হাতে ব্যান্ডেজ করার পরে তৃণমূলের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি : এএনআই
রাগ যে কী বিষম বস্তু, তার এক ঝলক দেখা গেল মঙ্গলবার ওয়াকফ সংশোধনী বিল নিয়ে তৈরি যৌথ সংসদীয় কমিটির বৈঠকে! কমিটির সদস্য হিসাবে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার বিজেপির সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন সেখানে। ঘটনাচক্রে দু’জনেই আইনের জগতের প্রাক্তন সহকর্মী। আইনজীবী কল্যাণ কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিতের সঙ্গে বহু বার এজলাসে মুখোমুখি হয়েছেন। জড়িয়েছেন বিতণ্ডাতেও। মঙ্গলবারও দু’জনে মুখোমুখি হলেন তাঁদের বর্তমান কর্মক্ষেত্র সংসদে। দেখা গেল, সেখানেও বিতণ্ডা আটকানো গেল না। উল্টে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে উত্তেজনা এমন চরমে পৌঁছল যে, রাগের চোটে কল্যাণ কাচের বোতল সজোরে ঠুকলেন টেবিলে। বোতল ভাঙল। ভাঙা কাচের টুকরো লেগে বুড়ো আঙুল কাটল। রক্ত তো ঝরলই। পরে সেলাইও পড়ল খান ছ’য়েক। ক্ষতিই হল এক অর্থে। ক্ষতি করতে পারে এমন রাগ সামলাতে হলে কী করা উচিত?
মনোবিদ অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এমন রাগ যেখানে কেউ কিছু ভাঙছেন বা ছুড়ছেন তাকে শুধু রাগ বলা যায় না বরং তাকে খানিকটা আগ্রাসন বলা উচিত! রাগ যে কোনও মানুষেরই হতে পারে। সেটা মানুষের খুব স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু আগ্রাসন ততটা স্বাভাবিক নয়।’’ কেন স্বাভাবিক নয়? অনিন্দিতা মনস্তত্ত্বের ব্যাকরণ বুঝিয়ে বলেছেন, ‘‘আমরা বলি, রাগের বহিঃপ্রকাশ যখন আগ্রাসন হয়, তখন সেটা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। এমন নয় যে সে শুধু রাগ হিসাবেই রাগ দেখাচ্ছে। কখনও সেটা ক্ষোভ, কখনও সেটা চাপা কষ্ট, কখনও সেটা কোনও পুরনো যন্ত্রণা বা ভয়, দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা। সেই সমস্ত আবেগগুলো সে হয়তো যথাযথ ভাবে দেখাতে পারছে না বলে রাগ এবং আগ্রাসন হয়ে বেরিয়ে আসছে। তাই রাগ হলে প্রথম নিজেকে বুঝতে হবে এটা কেন হচ্ছে? রাগ সামলানোর এটাই প্রথম ধাপ।’’
সাধারণত রাগ হয় কোনও ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়। মনোবিদ জানাচ্ছেন, রাগ আর তার বহিঃপ্রকাশ হল একটা ঢেউয়ের মতো। তার একটা শুরু আছে। একটা শেষও আছে। এটা হঠাৎ হয় না। ঢেউ যেমন ধীরে ধীরে বাড়ে, এ ক্ষেত্রেও তেমন। কখনও ব্যাপারটা ৫ মিনিটে হয়, কখনও ওই ‘বড় ঢেউ’ ৩০ সেকেন্ডেই তৈরি হয়। তাই রাগ হলে দেখতে হবে এর কোনও পুরনো অনুষঙ্গ আছে কি না। বা তিনি মাঝেমধ্যেই মাথাগরম করে ফেলেন কি না। তাঁর ‘ইম্পালসিভ রিয়্যাকশন’ হয় কি না। অর্থাৎ অল্পেই উত্তেজিত হয়ে পড়েন কি না। তিনি যদি তা জানেন, তবে তাঁকে ওই ঢেউ ওঠার শুরুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাঁর উচিত হবে তখনই ওই জায়গা থেকে, অর্থাৎ যেখানে উত্তেজনার কারণ রয়েছে বলে তিনি মনে করছেন, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা।
কিন্তু যদি তেমন পরিস্থিতি না থাকে? অনিন্দিতার পরামর্শ, সে ক্ষেত্রে তিনি নিজের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে মনোযোগ দিতে পারেন। কিছু ক্ষণের জন্য। যাকে বলে ‘মাইন্ডফুল ব্রিদিং’। আর সেটা করতে করতে নিজেকেই বলতে হবে ‘শান্ত হও’। বা এক গ্লাস ঠান্ডা জল খেলেও কাজ হতে পারে।
মনোবিদ রাজশ্রী রায় আবার বলছেন, ‘‘যদি এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয় তবে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার আগে ভাল করে শুনুন উল্টো দিকের মানুষটি কী বলছেন, তার পরে একটু অপেক্ষা করুন। দরকার হলে নিজের মনে সংখ্যা গুনতে থাকুন। এই প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য হল, কিছুটা সময় নেওয়া। যাতে আপনার মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তা প্রশমিত হতে পারে। যদি এর পরও মনে হয় উত্তর দেওয়া একান্তই প্রয়োজন, তবেই দিন। কারণ যে কোনও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ভাবনা বা বোধ থাকে কম। সময় নিলে সেই বোধ ফিরে আসে। আমরা নিজেদের গুছিয়ে নিতে পারি। নিয়ন্ত্রণও করতে পারি।’’
এ ছাড়া রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও একটি উপায় বলেছেন রাজশ্রী। তিনি বলছেন, ‘‘যদি এমন রাগ মাঝেমধ্যেই হয়, তবে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকুন। যদি বোঝেন রাগ হলেই তা চিৎকার, হাতাহাতি বা ক্ষতিকর জায়গায় পৌঁছবে তবে হাতে রাখুন রাবারের বল বা ‘টেনশন ব্যান্ড’। রাগ হচ্ছে বুঝলে রাবার বলটিকেই হাতের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিন। বা ‘টেনশন ব্যান্ড’টিকে টানুন। একে বলা হয় ‘হার্ম মিনিমাইজ়িং’, অর্থাৎ ক্ষতি কমানো। রাগ হলে আমরা কাউকে মারতে পারি, তেড়ে যেতে পারি, নিজের ক্ষতি করতে পারি। সেটা যাতে না হয়, তা দেখা।’’
তবে রাগ হলে ওষুধ খেয়েও কমানো যায়। সেই ওষুধের কাজ হতে সময় লাগে ১০-১৫ মিনিট। তবে মনোবিদ অনিন্দিতা বলছেন, যদি মনে হয় এমন রাগ প্রায়শই হচ্ছে, তবে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার পথেই হাঁটা উচিত।