Rare Genetic Disease

জিনঘটিত বিরল রোগের চিকিৎসা কলকাতার হাসপাতালে, ১৭ কোটি টাকা দামের ওষুধ বিনামূল্যে পেল শিশু

স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি বা এসএমএ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল এক শিশু। কলকাতার হাসপাতালে সঠিক সময়ে ডিএনএ পরীক্ষায় রোগটি ধরা পড়ার পরেই তার চিকিৎসা শুরু করে দেয় হাসপাতাল। প্রাণ বাঁচে খুদের।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪ ১২:২০
Share:

জিনঘটিত বিরল রোগ স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফির চিকিৎসা হল কলকাতার হাসপাতালে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

১৬ মাসের একটি শিশুর জিনঘটিত বিরল রোগের চিকিৎসা হল কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে। স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি বা এসএমএ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল শিশুটি। বিরল এই রোগ খুব কম জনেরই হয়। আর এর চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন জটিল, তেমনই ব্যয়সাপেক্ষ। সাধারণের নাগালের বাইরে। তাই এমন রোগ হলে বিনা চিকিৎসাতেই মৃত্যু হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের বাসিন্দা ওই শিশুটির ক্ষেত্রে তেমন হয়নি। কলকাতার হাসপাতালে সঠিক সময়ে ডিএনএ পরীক্ষায় রোগটি ধরা পড়ার পরেই তার চিকিৎসা শুরু করে দেয় হাসপাতাল। জটিল জিন থেরাপি করেন চিকিৎসকেরা। প্রাণ বাঁচে খুদের।

Advertisement

স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি এমন এক জিনগত রোগ যার ওষুধ ভারতে পাওয়া যায় না। আমেরিকার ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ এই রোগের চিকিৎসায় বিশেষ এক রকম জিন থেরাপিতে অনুমোদন দিয়েছে। সেই থেরাপি যথেষ্টই খরচসাপেক্ষ। তাতে যে ওষুধটি প্রয়োগ করা হয়, তার নাম ‘জোলগেনসমা’। এর দাম ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১৭ কোটি টাকা। আমেরিকা থেকে আমদানি করতে হয়। গত ৩১ জুলাই থেকে ওষুধটির আমদানিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে এ দেশে। ওষুধটির প্রস্তুতকারী সংস্থা, গ্লোবাল ম্যানেজড অ্যাকসেস প্রোগ্রাম (জিএমএপি)-এর মাধ্যমে বিশ্বের ৩৬টি দেশ বিনামূল্যে এই থেরাপি দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। তার জন্য লটারি হয়। সেখানে যাদের নাম নথিভুক্ত করা আছে, তাদের নিয়েই লটারি হয়। এ বার মহিষাদলের এই শিশুটির নাম লটারিতে উঠেছিল। হাসপাতালের চিকিৎসকদের উদ্যোগ ও সহযোগিতায় বিনামূল্যেই ওষুধটি পায় শিশু। আপাতত চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে তাকে।

স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি রোগটি আসলে কী?

Advertisement

পিয়ারলেস হাসপাতালের শিশুরোগ চিকিৎসক সংযুক্তা দে-র কথায়, পেশির সঞ্চালনকে নিয়ন্ত্রণ করে যে মোটর নিউরোন, তা নষ্ট হয়ে গেলে এই রোগ হয়। ‘সারভাইভ্যাল মোটর নিউরোন’ জিনই এই রোগের জন্য দায়ী। যেহেতু রোগটি জিনবাহিত, তাই বাবা-মায়ের থেকেই তা আসে শিশুর শরীরে। বাবা-মা দু’জনেই ‘সারভাইভ্যাল মোটর নিউরোন’ জিনের বাহক হলে সন্তান এসএমএ-তে আক্রান্ত হতে পারে।

এই রোগে শিশুর বুদ্ধির বিকাশ থমকে না গেলেও, শারীরিক ভাবে অচল হতে শুরু করবে। পেশির সঞ্চালন বন্ধ হতে থাকবে, স্নায়ু শুকিয়ে যেতে শুরু করবে। ফলে শিশুর ঘাড় শক্ত হবে না, হাত-পা নাড়াতে পারবে না, কারও সাহায্য ছাড়া নিজে থেকে বসতে বা দাঁড়াতে পারবে না। একটু বড় হলে সেই শিশুটি আর হাঁটাচলা করতে পারবে না। হুইলচেয়ারেই বন্দি হয়ে যাবে।

এই বিষয়ে স্নায়ুরোগ চিকিৎসক অনিমেষ কর বলছেন, “এসএমএন ১ জিনের মিউটেশন বা রাসায়নিক বদল হয়। যাদের শরীরে এই জিন থাকে, তাদের মোটর নিউরোনের কার্যক্ষমতা কমে যায়। এসএমএ প্রোটিন তৈরিই হয় না। তখন স্নায়ুতন্ত্র ও পেশির কাজ করার ক্ষমতা কমতে থাকে।” অনিমেষবাবুর কথায়, এসএমএ টাইপ ১ হলে পেশি দুর্বল হয়ে যাবে, কথা বলতে, খাবার গিলতে ও শ্বাস নিতে সমস্যা হবে। টাইপ ২-এর লক্ষণ ৬ মাস থেকে ১৮ মাস বয়সের মধ্যেই দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে শিশু নিজে থেকে বসতে পারলেও, হাঁটাচলা করতে পারবে না। টাইপ ৩ ও ৪-এর তীব্রতা কিছুটা কম। টাইপ ৩ হলে নিজে থেকেই হাঁটাচলা করতে পারবে তবে সমস্যা হবে। দৌড়তে ও সিঁড়ি ভাঙতে অসুবিধা হবে। টাইপ ৪-এর ক্ষেত্রে পায়ের পেশি খুব দুর্বল হয়ে যায়। আরও কিছু আনুষঙ্গিক সমস্যাও দেখা দেয়।

মহিষাদলের শিশুটির যখন ৬ মাস বয়স, তখন তার মা প্রথম লক্ষ্য করেন যে, শিশুটি পা নাড়াতে পারছে না নিজে থেকে। তার শরীর প্রচণ্ড নরম। স্থানীয় শিশু চিকিৎসকের কাছে গিয়েও কোনও লাভ হয়নি। রোগ চিহ্নিতই করা যায়নি। পরবর্তীতে শিশুটিকে পিয়ারলেস হাসপাতালেই রেফার করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষায় ধরা পড়ে, এসএমএ টাইপ ওয়ানে আক্রান্ত সে।

সংযুক্তা জানিয়েছেন, এসএমএ টাইপ ১ খুবই ‘সিভিয়ার’। এই রোগ হলে বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। একমাত্র জিন থেরাপিতেই এর চিকিৎসা সম্ভব। আর তা-ও দু’বছর বয়সের মধ্যেই সেই থেরাপি শুরু করতে হয়। না হলে আর ওষুধ কাজ করে না। শিশুটিকে সঠিক সময়েই ওষুধ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। এই ওষুধ এক বারই প্রয়োগ করতে হয় শরীরে। রোগ যে পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যায়, তা নয়। তবে রোগের তীব্রতা অনেক কমে যায়। এর পর নিয়ম করে কিছু খাওয়ার ওষুধ, ফিজিয়োথেরাপি ও কয়েক রকম সাপোর্টিভ থেরাপিতে থাকতে হয়। তা হলে ধীরে ধীরে পেশি সচল হতে শুরু করে।

পশ্চিমবঙ্গে এখনও পর্যন্ত তিন জন এসএমএ আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসা হয়েছে, যার মধ্যে দু’জনের পিয়ারলেসে ও এক জন এনআরএস হাসপাতালে জিন থেরাপি পেয়েছে। ক্রাউড ফান্ডিং করে টাকা জোগাড় করে যাতে এ রাজ্যেই চিকিৎসা করা যায়, তার চেষ্টাই করছেন চিকিৎসকেরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement