সঙ্গে যাব নাকি আলাদা, উভয়সঙ্কট সিপিএমে

এগোলে বিপদ! আবার পিছোলেও সমস্যা নেহাত কম নয়! নোট-বিতর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চালে আপাতত শাঁখের করাতে সিপিএম! তৃণমূল নেত্রীর আহ্বানে সাড়া না দিলে জাতীয় রাজনীতিতে মোদী-বিরোধিতার মূল স্রোত থেকে বেরিয়ে একঘরে হয়ে পড়ার আশঙ্কা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৫
Share:

এগোলে বিপদ! আবার পিছোলেও সমস্যা নেহাত কম নয়!

Advertisement

নোট-বিতর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চালে আপাতত শাঁখের করাতে সিপিএম! তৃণমূল নেত্রীর আহ্বানে সাড়া না দিলে জাতীয় রাজনীতিতে মোদী-বিরোধিতার মূল স্রোত থেকে বেরিয়ে একঘরে হয়ে পড়ার আশঙ্কা। আবার তাঁর আমন্ত্রণ স্বীকার করে নিলে বাংলার রাজনীতিতে বিশ্বাসযোগ্যতা বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না! দুই ক্ষতির প্রভাবই ষথেষ্ট সুদূরপ্রসারী।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ৫০০ এবং এক হাজার নোট বাতিল করে আম আদমিকে দুর্দশায় ফেলেছেন এবং অর্থনৈতিক নৈরাজ্য আমদানি করেছেন বলে মমতার অভিযোগ। কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে একজোট হয়ে আন্দোলনে সিপিএমকেও সামিল হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন তিনি। খোলা আহ্বান জানানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিকে সরাসরি ফোনও করেছেন মমতা। তৃণমূল নেত্রী রবিবার তাঁকে বলেছেন, কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন হওয়া উচিত যৌথ ভাবেই। সেই কারণেই রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে বিরোধী দলগুলির প্রতিনিধিরা একসঙ্গে যাওয়াই ভাল। ইয়েচুরি তখন ছিলেন তুতিকোরিনে। মমতাকে তিনি শুধু বলেছেন, প্রতিবাদ তাঁদের দল ইতিমধ্যেই করছে। দিল্লি ফিরে তিনি বাকি যা বলার, বলবেন।

Advertisement

পরে ইয়েচুরি বলেন, ‘‘মমতা যোগাযোগ করেছিলেন। যৌথ আন্দোলন এবং রাষ্ট্রপতির কাছে সব বিরোধী দল একত্রে যাওয়ার কথা বলেছেন। আমি বলেছি, আপাতত দলের কর্মসূচিতে বাইরে আছি। দিল্লি ফিরে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথা বলব। আমাদের দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নেতৃত্বের মতও নেব। তার পরে যা বলার, বলব।’’ রাজনৈতিক শিবিরের মতে, জাতীয় ও রাজ্য রাজনীতি— এই দুই ক্ষেত্রের বাধ্যবাধকতাই মাথায় রাখতে হচ্ছে ইয়েচুরিকে। বাংলার রাজনীতির কথা ভাবলে মমতার সঙ্গে যাওয়া সিপিএমের পক্ষে অসম্ভব। আবার মমতার ডাক একেবারেই ফিরিয়ে দিলে তৃণমূল নেত্রী বলতে পারবেন, মানুষের দুর্দশার প্রশ্নে তিনি সব ছুৎমার্গ এবং অহমিকা ঝেড়ে ফেলে সিপিএমকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিপিএমই রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা থেকে বেরোতে পারল না! উভয়সঙ্কট এখানেই!

সিপিএম নেতৃত্ব অবশ্য এর মধ্যে উভয় সঙ্কট দেখতে নারাজ। তাঁদের যুক্তি, রাজনীতি চিরকালই ভারসাম্যের খেলা। এই ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতি ভবনে সব বিরোধী দলের সঙ্গে গিয়ে মানুষের হয়রানির প্রতিবাদ করা যেতেই পারে। তার আগে সংসদে কংগ্রেসের গুলাম নবি আজাদের ডাকা বৈঠকে যোগ দিতেও কোনও সমস্যা নেই এবং সেখানে তৃণমূলের থাকাও অস্বাভাবিক নয়। কারণ, বিরোধীদের মধ্যে কক্ষ সমন্বয় খুবই স্বাভাবিক সংসদীয় কৌশল। কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে আন্দোলনের ঐক্যের বার্তা দেওয়ার প্রশ্নই নেই। ইয়েচুরি-ঘনিষ্ঠ সিপিএমের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, ‘‘আমাদের বঙ্গ শাখা তো অবস্থান পরিষ্কার করেই দিয়েছে। সারদা ও নারদা-কাণ্ডের কলঙ্ক যাদের গায়ে লেগে আছে, তাদের সঙ্গে কালো টাকার প্রসঙ্গে একসঙ্গে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না!’’

বস্তুত, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিনও বাঁকুড়ায় স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘উনি (মমতা) এখন ইয়েচুরিকে ফোন করছেন! কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা আপনাকে মানায় না!” যদিও রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ বলছে, বিরোধীরা এককাট্টা হলে রাজ্যসভায় বিল পাশ করাতে এখনও সমস্যায় পড়বে বিজেপি। সুতরাং, মমতা আছেন বলেই বিরোধী জোটে থাকব না— এমন কট্টরপন্থী অবস্থান নেওয়া সিপিএমের পক্ষে সম্ভব নয়। সেই বাধ্যবাধকতার ফায়দাও মমতা নিতে চাইছেন। সিপিএমে বঙ্গ ব্রিগেডের মতোই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও মনে করছেন, ‘নাটক’ করে তৃণমূল নেত্রী আসলে বিজেপি-র উপরে চাপ বাড়াতে চাইছেন। যে ভাবে তাঁর দলের দুই সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শতাব্দী রায়কে বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থা সংক্রান্ত মামলায় ইডি নোটিস ধরিয়েছে, তার পরে মমতার সামনে এ ছা়ড়া আর পথও নেই। বহরমপুরে এ দিন অধীরবাবু বলেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কালো টাকার বিরুদ্ধে অভিযান করবেন, পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস বিশ্বাস করে না!’’ তবে এখানেও দলের হাইকম্যান্ড জাতীয় স্তরে মমতার সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলতে চাইলে প্রদেশ কংগ্রেসের কিছু করার নেই।

ঘটনাপ্রবাহের নাটকীয় মো়ড়ের সূত্রেই প্রশ্ন উঠছে, বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস-সিপিএমের ‘জোট’কে মমতা ‘নীতিহীন’ বলতেন। কংগ্রেস সিপিএমের সঙ্গে গিয়ে ভুল করেছে বলে অভিযোগ করেই মানস ভুঁইয়ার মতো নেতারা দল ছেড়ে তৃণমূলে গিয়েছেন। এখন মমতাই সিপিএমকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন দেখে তাঁদের কী মনে হচ্ছে? মানসবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী তো কোনও পঞ্চায়েত, বিধানসভা বা লোকসভা— কোনও ভোটের কথাই বলেননি। দেশের মানুষের বিপদের দিনে সকলকে প্রতিরোধে সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার মধ্যে সিপিএমও পড়ে। এতে অন্যায়ের কী আছে? আয়লা, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগেও তো এ রকমই হয়!’’

আর এ সব দেখে তৃণমূল নেত্রীকে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের কটাক্ষ, ‘‘যাঁদের বালিশের তলায় কালো টাকা লুকোনো ছিল, তাঁরাই এখন বিপদে পড়েছেন। তাঁরাই এখন সর্বস্বান্ত, প্রকৃতই সর্বহারা। সেই সব চোর এখন বাঁচার জন্য সমস্বরে চিৎকার করছে!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement