স্বাধীনতার মানে
পায়ে পায়ে ৭৫ বছর পার। ফের আরও একটি স্বাধীনতা দিবসের উদযাপনে মেতেছি আমরা। অথচ এখনও বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে, যা কোনওভাবেই পিছু ছাড়ছে না ভারতের। ৭৫ বছর পার করে এসেও যে বিষয়গুলি বার বার প্রশ্ন তুলছে।
এই সমস্যাগুলির মধ্যে একটি সমস্যা হল পরিযায়ী শ্রমিক। পরিযায়ী শ্রমিকদের বাসস্থান ও পরিবার এক রাজ্যে, আর অন্যদিকে পেটের টানে, পরিবারকে ভাল রাখার তাগিদে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এদের কাটাতে হয় অন্য রাজ্যে। কিন্তু একটু ভাল করে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যে এঁদের ছাড়া কিন্তু মানুষের জীবন একেবারেই অচল। অথচ, এর মধ্যেও সমাজে কোনওভাবে ব্রাত্যই রয়ে গিয়েছেন তাঁরা। বিগত কয়েক বছরে এমন বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে, যে ঘটনাক্রম প্রশ্ন তুলতেই পারে যে এই সাড়ে সাত দশক পরেও স্বাধীনতার স্বাদ ঠিক কতটা পেয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকরা?
সময় যত এগোচ্ছে, সমাজে তাঁরা যেন ক্রমশ অবাঞ্ছিত হয়ে উঠেছেন। একপ্রকার অনিশ্চিত এবং অরক্ষিত অবস্থার মধ্যে ভারতের শহরগুলিতে দিনযাপন করছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা। কোভিড-১৯ অতিমারি সেই পরিস্থিতিকে আরও প্রকট এবং জটিলতর করে তুলেছে। মানুষের বদলে পরিযায়ী শ্রমিকরা এই সমাজে হয়ে উঠেছেন, এক প্রকার সস্তার কাজের লোক। স্থানীয়দের দিয়ে কাজ করালে যে পরিমাণ বেতন দিতে হয়, তার থেকে রাজ্যের বাইরে থেকে শ্রমিক আনলে অনেক কম বেতনে কাজ করা যায়। বেতনের অঙ্ক সাজিয়ে নেওয়া যায় নিজেদের মর্জি মতো। এবং গোটা বিষয়টি অবাক করার মতো হলেও, অধিকাংশ মানুষই এখনও এমনটাই করেন।
অসংগঠিত এবং অরক্ষিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে পরিযায়ী শ্রমিকেরা অত্যন্ত কম মজুরিতে এবং অত্যন্ত কঠোর পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য হন। পরিযায়ী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান আইনি চুক্তি ভিত্তিক না হওয়ার ফলে তাঁরা জীবিকা সংক্রান্ত সব রকম সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা সময়মতো প্রাপ্য মজুরি পান না। অনিয়মিত বেতনের জন্য তাঁদের নিয়োগকর্তাদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। করোনা পরিস্থিতির সময় সেই ছবিটা ছিল আরও করুন। সিএমআইই বা সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি-র একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, অতিমারির দ্বিতীয় প্রবাহের প্রথম দিকে ‘২০২১ এর এপ্রিল-মে মাসে যে ২ কোটি ২৫ লক্ষ মানুষ তাঁদের কাজ হারিয়েছেন, তার মধ্যে ১ কোটি ৭২ লক্ষ মানুষই দিনমজুর।’ এহেন পরিস্থিতিতে সরকারের তরফ থেকে নগদ টাকা সাহায্য না পাওয়ার ফলে তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটেছে। এবং বলা বাহুল্য, সেই পরিস্থিতি এখনও ঠিক হয়নি।
উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গ সরকার আগেই অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা নীতি প্রণয়ন করেছে। ২০১৭ এর আগে অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য পাঁচটি বিভিন্ন ধরনের যোজনা প্রচলিত ছিল। পরে এই সব যোজনাগুলিকে একত্রিত করে ২০১৭-তে নতুন একটি যোজনা প্রণয়ন করা হয়— ‘সামাজিক সুরক্ষা যোজনা’। এই যোজনার একটি বড় সুবিধা হল প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুবিধা। এই ক্ষেত্রে কোনও শ্রমিক প্রতি মাসে ২৫ টাকা জমা