Air Pollution

ভাল থেকো ভোরের বাতাস

দেশের একাধিক শহরে চোখ রাঙাচ্ছে বায়ুদূষণের মাত্রা। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি দরকার জনসচেতনতাও

Advertisement

কোয়েনা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৫:৩৮
Share:

বায়ুদূষণে মুখ ঢেকেছে দিল্লির কর্তব্য পথ। খবরে চোখ রাখলেই এখন ধোঁয়াশা ঢাকা রাজপথের ছবি। কলকাতার অবস্থা ততটা খারাপ না হলেও এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বলছে সিটি অব জয়েরও সতর্ক হওয়া উচিত। এক দশক আগেও বাইপাস, যশোর রোড, বিটি রোডের দু’পাশে সবুজের সমারোহ ছিল। বিটি রোডের দু’পাশে একাধিক কলকারাখানা থাকলেও, সবুজ গাছের ব্যারিকেডে তা ঢাকা থাকত। অথচ ডানলপ পেরিয়ে বারাকপুরের দিকে এগোলে এখন আর সবুজের দেখা প্রায় মেলেই না। গত কয়েক বছরে গাছ কেটে সেখানে তৈরি হয়েছে বহুতল আবাসন, রেস্তরাঁ, শপিং কমপ্লেক্স।

Advertisement

বাতাসে বহিছে বিষ

সমীক্ষা বলছে, এ শহরে বায়ুদূষণে এগিয়ে বালিগঞ্জ, বিধাননগর, যাদবপুর ইত্যাদি অঞ্চল। বালিগঞ্জ এলাকায় কার্যত গাছ প্রায় নেই। বিধাননগর, যাদবপুরের অবস্থাও তথৈবচ। ব্যস্ত এই সব এলাকায় গাড়ি চলে বেশি, সঙ্গে দোকানপাট, আবাসনগুলিতে দেদার এসির ব্যবহার। ফলে বাতাসে বিষ বাড়ছে যার প্রভাব ব্যক্তির সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উপরে পড়ছে। পালমোনোলজিস্ট ডা. অনির্বাণ নিয়োগীর কথায়, “এর ফলে ছোট থেকে বড় সকলেরই দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক সমস্যায় ভোগা এখন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হার্টের সমস্যা, ক্যানসার, হাঁপানি, অ্যালার্জি, নিউমোনিয়া, সিওপিডি-তে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সারা বছর সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্টে ভুগছেন অনেকেই। রক্ত, ত্বক, চোখের উপরেও এর প্রভাব পড়ছে।” ক্ষতি হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যেরও।

Advertisement

যাঁহারা তোমার বিষাইছে বায়ু...

আবহাওয়ার তারতম্যে বাতাসের যে গুণগত মানের বদল হয় তার নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে নেই। কিন্তু সভ্যতা, আধুনিকতা, বিলাসিতার কারণে মানুষের হাত ধরে পরিবেশ যে সঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে তা নিয়ে জনসচেতনতা কতটুকু রয়েছে, প্রশ্ন সেখানেই। গত কয়েক দশকে গাছ কাটা, কলকারখানার ধোঁয়া থেকে হওয়া বায়ুদূষণ স্থানীয় সমস্যা ছিল, এখন সেটাই রাষ্ট্রের ভাবনার কারণ। পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত বলছেন, “শহরের বুকে বেড়ে চলা যানজট, দূষণ বিধিকে উপেক্ষা করে চালিয়ে যাওয়া নির্মাণকাজ, মাত্রাতিরিক্ত এসির ব্যবহার, রাস্তার ধারে খাবারের স্টল, বারবিকিউ-ক্যাম্পফায়ারের ধুম... বায়ুদূষণে ইন্ধন জোগাচ্ছে সবই।”

তুমি কষে ধরো হাল...

এক সময়ে বাড়ির চারপাশে আম, জাম, পেয়ারা নানা গাছ, পাড়ায় একটা মাঠ, দু’-তিনটে পুকুর সহসাই চোখে পড়ত। এ বাড়ির নারকেল যেত পাশের বাড়ির হেঁশেলে। এখন সে সব বাড়ির জায়গায় উঠছে বহুতল আবাসন। গাছপালা কেটে, জলা জমি বুজিয়ে তৈরি সেই বহুতলের নাম রাখা হচ্ছে গ্রিন সিটি। পরিবেশের কথা ভেবে সেখানেও কিছু গাছ লাগানো হচ্ছে বটে, তবে তা নেহাতই শোভা বাড়ানোর জন্য। পরিবেশ বাঁচাতে দরকার দেবদারু, বট, অশ্বত্থের মতো বড় গাছ। সঙ্গে গাছ বাঁচানোর, দত্তক নেওয়ার উদ্যোগ থাকাও জরুরি। অথচ এখনকার দু’-তিন কামরার ফ্ল্যাটে সে সব গাছ লাগানোর সুযোগ নেই। তবে চাইলে অন্দরমহল, ছাদবাগান চাইলে ইনডোর প্লান্ট, গ্রিন ওয়ালে সাজিয়ে তোলা যেতেই পারে।

