অলঙ্করণ: অর্ঘ্য মান্না।
ছোটবেলাটা গ্রামে কেটেছে। বেশ কয়েক পুরুষের ভিটে। কয়েকশো বছরের বাস আমাদের পরিবারের। জন্ম আমার শহরেই। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই বাবা শহরের পাট চুকিয়ে দিয়েছিলেন, পরিবার নিয়ে, মানে মাকে আর আমাকে নিয়ে, ফিরে গিয়েছিলেন গ্রামে। তখনও স্কুলে ভর্তির বয়স হয়নি আমার। বয়স যখন হল, তখন সেই গ্রামের স্কুলেই লেখাপড়া শুরু হল। প্রথমে পারিবারিক চণ্ডীমণ্ডপে সরস্বতী পুজোর দিন হাতেখড়ি। তার পর বাড়িতেই একটু বইপত্তর, স্লেট-পেন্সিল নিয়ে নাড়াচাড়া। পাঁচ বছর বয়সে গ্রামের ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে ছাত্রজীবন শুরু। উচ্চশিক্ষার জন্য পরে ফের শহরে আসতে হয়েছে। কর্মসূত্রে এখানেই ফের থিতু হতে হয়েছে। কিন্তু ফি বছর ১৫ অগস্ট এলেই সেই গ্রামের স্কুলটা স্মৃতির কোঠা থেকে বেরিয়ে আসে আজও।
হেড মাস্টারমশাই ছিলেন অভ্রেন্দু সান্যাল। প্রাইমারি স্কুলের গা দিয়ে একটা ভাঙাচোরা রাস্তা বাঁক নিয়েছে। বাঁকের উল্টো দিকে বিঘে কয়েক চাষ-জমি। তার ও পারেই অভ্রেন্দু মাস্টারমশায়ের দোতলা বাড়ি। ১৫ অগস্ট স্কুল থেকে শুরু হওয়া প্রভাত ফেরি গোটা গ্রাম ঘুরে যখন স্কুলে ফিরে আসত, তখন হেড মাস্টারমশাই একটা ছোট্ট ভাষণ দিতেন। আমরা অধীর আগ্রহে সেই ভাষণ শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতাম। কারণ হেড মাস্টারমশাইয়ের কথা শেষ হলেই বিস্কুট দেওয়া শুরু হবে। ১৫ অগস্ট প্রভাতফেরি শেষে স্কুল থেকে দু’টো করে বিস্কুট দেওয়া হত প্রত্যেক পড়ুয়ার হাতে। মাস্টারমশাই বলতেন, ‘‘আমাদের গরিব দেশ, গরিব স্কুল। তাই ছাত্রছাত্রীদের আমরা বেশি কিছু খাওয়াতে পারি না। সবাই দু’টো করে বিস্কুট পাবে। বিস্কুট নিয়ে যে যার বাড়ি ফিরে যাবে।’’ কথাগুলো আমার একেবারেই পছন্দ হত না। .
আরও পড়ুন: দেখুন স্বাধীনতার প্রথম সকালের সেই দুর্লভ মুহূর্তগুলো
স্বাধীনতা দিবসের সকাল। বন্দে মাতরম আর জয় হিন্দ বলতে বলতে, পতাকা হাতে নিয়ে সবে মিছিল করে এসেছি। দেশভক্তি বা জাতীয়তাবাদ কী, তখনও অতটা বিশদে বুঝি না ঠিকই। কিন্তু মনের মধ্যে দেশ সম্পর্কে এক অদ্ভুত গরিমার অনুভূতি টগবগ করছে তখন, দেশাত্মবোধ আর স্বাধীনতা সংগ্রামের অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে একটা গদগদ শ্রদ্ধা ফুটছে, একটা গায়ে কাঁটা দেওয়া সকাল। সেই সকালে নিজের দেশকে ‘গরিব দেশ’ বলে মেনে নিতে একদম ইচ্ছা করত না। মাস্টারমশাই যেই ভারতকে গরিব দেশ বলতেন, অমনি মনে হত গৌরবে কী যেন একটা ঘাটতি এসে গেল। আমার দেশের কোনও অক্ষমতা বা খামতি থাকতে পারে, এ কথা ভাবতেই ইচ্ছা করত না। কিন্তু প্রতি বছর বিস্কুট বিলির সময় এই কথাগুলো মাস্টারমশাই বলতেনই, বাঁধা গত আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কথা কটা শুনে মেজাজটা একটু তেতো হয়ে যেত। কিন্তু বিস্কুট দুটো হাতে নিয়েই নিমেষে সে সব ভুলে যেতাম। কারণ সেই সকালে ওই দু’টো বিস্কুটকে কেন জানি না মহামূল্যবান মনে হত। এক হাতে পতাকা অন্য হাতে দুটো মারি বিস্কুট নিয়ে মহানন্দে বাড়ির পথ ধরতাম। মনে ছটফটানি— কতক্ষণে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে দেব বিস্কুট দুটো। স্বাধীনতা দিবসের সকালে আমার ‘মহান অর্জন’ এবং সে অর্জন মায়ের হাতে তুলে না দেওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই!
দেশাত্মবোধ আর স্বাধীনতা সংগ্রামের অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে একটা গদগদ শ্রদ্ধা ফুটছে, একটা গায়ে কাঁটা দেওয়া সকাল।
মারি বিস্কুট কিন্তু কোনও কালেই আমার পছন্দের বিস্কুট নয়। কিন্তু ১৫ অগস্টের সকালে অত্যন্ত অপ্রিয় মারি হাতে পেয়েই যে কেন অত খুশি হতাম, সে ব্যাখ্যা শিশু মনস্তত্ত্বেই খুঁজতে হবে। সেই মনস্তত্ত্ব কেউ বুঝুক, না বুঝুক, মা কিন্তু অভ্রান্ত বুঝে নিতেন। সারা বছর যে বিস্কুটের দিকে তাঁর ছেলে ফিরেও তাকায় না, ১৫ অগস্টের সকালে স্কুল থেকে সেই বিস্কুটই সে অত্যন্ত যত্ন করে বাড়ি নিয়ে এসেছে দেখে মা একটুও অবাক হতেন না। অবজ্ঞাও করতেন না। আমার সে ক্ষুদ্র অর্জনকে যথাসম্ভব মর্যাদা দিয়ে, মুখে স্মিত হাসি নিয়ে মা বিস্কুট দুটোকে কৌটোয় ভরে রাখতেন। আমার অর্জন পরিপূর্ণ হত।
আরও পড়ুন: যেখানে খুশি যাইতে পারি