করলে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রতি মাসে ওই অ্যাকাউন্টে ৩০ টাকা জমা করবে এবং শ্রমিকের ৬০ বছর হওয়ার পরে সুদ-সহ শ্রমিক তা ফেরত পাবেন অথবা ৬০ বছরের আগে শ্রমিকের মৃত্যু হলে তাঁর পরিবারের মনোনীত সদস্য ওই অর্থ পাবেন। এছাড়াও প্রতি বছর, প্রতি শ্রমিক চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ ২০,০০০ টাকা পেতে পারেন। শ্রমিকের স্বাভাবিক মৃত্যুতে তাঁদের পরিবারকে ৫০,০০০ টাকা এবং দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এ ছাড়াও কোনও কারণে শ্রমিক কাজ করতে অসমর্থ্য হলে সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকা সহযোগিতা হিসেবে পেতে পারেন। তা ছাড়া, শ্রমিকের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্যও প্রতি বছর সর্বোচ্চ ৪ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পেতে পারে। পারত পক্ষে মনে হতেই পারে যে, এত সুযোগসুবিধা থাকলে অসংগঠিত শ্রমিকদের দুর্দশা অনেকটা ঘুচবে। কিন্তু সেখানেও আছে মস্ত ফাঁক।
এই সকল মানুষদের অর্থনৈতিক সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খাদ্য সংক্রান্ত নিরাপত্তাহীনতার দিকটিও। এই পরিযায়ী শ্রমিকদের রেশন কার্ড গ্রামে তাঁদের পরিবারের কাছে থেকে যাওয়ার ফলে যে শহরগুলিতে তাঁরা কাজ করেন, সেখানে সরকারি ভর্তুকির স্বল্পমূল্যের খাবারের যোগান থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হন।২০২০ সালে আমেদাবাদে আজীবিকা ব্যুরোর করা সমীক্ষার গ্রাউন্ড রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় অঞ্চলে বসবাসের আইনি কাগজপত্র না থাকার ফলে তাঁরা গ্যাস কানেকশন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর ফলে তাঁরা ভর্তুকিব্যতীত গ্যাস সিলিন্ডার অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন অথবা রান্নার জন্য কাঠ ব্যবহার করছেন। যেহেতু এই শ্রমিকদের নিজেদের গ্রামে অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে হয়, শহরে বেঁচে থাকার খরচ যোগাতে দেনার জালে জড়িয়ে পড়েন তাঁরা।
এছাড়াও রয়েছে বাসস্থানের সমস্যা। যেহেতু পরিযায়ী শ্রমিকেরা তাঁদের বাস্তুভিটে ছেড়ে দূরবর্তী গ্রাম, এমনকি অন্য রাজ্য থেকেও দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করে শহরগুলিতে পৌঁছন। সেখানে তাঁদের নিজেদের থাকার বন্দোবস্ত করতে হয়। এই ক্ষেত্রে অনেকে যেখানে কর্মরত সেখানেই থাকার চেষ্টা করেন। এতে বাড়ি ভাড়ার খরচ অন্তত কিছুটা হলেও বাঁচানো যায়। যে সব শ্রমিক থাকার জন্য জায়গার বন্দোবস্ত করতে পারেন না, তাঁরা সকলে ফুটপাত, স্টেশন এবং বাস ডিপোগুলিতে রাত কাটান। কারণ শহরের যে কোনও প্রান্তেই থাকার জন্য যে পরিমাণ অর্থ চাওয়া হয় তা তাঁদের কাছে আকাশসম। অনেকে আবার বাইরের রাজ্য থেকে আসা মানুষ দেখলে প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি টাকা চেয়ে বসেন। যা অসাম্যতার আরও একটি পরিচয়। আর কোনও কিছু না জুটলে দিনের শেষে খালি হাতেই ফিরে যেতে বাধ্য হতে হয় নিজের মুলুকে।
স্বাধীনতা দিবস আসে। স্বাধীনতা দিবস চলে যায়। কিন্তু বদলায় না পরিযায়ী শ্রমিকদের এই ছবিটা। এক রাশ প্রশ্ন হাওয়ায় উড়তে থাকে। কবে স্বাধীনতার সঠিক অর্থ খুঁজে পাবে তাঁরা? উত্তর ভেসে আসে — যত দিন না আর্থ-সামাজিক সুরক্ষার প্রেক্ষিতে অধিকার ভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের বহুস্তরীয় সমস্যাগুলিকে দেখা হচ্ছে, তত দিন ভারতে এই জটিল মানবিক সংকটের সমাধান সম্ভব নয়।
এই প্রতিবেদনটি সংগৃহীত এবং ‘সাধের স্বাধীনতা’ ফিচারের একটি অংশ।