হত: গুরমিত রাম রহিমকে দোষী ঘোষণার পরে হিংসার বলি। শুক্রবার হরিয়ানার পঞ্চকুলায়। ছবি: রয়টার্স।
একের পর এক ওবি ভ্যান জ্বলছে। প্রাণ হাতে করে পালাচ্ছেন সাংবাদিকরা। পালাচ্ছে পুলিশও। পাথর ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে আসছে বিক্ষোভকারীরা। সংঘর্ষে নিহতের লাশ পড়ে রইল রাস্তাতেই। পুড়ে ছাই অ্যাম্বুল্যান্স। কাশ্মীর নয়, আজ দুপুর থেকে এমনই রণক্ষেত্রের চেহারা নিল হরিয়ানার পঞ্চকুলা।
প্রায় দেড় দশক আগেকার এক জোড়া-ধর্ষণ মামলায় ধর্মীয় সংগঠন ডেরা সচ্চা সৌদার প্রধান গুরমিত রাম রহিম সিংহ দোষী সাব্যস্ত হতেই কার্যত গোটা হরিয়ানায় তাণ্ডব চালালেন তাঁর ভক্ত-অনুগামীরা। হিংসার আঁচ পড়ল লাগোয়া চার রাজ্যে। পঞ্জাব, রাজস্থানে জ্বলল স্টেশন। উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে, রাজধানী দিল্লিতে পুড়ল বাস। সব মিলিয়ে বিকেল থেকে ১০০টিরও বেশি সংঘর্ষে প্রাণ গেল অন্তত ৩১ জনের। এঁদের মধ্যে ২৮ জন নিহত হন পঞ্চকুলায়, দু’জন সিরসায়। এই সিরসাতেই ডেরা-র সদর দফতর। আহত আড়াইশোরও বেশি। কেন্দ্রের নির্দেশে সন্ধে সাড়ে সাতটারও পরে পঞ্চকুলায় যান মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর। শুধু এখান থেকেই গ্রেফতার করা হয় প্রায় ১০০০ বিক্ষোভকারীকে। সন্ধেয় ৬ কলাম সেনা নামানো হয়েছে প়ঞ্চকুলায়।
এক জন স্বঘোষিত ধর্মগুরু ধর্ষক সাব্যস্ত হওয়ার পরে তাঁর সমর্থকদের এমন লাগামছাড়া তাণ্ডব দেখে স্তম্ভিত গোটা দেশ। গুরমিত দোষী সাব্যস্ত হলে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে যেতে পারে ভেবে আগেভাগেই একটা ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে অস্থায়ী জেলের চেহারা দিয়েছিল রাজ্য সরকার। ১৭৭ কোম্পানি আধাসেনা পাঠিয়েছিল কেন্দ্র। তৈরি ছিল সেনাও। ১৪৪ ধারাকে তুড়ি মেরে গত ক’দিন থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় দেড় লক্ষ ডেরা-সমর্থক জড়ো হয়েছেন পঞ্চকুলায়। পঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্ট যা নিয়ে গত কালই বিঁধেছিল রাজ্য সরকারকে। যার পরে হরিয়ানার অ্যাডভোকেট জেনারেল বলেছিলেন, জেলার ডেপুটি কমিশনারের জারি করা ১৪৪ ধারার নির্দেশে কিছু ত্রুটি থেকে গিয়েছে।
ভিড় জমছিল চণ্ডীগড়েও। সিরসায় জমায়েত ছিল প্রায় ৫ লক্ষের। আজ সকালেও যেখানে টহল দিয়েছিল পুলিশ। সিরসা ও সংলগ্ন তিনটি গ্রামে কার্ফুও জারি ছিল। তা সত্ত্বেও কাজের কাজটা কী হল, সেই প্রশ্ন আজ উঠেছে। বিরোধীদের অভিযোগ, গত বছর জাঠ-বিক্ষোভের সময়েই বোঝা গিয়েছিল, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় দড় নন মুখ্যমন্ত্রী খট্টর। এ দিন ফের তা প্রমাণ হল।
আজ সকাল ৯টা নাগাদ চণ্ডীগড় থেকে প্রায় ২০০ গাড়ির কনভয় নিয়ে সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতে আসেন ৫০ বছরের ডেরা-প্রধান। দু’টি গাড়িকে আদালত চত্বরে ঢুকতে দেওয়া হলেও বাকিরা বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। দুপুরে রায় ঘোষণা হতেই দেখা যায়, গুরমিত-ভক্তদের অনেকেই কাঁদছেন। জ্ঞানও হারাচ্ছেন।
তার পরেই তাণ্ডব। আদালতের সামনের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলেন ডেরা-সমর্থকরা। পুলিশের সঙ্গে মারপিট শুরুর একটু পরেই দেখা যায়, রোষ পড়েছে সংবাদমাধ্যমের উপরে। পুলিশের সামনেই সাংবাদিকদের নামিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় একাধিক ওবি ভ্যানে। জলকামান, কাঁদানে-গ্যাসে কাজ না হওয়ায় শূন্যে গুলি চালায় পুলিশ। এ বার পাথর ছোড়া শুরু করেন ডেরা সমর্থকেরা। দেখা যায়, বেশ কয়েকটি মারমুখী জটলায় রয়েছেন শুধুই মহিলারা।
পিছু হটতে বাধ্য হয় পুলিশ। জখম হন একাধিক পুলিশকর্তা। তত ক্ষণে জারি হয়েছে কার্ফু। আদালত চত্বর ছাড়িয়ে হিংসা ছড়াচ্ছে সেক্টর ফাইভ-সহ বিভিন্ন শপিং মল, দোকান, বাজার, থিয়েটার হলে। শেষ পর্যন্ত গুলি চালায় পুলিশ। তাতেই অন্তত পাঁচ জন ডেরা-সমর্থকের মৃত্যু হয় বলে খবর। দ্রুতই হিংসা ছড়িয়ে পড়ে পঞ্জাবে। জ্বলতে থাকে মানসার আয়কর ভবন, বারনালা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, তিনটি রেলস্টেশন। গুরমিতের জন্মস্থান রাজস্থানের শ্রীগঙ্গানগরের স্টেশনে শুরু হয় পাথর ছোড়া। দিল্লিতে বাসের পাশাপাশি আনন্দ বিহার স্টেশনের রেল ইয়ার্ডে আগুন লাগানো হয় দু’টি কামরায়।
সন্ধ্যায় রাজ্যের কাছে রিপোর্ট চায় কেন্দ্র। আজ কিরগিজস্থান থেকে ফিরেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। পরে স্বরাষ্ট্রসচিব রাজীব মেহর্ষি বলেন, ‘‘উত্তেজনা রয়েছে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।’’ ঘটনার নিন্দা করেছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী।
১৯৯৯ সালে দুই শিষ্যাকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল গুরমিতের বিরুদ্ধে। গোপন চিঠিতে একাধিক বার সেই অভিযোগ পেয়ে ২০০২-এ সিবিআই মামলা দায়ের করে ডেরা-প্রধানের বিরুদ্ধে। সাজা ঘোষণা হবে ২৮ তারিখ। সূত্রের খবর, অন্তত ৭ বছর জেল, এমনকী যাবজ্জীবনও হতে পারে তাঁর। আজকের হাঙ্গামায় যা কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ডেরা-প্রধানের সম্পত্তি নিলাম করেই তার ক্ষতিপূরণ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। রোহতকের সুনারিয়া জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গুরমিতকে। ডেরা অবশ্য জানিয়েছে, তারা রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাচ্ছে।