ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
নীল রঙের হিজিবিজি দাগ, ওই হল জল। আর তার মাঝখানে লাল রঙের চ্যাপটা মতো জিনিসটা হল মাছ। ওইটা নাকি দেশের পতাকা। সে কী রে মনিয়া, পতাকা অমন দেখতে নাকি? তার তো তিনটে রং, মাঝে চাকা। মনিয়ার গোঁ, না আমার পতাকা ওই রকমই। ওই নীল জলটা হল আমার দেশ, আর ওই লাল মাছটা আমি। যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে পারি, কেউ আটকাতে পারবে না।
মনিয়া এ রাজ্যের একটি মানসিক হাসপাতালে বন্দিনী। এক স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে সে নিজের মনের মতো পতাকা এঁকেছিল। তাকে ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু দেশের সব, সব মেয়েকে যদি বলা হত তার ইচ্ছের দেশ, স্বপ্নের দেশের নিশান তৈরি করতে, যা দেশেরও প্রতীক আর তার নিজেরও, তবে হয়তো জল-আর-মাছ, আকাশ-আর-পাখি, এমনই ছবি ফুটে উঠত ক্যানভাসে ক্যানভাসে। যে দেশ মেয়েদের স্বাধীনতা দিয়েছে যেখানে ইচ্ছে, যেমন ইচ্ছে যাওয়ার, মেয়েদের চোখে সেই দেশই হল স্বাধীন দেশ। স্বাধীন সত্ত্বা না হলে কি স্বাধীন নাগরিক হয়? আর নাগরিক স্বাধীন না হলে দেশ স্বাধীন হয় কী করে?
কথাগুলো মনে ঠোক্কর খাচ্ছিল ক’দিন আগে, এক নারী দিবসের অনুষ্ঠানে। সরকারি অনুষ্ঠান, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সফল নেত্রীদের সম্বর্ধনা দেবে নারী ও শিশুকল্যাণ দফতর। কেউ এসেছেন মুর্শিদাবাদ থেকে, কেউ উত্তর ২৪ পরগনা, কেউ নদিয়া, বীরভূম থেকে। কারও কাজ পাটের সামগ্রী বানিয়ে বিক্রি, কারও মুরগি পালন, মাছ চাষ, কেউ শৌচাগার তৈরির বরাত পেয়েছেন। কিন্তু যে দারিদ্র, তাচ্ছিল্য, লোকনিন্দা সহ্য করে তিলে তিলে বড় করেছেন সংগঠনকে, নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন নিজে, দাঁড় করিয়েছেন আশপাশের মেয়েদের, সে গল্পে প্রায় হুবহু মিল। পরস্পর অচেনা চার মাঝবয়সী নারী এ ওকে বলে চলেছেন, ‘আরে আমাকেও তো ঘর থেকে বার করে দিয়েছিল ব্যাঙ্কের ম্যানেজার।’ ‘আমাকেও তো পার্টি নেতা বলেছিল, তোরা কী করতে পারবি দেখে নেব। আমাদেরই পায়ে ধরবি শেষে।’ কিন্তু সে সব ক্ষোভ, বিরক্তির ঝাঁঝ পেরিয়ে এসে তাঁদের উত্তেজিত কণ্ঠ ভেঙে পড়ে নিজের ঘরের উঠোনে ঢুকে। দু-চোখে জল এসে যায় সেই দিনের কথা বলতে, যে দিন প্রথম ঘর থেকে বাইরে বেরিয়েছিল ঘরের বউ, কাজ করতে। জটিল হিসেব-নিকেশ, মুরগির মড়ক, বকেয়া আদায়, বাজারের ওঠা-পড়া, ঋণ পেতে হয়রানি, কোনও কিছু এত কঠিন হয়নি এই মেয়েদের কাছে যতটা ছিল ঘর থেকে প্রথম বের হওয়ার দিনটি।
‘পাড়ার লোক কী না বলেছিল সে দিন, যে দিন প্রথম ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলাম’ বলছিলেন বীরভূমের খয়রাশোলের নাসিমা বিবি। ‘এখন তিন-চারটে গ্রামের মেয়ে আমার কাছে ট্রেনিং নেয়।’ ধান থেকে ধানের বীজ তৈরি করার ট্রেনিং নিয়ে নাসিমা এখন আশেপাশের চাষিদের চাইতে ডবল রোজগার করেন। কিন্তু প্রথম ঘর থেকে বের হওয়ার যে ট্রমা, তা আজও ভোলেননি। ঘরে-বাইরে ছিছিক্কার শুনতে হয়েছিল। এ শুধু গ্রামের গরিব গৃহবধূর সমস্যা নয়। আধা মফস্সলের একটি মেয়ে সাংবাদিকদের কর্মশালায় দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘যে মেয়েরা সাংবাদিক হতে চায়, তাদের আমার একটাই কথা বলার রয়েছে। খবর করতে বেরোবার সময়ে একা বেরোবে। অন্য কারও সঙ্গে স্পটে যেতে হলে তার সঙ্গে অন্য কোথাও দেখা করবে। সবাই দেখুক, তুমি একা বেরোচ্ছ।’ মেয়েদের ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার একটা বড় শর্ত, তার একা বেরোনোর প্রতি পরিবার, প্রতিবেশীর স্বীকৃতি আদায় করা।
আরও পড়ুন: স্বাধীনতার সে দিন, কেমন ছিল আনন্দবাজারের পাতা
আমাদের বাড়ির দোতলায় এক তরুণী কাজ করত, তার নাম ছিল বুড়ি। সেই বুড়ির মতো পাড়া-বেড়ানি মেয়ে ছিল কম। এক বার দোকান-বাজারে পাঠালে মিনিট চল্লিশের আগে সে ফিরত না মোটে। গলিতে গলিতে তার বন্ধু। স্মার্ট, চটপটে, চোখেমুখে কথা-বলা সেই মেয়ের বিয়ে হল। ক’দিন পরে তার বর এসে রেখে গেল দু’চার দিনের জন্য। বলে গেল, ‘একটু খেয়াল রাখবেন, ও তো রাস্তাঘাট চেনে না।’ তাই নিয়ে আমরা তখন হেসে গড়িয়ে পড়েছি, কিন্তু এখন বুঝি, ওই ভানটুকু না করে বুড়ির উপায় ছিল না। লক্ষ্মী বউরা রাস্তাঘাট চেনে না। এই মিষ্টি কৌতুক পরে কঠিন বিদ্রুপ হয়ে বেজেছিল, যখন আমারই যাদবপুরের এম এ ক্লাসের এক সহপাঠিনীর শাশুড়ি তাকে বলেছিল, ‘যাদবপুর ইউনিভার্সিটি খারাপ জায়গা, যেতে হলে বাবুর সঙ্গে যাবে।’
ঘরটাই যে মেয়েদের স্বাভাবিক জায়গা, বিশেষ প্রয়োজন না হলে বাইরে যাওয়া অস্বাভাবিক, কর্মরত মেয়েরাও সেই বোধটা বয়ে নিয়ে আসে অফিসে। গত দশকে মুম্বইতে একটি সমীক্ষা হয়েছিল, যেখানে দেখা হয়েছিল কী ভাবে পুরুষ ও মহিলারা অফিসপাড়ার ‘পাবলিক স্পেস’ ব্যবহার করে। তাতে দেখা গিয়েছিল, ছেলেরা চা-সিগারেট খেতে, বা অন্য কোনও কাজে বাইরে বেরোলে অনেকটা সময়ে এমনিই এ দিক-ও দিক দাঁড়িয়ে থাকে, ঘোরাঘুরি করে, যাকে বলে ‘হ্যাঙিং আউট।’ আর একটি মেয়ে যে কাজে বাইরে বেরিয়েছে, সেটা চটপট সেরে ঢুকে যায় অফিসে। এ এক রকম স্বেচ্ছা-আরোপিত সীমা, যা হয়তো মেয়েরা টেরও পায় না। ‘ওই মেয়েটি ওইখানে কী করছিল, ওই সময়ে কী করছিল,’ কিছুটা অজান্তেই তার উত্তর মেয়েরা সব সময়ে তৈরি করে রাখে। কখন কোন প্রশ্নটা ওঠে, কে জানে?
আরও পড়ুন: স্মৃতিতে স্বাধীনতা, বুকের মধ্যে দেশভাগ
এই প্রশ্নের সঙ্গে যুদ্ধ করে কখনও জেতা যায় না বলেই হয়তো বহু মেয়ে লেখাপড়া করেও আর কাজের দুনিয়ায় প্রবেশ করছে না। ভারতে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের হার মাত্র সাতাশ শতাংশ, যা বিশ্বে সর্বনিম্ন হারের অন্যতম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়েদের কাছে সংসারের প্রত্যাশার পরিমাণটা এমনই বিপুল যে তাকে অতিক্রম করে তারা কাজের জগতে প্রবেশ করতে পারছে না। অথচ সংসার-সন্তানপালনের মতো কাজ করতেও যে ঘরবন্দি হয়ে থাকা যায় না! কোথায় শিশুদের পোলিও খাওয়ানোর হার কম, তা নিয়ে সমীক্ষা করতে গিয়ে গবেষক ঝর্ণা পাণ্ডা দেখেছিলেন, যেখানে মুসলিম মেয়েদের চলাফেরায় অবরোধ, সেখানেই তা কম। যেখানে অবরোধ নেই, সেখানে মুসলিম শিশুরাও টিকা পাচ্ছে। মানে ধর্ম নয়, মায়ের গতিবিধির উপর নিয়ন্ত্রণই শিশুস্বাস্থ্যের সূচক।
পদে পদে নিষেধের ডোর বেঁধে মেয়েদের মানুষ হতে দেওয়া হচ্ছে না। বাইরের জুজুর ভয় দেখিয়ে তাদের ঘরে পুরে অর্ধ-মানুষ করে রাখা হচ্ছে। আমাদের কন্যাদের বাঁচিয়ে রেখে, লেখাপড়া শিখিয়েও লাভ সামান্যই হবে যদি তারপর ‘ঘরের বউ’ করে বন্দি রাখা হয়। স্বাধীনতার সত্তর বছর পরে দেশটাকে শুধু এটুকু মানতে হবে যে, মেয়েরা যখন খুশি, যেখানে খুশি যেতে পারে, এক্কেবারে একা। পুরুষের মতো? ধুর, পুরুষ হতে যাবে কেন? আলোর মতো, হাওয়ার মতো, মাছের মতো, পাখির মতো। নইলে এই দেশটা মেয়েদের দেশ নয়।