আমার পতাকারও একটা বিশেষত্ব ছিল। স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস বা নেতাজির জন্মদিনের আগে মুদির দোকানে আর বইখাতার দোকানে পতাকা বিক্রি হত। ১০ পয়সা করে দাম এক-একটা পতাকার। পাট কাঠি বা কঞ্চির মাথায় সেই কাগজের পতাকা আঠা দিয়ে আটকে সব স্কুলে আসত। কেউ কেউ কাপড়ের পতাকা নিয়েও আসত। আমার কাপড়ের পতাকা ছিল না। ১০ পয়সা দামের কাগজের পতাকাও আমি কিনতাম না। বড় অঙ্ক খাতার পাতা খুলে নিয়ে বাবা তাতে তেরঙা এঁকে দিতেন। প্রথমে স্কেল দিয়ে দাগ কেটে পাতাটাকে সমান তিন ভাগ করে নিতেন। উপরের ভাগটায় গেরুয়া রং করে দিতেন। মাঝেরটা সাদাই থাকত। নীচের ভাগে সবুজ রং লাগিয়ে দিতেন। সব শেষে নীল রং দিয়ে মাঝের সাদা অংশটায় অশোক চক্র এঁকে দিতেন। এটা হত ১৪ অগস্ট সন্ধ্যায়। পতাকা আঁকা হয়ে যাওয়ার পর কাগজটা বাবা শুকোতে দিতেন। সে রাতে আমাকে আর পতাকায় হাত দিতে দিতেন না। মনটা ছটফট করত, বাবা চোখের আড়াল হলেই পতাকাটা হাত দিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম, শুকলো কি না। তার পর অবধারিত ভাবে বাবার কাছে ধরা পড়তাম। পতাকা আঁকা কাগজটা বাবা আমার নাগালের বাইরে কোথাও একটা রেখে দিতেন। পর দিন সকালে পাটকাঠির মাথায় আঠা দিয়ে সেঁটে আমার হাতে ধরিয়ে দিতেন।
আরও পড়ুন: ফিরে দেখা স্বাধীনতা, আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে
পতাকা নিয়ে স্কুলের দিকে যেতে যেতে বৃষ্টি নামলে কিন্তু খুব বিপদে পড়ে যেতাম। অগস্ট মাস, বৃষ্টি হবেই। আর ১৫ অগস্ট যেন নিয়ম করে বৃষ্টি নামত সে সময়। একে কাগজের পতাকা, তায় জল রঙে আঁকা। বৃষ্টির জল পড়লে নেতিয়ে, রং গলে গিয়ে একাকার অবস্থা হত। তাই খুব সামলে-সুমলে পতাকা নিয়ে পৌঁছতে হত স্কুলে। প্রভাতফেরি শুরু হওয়ার পর বৃষ্টি নামলেও বিড়ম্বনায় পড়ে যেতাম। জলের হাত থেকে আড়াল খুঁজতাম। কারণ প্রভাতফেরি শেষ হলেই তো আর পতাকার কাজ শেষ হবে না। বাড়ি ফিরে ফের এক দফা পতপত করে ওড়াতে হবে তাকে।
ছোটখাটো খুশিগুলোই কিন্তু খুব বড় হয়ে ধরা দিত জীবনের সেই সকালটায়। আজকের ১৫ অগস্টের সঙ্গে মেলাতে পারি না আর। শহরের স্কুলগুলোয় ধুমধামেই স্বাধীনতার উদযাপন দেখি। বেশ কিছু দিন ধরে মহড়া চলে, ঝাঁ-চকচকে আয়োজন হয়, বিশেষ অনুষ্ঠান হয়, পেট পুরে খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত থাকে। কোথাও কোনও খামতি নেই, কোনও অক্ষমতার ছাপও নেই। আমার বিশ্বাস, কোনও মাস্টারমশাই এখন আর ভারতকে গরিব দেশ বলেও ডাকেন না। ভারত আর অতটা গরিব দেশ নয় এখন। কিন্তু শৈশবের সেই আবেগে যেন ধুলো জমেছে, যেন অনেকটা মলিন হয়েছে সে সময়ের তরতাজা অনুভূতিগুলো। আজ বোধ হয় আর দুটো মারি বিস্কুটকে মহান অর্জন বলে মনে হবে না। নগরজীবনে ১৫ অগস্ট একটা খুব বড় ছুটির দিন, একটা গ্র্যান্ড সেলিব্রেশনের অকেশন। আইনক্স বা পিভিআর-এ টিকিটের দাম কয়েক গুণ এই দিনটায়। কিন্তু ওই আগুন দরে টিকিট কেটে বান্ধবীকে নিয়ে মাল্টিপ্লেক্সের নরম অন্ধকারে সেঁধিয়ে যাওয়াই আজকের ১৫ অগস্ট। নৈশভোজ বাড়িতে নয়, সপরিবার ইটিং আউটই আজকের ১৫ অগস্ট।
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মনে পড়ে, সকালে পতাকাটা তুলতেই ভুলে গিয়েছিলাম!