরে একেবারে গ্রামীণ উচ্চারণ। তীর্থ করতে গঙ্গাসাগরে এসে মেলায় হারিয়ে যান। মেলা শেষে দেখা যায়, ৪০ জন বৃদ্ধবৃদ্ধা ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ঘরে ফিরে যাওয়ার রাস্তা তাঁদের জানা নেই। তাঁদের মধ্যেই ছিলেন লক্ষ্মীদেবী। নেপালের অলিক্তা ঝা তবু মৈথিলি জানতেন। মৈথিলি জানা এক হাওড়াবাসী যুবক তাঁর নাম-ঠিকানা জেনে ছবি-সহ তা পোস্ট করে দেন ফেসবুকে। সেই সূত্রে খবর পান তাঁর ছেলে। দলছুটদের অনেকে হিন্দি জানেন। লক্ষ্মীদেবী গ্রামীণ তেলুগু ছাড়া আর কিছুই জানেন না। সেই ভাষাটিও এমন উচ্চারণে বলেন যে, বোঝা দুষ্কর।
প্রায় প্রতি সাগরমেলা শেষে দেখা যায়, এক দল পথভোলা বুড়োবুড়ি পড়ে রয়েছেন মেলার মাঠে। ২০১৬ সালে সংখ্যাটা ছিল ৮৭। ২০১৭-য় হারিয়ে যান ১২২ জন। এ বছর সংখ্যাটা কমে ৪০। অভিযোগ ওঠে, অনেক ক্ষেত্রেই ছেলে-বৌয়ের হাত ধরে বৃদ্ধবৃদ্ধারা মেলায় আসার পরে ‘অজানা’ কারণে হারিয়ে যান। মেলা ছেড়ে গ্রামে ফেরার পথে সেই ছেলে-বৌয়েরা নাকি পিছন ফিরেও দেখেন না। তাঁরা ফিরে যান বাড়ি। পড়ে থাকেন অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মা।
প্রতি বছরই এই হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলিকে ঘরে ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে বড়বাজারের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বজরং পরিষদের উপরে। সংস্থার কর্তা প্রেমনাথ দুবে জানান, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষগুলিকে তাঁদের গ্রামে ফিরিয়ে দেওয়ার কাজটা সত্যিই কঠিন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষগুলি নিজের গ্রাম ছাড়া আর কোনও নাম বলতে পারেন না। যেমন লক্ষ্মীদেবী। অলিক্তাদেবীর ক্ষেত্রে যেমন হাওড়ার যুবক বিজয় ঈশ্বর, লক্ষ্মীদেবীর ক্ষেত্রে ত্রাতার ভূমিকা নেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক রত্নাকর রাও। ওই মহিলার রাজ্যেরই বাসিন্দা তিনি। ফোনে জেলাশাসকের সঙ্গে লক্ষ্মীদেবীর কথা বলার ব্যবস্থা করা হয়। সেই সূত্রেই জানা যায়, বিজয়ওয়াড়ায় বাড়ি ওই মহিলার।
রাও শুক্রবার বলেন, ‘‘আমরা একই জেলা বিশাখাপত্তনমের বাসিন্দা। যেখানে ওঁর বাড়ি, সেটা বিজয়ওয়াড়ার কাছাকাছিই হবে। বৃদ্ধা ফোনে আমায় বলেন, তিন-চার জনের সঙ্গে এসে দলছুট হয়ে পড়েন। ওঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি, বিজয়ওয়াড়া পুলিশের সঙ্গে ওঁর কথা বলিয়ে দিলে বাকিটা জানা যাবে।’’
বজরং পরিষদের কর্তা প্রেমনাথ জানান, বিজয়ওয়াড়়া থানার পুলিশ অফিসারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন লক্ষ্মীদেবী। জানা যায় অলকাপল্লির কথা। সেখানেও থানা আছে। রেল স্টেশন আছে। সেই থানার কর্মীরাও অবশ্য খুব ভাল হিন্দি জানেন না। ‘‘যিনি ফোন ধরেছিলেন, তিনি তো পশ্চিমবঙ্গেরই নাম শোনেননি। তবে কলকাতার নাম জানেন। লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে ফোনে কথা বলার পরে সেই থানার এক অফিসার জানান, মহিলা ওই এলাকারই বাসিন্দা। আমরা যদি অলকাপল্লি স্টেশন পর্যন্ত ওঁকে পৌঁছে দিতে পারি, তাঁরা নামিয়ে নেবেন,’’ বললেন প্রেমনাথ। সেই আশ্বাস অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাতেই লক্ষ্মীদেবীকে তুলে দেওয়া হয় ইস্ট-কোস্ট এক্সপ্রেসের মহিলা কামরায়।
সঙ্গে কেউ গেলে ভাল হত না?
প্রেমনাথবাবুর কথায়, ‘‘হাতে তালিকা নিয়ে বসে আছি। রাম সিয়াসন মিশ্রকে সাসারাম, গাসকুমারীকে ছত্তীসগঢ়, দুর্জন প্রসাদকে মধ্যপ্রদেশ পাঠাতে হবে। তালিকাটা দীর্ঘ। ওঁদের প্রত্যেককে দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার মতো লোকবল নেই বজরং পরিষদের।’’