ট্রেন-বাসে অফিসকাছারি যাওয়ার পথে তৈরি হত কত নতুন বন্ধু। দল বেঁধে বাসে চড়ে স্কুল যেত খুদেরা। এখন সে সব অতীত। ক্যাব কিংবা বাড়ির গাড়ি চড়ে যে যার মতো স্কুলে, কর্মক্ষেত্রে পৌঁছচ্ছে। আর এতেই বাড়ছে দূষণ। বোস ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “দূষণ কমাতে ‘অড’ ও ‘ইভেন’ নম্বর মেনে গাড়ি চালানোর ব্যবস্থাও যে পরিবেশের উন্নতিতে দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর, এমন নয়।” তবে উপায়? পরিবেশবান্ধব জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে। ব্যক্তিগত স্তরে উদ্যোগ নিতে হবে। পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ মুখোপাধ্যায়ের পরামর্শ, “ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করা যায়। সন্তানকে স্কুলবাসে যাতায়াতে অভ্যস্ত করা যায়। ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবহারও বাড়ানো যায়। এক আবাসনের বাসিন্দারা একসঙ্গে যাতায়াত করলে দূষণ যেমন কমবে, সম্পর্কও ভাল হবে।” এর সঙ্গেই নিয়মিত গাড়ির পলিউশন, অক্সিজেন সেন্সর, ধোঁয়া পরীক্ষা করাতে হবে। দরকার হলে, রাস্তায় যে গাড়ি থেকে কালো ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে হবে।

আগে পাড়ায় পুকুর, জলাজমি থাকত। সেখানে শীতের মরসুমে পরিযায়ী পাখিদের দেখা মিলত। এখন সে সব কষ্টকল্পনা। কচিকাঁচাদের চোখ এই শহরে ক’টা পাখি-ই বা খুঁজে পায়! চাইলে জলাশয় সংরক্ষণের পদক্ষেপ করা যায়। এ ক্ষেত্রে আইনের শরণাপন্ন হওয়ার উদাহরণও রয়েছে।

চাই মুক্ত বায়ু...

দূষণমুক্ত জীবন আমাদের সাংবিধানিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। তবে এ কথাও ঠিক তা আমাদের বা সরকারের একার দায়িত্বে সম্ভব না। এর জন্য দরকার দু’পক্ষের যৌথ উদ্যোগ, সচেতনতা। বাড়িতেও বর্জ্য বিশেষত রান্নাঘরের বর্জ্য জমিয়ে গাছের সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এতে জ়িরো ওয়েস্ট নীতিও মেনে চলা সম্ভব হবে। বছর কয়েক আগেও ঘরে ঘরে এত এসি, জেনারেটরের ব্যবহার ছিল না। তাতে অসুবিধেও তেমন কিছু হত না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে ফের সে পথেই যে আবার হাঁটতে হবে, সে কথাই জানান দিচ্ছে প্রকৃতি।

পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলছেন, “আগামী দিনেও যাতে শহরের বাতাসের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে থাকে, তার জন্য আগাম একাধিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সুস্থ থাকতে বরং এখন শীতকালে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স দেখে বেরোন। একিউআই যে দিন বিপজ্জনক, বাড়ির বয়স্ক ও খুদে সদস্যদের সে দিন ঘরেই রাখুন। বাইরে বেরোতে হলে মাস্ক ব্যবহার করুন।”

ডায়াবিটিস ও হাঁপানির রোগীরা সতর্ক থাকুন। ব্যক্তিগত বা সরকারি যে স্তরেই হোক, প্রয়োজন একটা ধারাবাহিক অ্যাকশন প্ল্যান। তার জন্য ছোট থেকেই সন্তানকে গাছ লাগাতে ও গাছের পরিচর্যা শেখান। জীবনযাপন ঠিক করলেই অনেকটা সুফল মিলবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement