jamaisasthi

আজকের জলভরা তৈরি হয়েছিল জামাইকে বোকা বানাতে, জামাই ষষ্ঠী নিয়েও রয়েছে ঘটি-বাঙাল ‘লড়াই’

অন্যান্য ষষ্ঠীর মতো এই ব্রততেও উল্লেখযোগ্য হল পুজোর ডালি। আমের পল্লব দিয়ে সাজানো ঘট তো থাকেই। থাকে কাঁঠালপাতার উপর সাজানো পাঁচ, সাত বা নয় রকমের ফল। তার মধ্যে একটি হতেই হবে করমচা। আর থাকে ১০৮ গাছা দূর্বা। সেই গাছা ঘটের জলে ভিজিয়ে তালপাতার সঙ্গে ধরে বাতাস করা হয় সন্তানদের এবং অবশ্যই জামাইকেও।

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০২০ ১৫:০৮
Share:
০১ ২৬

বৈদিক শাস্ত্রে তাঁরা ব্রাত্য। কিন্তু তাঁদের স্থান সাধারণ মানুষের হৃদমাঝারে। বাংলার সেই লৌকিক দেবদেবীর অন্যতম মা ষষ্ঠী। প্রচলিত বিশ্বাস, তাঁর কৃপায় সন্তান আসে বন্ধ্যা কোলে। দেবীর কোনও নির্দিষ্ট প্রতিমা সাধারণত দেখা যায় না। বদলে, তিনি পূজিতা হন ‘ষষ্ঠীর থানে’। স্থান শব্দেরই অপভ্রংশ এই ‘থান’।

০২ ২৬

অন্য দিক দিয়ে দেখতে গেলে তিনি উর্বরতার দেবী। কিন্তু তাঁর পুজোর সঙ্গেই জড়িয়ে গেল জামাই-আদরের পরম্পরা। প্রসঙ্গত, সারা বছর আরও বেশ কিছু ষষ্ঠী তিথি পালিত হয়। কিন্তু সবথেকে জনপ্রিয় দুর্গা ষষ্ঠী এবং অরণ্য ষষ্ঠী বা জামাই ষষ্ঠী।

Advertisement
০৩ ২৬

জ্যৈষ্ঠ মাসে শুক্লা পক্ষের ষষ্ঠী তিথিকেই বেছে নেওয়া হয়েছে জামাই আপ্যায়নের জন্য। মধ্যযুগ মঙ্গলকাব্যের রচনাকাল। সে সময় থেকেই বাংলায় এই রীতির প্রচলন বলে মনে করা হয়।

০৪ ২৬

শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের দিনগুলো যাতে মসৃণ হয়, সেই ভাবনা থেকেই জামাইবরণ। তবে পাশাপাশি শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে জামাইয়ের সম্পর্ককেও সুদৃঢ় করার ইচ্ছে লুকিয়ে আছে লৌকিকতার পিছনে। জামাইকেও নিজের সন্তান বলে পরিচয় দেওয়ার মাধ্যম এই লোকাচার। সেইসঙ্গে কন্যা যাতে নিঃসন্তান না হয়, সেই প্রার্থনাও থাকে মা ষষ্ঠীর কাছে।

০৫ ২৬

ব্রতকথার বই বলছে, কোনও এক পরিবারের ছোট বউ সব খাবার খেয়ে বাড়ির কালো বিড়ালের নামে দোষ দিত। সেই বিড়াল ছিল মা ষষ্ঠীর বাহন। বাহনের নামে এই দোষারোপের জেরে ছোট বউয়ের উপর কুপিত হন মা ষষ্ঠী। তাঁর অভিশাপে ছোট বউয়ের সন্তানেরা জন্মের পর একে একে আঁতুড়ঘরেই মারা যেতে থাকে।

০৬ ২৬

শোকে পাগল হয়ে সেই গৃহিণী আশ্রয় নেন এক বনে। সেখানেই বৃদ্ধার ছদ্মবেশে তাঁকে দেখা দেন মা ষষ্ঠী। তাঁকে তুষ্ট করে আবার সন্তানদের ফিরে পান ওই বধূ। তাঁকেই নিজের ব্রত প্রচারের ভার দেন মা ষষ্ঠী। হয়তো বনে দেবীর দেখা পেয়েছিলেন বলে ব্রতর নামের সঙ্গেও জুড়ে গিয়েছে ‘অরণ্য’ শব্দটি।

০৭ ২৬

অন্যান্য ষষ্ঠীর মতো এই ব্রততেও উল্লেখযোগ্য হল পুজোর ডালি। আমের পল্লব দিয়ে সাজানো ঘট তো থাকেই। থাকে কাঁঠালপাতার উপর সাজানো পাঁচ, সাত বা নয় রকমের ফল। তার মধ্যে একটি হতেই হবে করমচা। আর থাকে ১০৮ গাছা দূর্বা। সেই গাছা ঘটের জলে ভিজিয়ে তালপাতার সঙ্গে ধরে বাতাস করা হয় সন্তানদের এবং অবশ্যই জামাইকেও।

০৮ ২৬

তার আগে সকালে ওই ডালি নিয়ে পুজো দিয়ে আসতে হয় মা ষষ্ঠীর থানে। ব্রতকথা পাঠের পরে সবাইকে ‘বাতাস’ দিয়ে, হাতে ষষ্ঠীর সুতো বেঁধে তবেই উপবাস ভঙ্গ করেন বাড়ির গৃহিণী। পাখার বাতাস দেওয়ার সময় একটি ছড়া বলতে হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রকের রমরমার দিনে অনুভূত না হলেও, ঠান্ডা জলের ছিটের সঙ্গে তালপাতার বাতাসের মনোরম মাহাত্ম্য ছিল সাবেক জ্যৈষ্ঠের ভ্যাপসা গরমে।

০৯ ২৬

ছড়াটি মূলত এ রকম, ‘ জ্যৈষ্ঠ মাসে অরণ্য ষষ্ঠী,ষাট ষাট ষাট / শ্রাবণ মাসে লোটন ষষ্ঠী,ষাট ষাট ষাট / ভাদ্র মাসে মন্থন ষষ্ঠী,ষাট ষাট ষাট / আশ্বিন মাসে দুর্গা ষষ্ঠী,ষাট ষাট ষাট / অঘ্রাণ মাসে মূলা ষষ্ঠী,ষাট ষাট ষাট / পৌষ মাসে পাটাই ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট/ মাঘ মাসে শীতল ষষ্ঠী,ষাট ষাট ষাট/ চৈত্র মাসে অশোক ষষ্ঠী,ষাট ষাট ষাট / বারো মাসে তেরো ষষ্ঠী ষাট ষাট ষাট |’

১০ ২৬

তবে ছড়াটির রূপভেদও আছে। এই ষাট হল সেই ‘বালাই ষাট’। অর্থাৎ সব বিপদ থেকে যেন রক্ষা পায় আমার সন্তান। তবে অন্যান্য রীতিনীতির মতো ষষ্ঠী পালন ঘিরেও বাঙাল-ঘটি ভেদাভেদ আছে।

১১ ২৬

ঘটি পরিবারে ষষ্ঠী পালন অনেক বেশি হয় যে কোনও বাঙাল বাড়ির তুলনায়। বছরের অন্যান্য ষষ্ঠীও পালন করেন ঘটি পরিবারের গৃহিণীরা। ষষ্ঠী উপাসনার ডালি-র নাম বাঙাল বাড়িতে মুঠা, আবার ঘটিবাড়িতে বাটা। হলুদ ও সর্ষের তেলে চোবানো সুতোকে বাঙালরা ডাকেন ‘বানা’ বলে। তবে ঘটিবাড়িতে আবার এই বানা শব্দের তত চল নেই।

১২ ২৬

ঘটিবাড়ির নিয়ম, ষষ্ঠীর উপাসকরা সেই তিথিতে উপোসভঙ্গের পরে নিরামিষ খাবেন। শুকনো আঁচে নাড়িয়ে নেওয়া চিঁড়ের উপর ঘন ক্ষীরের প্রলেপে গাছপাকা আম। চারদিক নিঃশব্দ না হলেও শোনা যায় হাপুস হুপুস শব্দ। চোখ থাকলে দেখাও যায়, লাল মেঝেতে পিঁপড়েদের কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যাওয়া।

১৩ ২৬

নিয়মকানুন এবং আদর আপ্যায়নের শ্যাম-কুল দু’দিক রক্ষা করতে বেশির ভাগ ঘটিবাড়িতে জামাইষষ্ঠীর ভোজের আয়োজন হয় অন্য দিন। তা হলে, বাড়ির গিন্নিরা, যাঁরা এই ব্রত রাখেন, তাঁরাও খেতে পারবেন সব পদ।

১৪ ২৬

বাঙালিদের অন্য যে কোনও পার্বণের মতো জামাইষষ্ঠীও ভোজন ছাড়া অসম্পূর্ণ। এখন নিয়মে অনেক পরিবর্তন এলেও আগে অনেক পরিবারেই এই অনুষ্ঠানে মাংস ভক্ষণ ছিল নিষিদ্ধ। তবে তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে মাছের। হিন্দুধর্মে মাছ হল মঙ্গলচিহ্ন। ফলে অনেক ঘটিবাড়িতে এখনও শুভকাজে মাংসের বদলে মাছেরই অগ্রাধিকার।

১৫ ২৬

কলকাতার মল্লিকবাড়িতেও জামাইষষ্ঠীর প্রীতিভোজে মাংস নেই। তার বদলে থাকে তপসে, পাকা পোনা, চিংড়ির অবাধ গতি। শেষ পাতে বা বৈকালিক আহারে সরের ক্ষীরের যোগ্য সঙ্গত দেয় আম, লিচু ও তালশাঁস।

১৬ ২৬

নিশ্ছিদ্র নজরদারি থাকে বাসনপত্রের খুঁটিনাটির দিকেও। ইটালিয়ান মার্বেলের বাসনে খাওয়ার পর পিতলের গাড়ুর জলে গামলায় মুখ ধুয়ে, রুপোর কৌটো থেকে লবঙ্গ বেঁধা পান মুখে দিয়ে তবেই জামাইয়ের ক্ষণিক রেহাই।

১৭ ২৬

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারে জামাইষষ্ঠীর ঘটা তো প্রায় কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছেছে। আদর-আপ্যায়নের পাশাপাশি জামাইদের বরণ করা হত মহার্ঘ্য উপঢৌকনে। আড়ম্বরে কম যেতেন না জামাইরাও।

১৮ ২৬

এই পরিবারের এক কর্তা ক্ষিতীশচন্দ্রের মেয়ে অন্নপূর্ণার স্বামী হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বৈঁচির রাজা। নানা মশলা দিয়ে সাজা পান ঘন ঘন মুখে না পুরলে তাঁর চলত না। তাঁর জন্য সাজা পানের খিলি গাঁথা থাকত সোনার লবঙ্গ দিয়ে। প্রত্যেক বার খাওয়ার আগে সেই সোনার লবঙ্গ তিনি ছুড়ে ফেলতেন। এদিক ওদিকে পড়ে থাকা সেই সোনার লবঙ্গ কুড়িয়ে নিত রাজবাড়ি খুদে সদস্যরা।

১৯ ২৬

এ তো গেল কুটুম্বিতার আখ্যান। কিন্তু কখনও কি বিগ্রহকে জামাইরূপে দেখা হয়েছে? শুনতে অবাক লাগলেও এই নিদর্শনও আছে নবদ্বীপে। জ্যৈষ্ঠমাসের শুক্লপক্ষে মহাপ্রভু মন্দিরে পালিত হয় জামাই ষষ্ঠী। সে দিন আর শ্রীকৃষ্ণের অবতার নন, বরং নিমাই তাঁদের জামাই।

২০ ২৬

এই মন্দিরের সেবায়েতরা বংশপরম্পায় বিষ্ণুপ্রিয়ার ভাইদের উত্তরপুরুষ। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর ধরে এই তিথিতে শ্রীচৈতন্যদেবের বিগ্রহকে তাঁরা জামাই হিসেবে আপ্যায়ন করে আসছেন। স্থানীয় প্রবীণারা মহাপ্রভুকে ষাটের বাতাস দেন। হাতে পরিয়ে দেন সুতো। বিগ্রহের পরনে নতুন পোশাকের সঙ্গে থাকে রাজসিক ভোগের আয়োজন।

২১ ২৬

রুপোর রেকাবিতে মরসুমি ফল, রুপোর বাটিতে ক্ষীর, রুপোর গ্লাসে জল দিয়ে ঘুম ভাঙানো হয় মহাপ্রভুর। তার পর থাকে চিঁড়ে, মুড়কি, দই, আম, কাঁঠাল ও মিষ্টির ফলাহার। মধ্যাহ্নভোজে নানা তরকারি, ডাল, ভাজা, থোড়, বেগুন পাতুরি, ছানার ডালনা, ধোকার ডালনা, লাউ, চালকুমড়ো এবং পোস্ত দিয়ে রাঁধা যায় এমন সব রকমের নিরামিষ পদ।

২২ ২৬

দিবানিদ্রার পরে বিকেলে নিমাইয়ের উত্থানভোগে থাকে ছানা আর মিষ্টি। রাতে শয়ানের আগে গাওয়া ঘিয়ের লুচির সঙ্গে মালপোয়া আর রাবড়ি। সবার শেষে সুগন্ধি দেওয়া খিলি পান। তবে এই মন্দিরের জামাইষষ্ঠী-ভোগের বিশেষত্ব হল আমক্ষীর।

২৩ ২৬

গাছপাকা আমের রস ক্ষীরের সঙ্গে পাক দিয়ে তৈরি হয় এই পদ। এরসঙ্গে সেবায়েত পরিবারের ঘরে তৈরি মিষ্টি ছাড়া জামাইরূপী নিমাইয়ের মিষ্টিমুখ অসম্পূর্ণ।

২৪ ২৬

জামাইষষ্ঠী পালনের রীতির হেরফের হয় জেলাভেদেও। তবে বরিশালী পরিবার এই রীতি এবং রীতির ব্যতিক্রমের বাইরে। কারণ বরিশাল জেলায় জামাইষষ্ঠীর পালনের প্রচলন নেই। ফলে বরিশালের পরিবারের মেয়ের সঙ্গে সাতপাকে বাঁধা পড়লে শাশুড়ির হাতের তালপাতার ষাট-বাতাস থেকে বঞ্চিতই থাকতে হয় জামাইদের। তবে সে দিনের ভোজনপর্বে বাধা নেই।

২৫ ২৬

তবে জামাইবাবুর সঙ্গে শ্যালক শ্যালিকার রঙ্গ রসিকতার দিনও কিন্তু এটাই। জামাইকে ঠকাতেই কোনও এক বনেদি গিন্নির ফরমায়েসে হুগলির সূর্য মোদক বানিয়েছিল জলভরা তালশাঁস। নতুন মিষ্টি দেখে আগ্রহ ভরে কামড় বসিয়েছেন জামাই। পরমুহূর্তেই তাঁর হাত, নতুন পাঞ্জাবি মাখামাখি গাঢ় রসে।

২৬ ২৬

হাল্লা আর শুন্ডির রাজার দুই জামাইয়ের মতো ভূতের বর না থাকলেও বাঙালি জামাতাদের কাছে জামাইষষ্ঠীর আপ্যায়ন পরম বিলাসের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement