Independence Day 2019

লাল রক্ত গেরুয়া হয়ে গেল

এই ত্রিধাবিভক্ত উপমহাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে খুব গর্ব করার মতো কিছু রইল কি? লিখছেন আশীষ লাহিড়ীএই ত্রিধাবিভক্ত উপমহাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে খুব গর্ব করার মতো কিছু রইল কি? লিখছেন আশীষ লাহিড়ী

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৯ ২২:১০
Share:

ক্ষমতায় বসবার জন্য যাঁরা সাজুগুজু করছিলেন তাঁদের ধারেকাছে ছিলেন না গাঁধী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত।

আমার মতো যে সব নিম্নমধ্যবিত্তর জন্ম ১৫ অগস্ট ১৯৪৭-এর ঠিক পরে, যাদের সম্পর্কে বলা হয় ‘এরা ভারতের স্বাধীনতার সমানবয়সী’, তাদের একটা সাধারণ অভিজ্ঞতা হল, বাবা-কাকা-দাদুদের, এমনকি ঠাকুরমা-দিদিমাদেরও, অনেকেই সগর্বে বলতেন, আমরা ব্রিটিশ জমানায় বড় হয়েছি, বুঝলি! তার কেতাই আলাদা। সে জমানায় এক বার কেউ বার্ড কোম্পানি কিংবা অ্যান্ড্রু ইয়ুলে কিংবা বামার লরিতে কেরানি হয়ে ঢুকলে বংশ পরম্পরায় কেরানির চাকরি করার সুযোগ পেত। মেয়েরা এমন উড়নচণ্ডী হবার সুযোগ পেত না। শিক্ষিত লোক মাত্রেই ইংরিজি জানত, তখন ‘ডিসিপ্লিন’ ছিল, বিশেষ করে ‘ছোটলোকদের’ বাড়বাড়ন্ত ছিল না। চাকরদের জুতোপেটা করলে তারা হাতেপায়ে ধরত। চাইলেই ঝি-চাকর পাওয়া যেত। আর পাওয়া যেত অসম্ভব সুস্বাদু বিস্কুট আর মাখন।

Advertisement

মেট্রোয় কিংবা নিউ এম্পায়ারে সিনেমা দেখতে যাওয়া আমাদের ছোটবেলায়, পঞ্চাশের দশকে, একটা রীতিমতো উৎসব ছিল। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ফুটপাত, ঠান্ডা মেশিনের হাওয়া, পুরু কার্পেটে ডুবে-যাওয়া গোড়ালি আমাদের বিমোহিত করত। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলে শুনতাম, এ আর কী দেখছিস, ব্রিটিশ আমলে এ সব জায়গা যা ছিল! কেউ কেউ হয়তো দীর্ঘশ্বাসও ফেলতেন। একই কথা ইডেন গার্ডেন নিয়ে। সেখানকার ব্যান্ড-এর কথা বলতে গিয়ে কারও কারও চোখে জল এসে যেত। তখন কলকাতার রাস্তাঘাট নিয়ম করে ধোয়া হত, আর, অবাক কথা, কলেজ স্ট্রিট, মির্জাপুর দিয়ে হেঁটে বেড়ানো, সে নাকি ছিল স্বর্গসুখ।

এমনও শুনতাম, পঞ্চাশটা কালো চামড়া তারস্বরে গুলতানি করছে, এমন সময় একটা লালমুখো এল, সবাই সন্ত্রস্ত। গল্প শুনতাম, যুদ্ধের সময় এক তরুণ সন্ধেবেলা এসপ্লানেডের ফুটপাত দিয়ে ছাতা দোলাতে দোলাতে আপন মনে দুলকি চালে চলছিলেন, এমন সময় পিছন থেকে ছাতার ওপর দুর্জয় এক লাথি। ছাতাটা আকাশে প্যারাবোলা এঁকে রাস্তার ওপারে গিয়ে পড়ল। গোরা সৈন্যর লাথি! ছাতা দোলানো তার পছন্দ হয়নি। প্রতিবাদ? সাহেবের বিরুদ্ধে? মাথা খারাপ নাকি? কার এত হিম্মত? অথচ ওই তরুণ কিন্তু বিষ্টু ঘোষের আখড়ায় কুস্তি শিখতেন। একটু যেন তারিফেরই সুর খুঁজে পেতাম এ সব স্মৃতিচারণে। রাজার জাত কি এমনি-এমনি?

Advertisement

ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত।

যাঁদের হাত ধরে পাওয়া এই স্বাধীনতা, তাঁদের সম্পর্কে এগুলো জানেন?

যাঁরা একটু বেশি লেখাপড়া জানতেন, তাঁরা চার্চিলের উদ্ধৃতি দিতেন: স্বাধীনতার পর ‘ক্ষমতা চলে যাবে কতকগুলো নচ্ছার চোর-ছ্যাঁচড়-জোচ্চোরের হাতে, সব ভারতীয় নেতাই হবে অত্যন্ত খেলো মানের, যাদের মেরুদণ্ড বলে কিছু নেই। তাদের মুখে মিষ্টি, হৃদয়ে তুচ্ছতা। তারা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে খেয়োখেয়ি করবে আর রাজনৈতিক কোন্দলে উচ্ছন্নে যাবে ভারত।’ বলতেন, অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে চার্চিলের ভবিষ্যদ্বাণী।

আমরা ভাবতাম, বটে! তা হলে যে ইতিহাস বইতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে এত সব কিছু লেখা থাকে? ফাঁসির মঞ্চে কিংবা গুলি খেয়ে যাঁরা জীবনের জয়গান গেয়ে গেলেন, তাঁরা কি সব ছায়ার পাখি? ক্ষুদিরাম? বাঘা যতীন? ভগৎ সিংহ? যতীন দাস? মাতঙ্গিনী হাজরা? মিথ্যে সে সব? না, তা কেন, ওগুলোও সত্যি। অসাধারণ ওঁদের তেজ, সাহস, আত্মত্যাগ। কিন্তু ওঁরা বামার লরি আর বার্ড কোম্পানি আর অ্যান্ড্রু ইয়ুলের গড়পড়তা কৃতার্থ কর্মচারীদের গণ্ডির বাইরের মানুষ। শেষোক্তরা ব্রিটিশ আমলে সুখেই ছিলেন, অন্তত সে রকমটাই তাঁরা মনে করতেন। জিনিসপত্রের দাম কম ছিল। তার ওপর ‘দেশ’ থেকে অল্প কিছু হলেও চালডাল আসত, ‘চাইনে হতে আরো বড়ো’ বলে গয়ংগচ্ছ জীবন দিব্বি চলে যেত। চাইলেই-বা তাঁদের বড় হতে দিচ্ছে কে, এ-প্রশ্নটা তাঁরা তুলতেন-ই না।

ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত।

আসলে শ্রমিকের কাজ করলেই যেমন শ্রমিকের শ্রেণিচেতনা গজায় না, সে-চেতনা বাইরে থেকে রোপণ করতে হয়, তেমনই ব্রিটিশ শাসনের অধীনে দিনযাপন করলেই, এমনকি, তাদের দ্বারা অত্যাচারিত হলেও, স্বাধীনতার বাসনা জাগে না, যত ক্ষণ না বাইরে থেকে কেউ সে-চেতনা জাগাচ্ছেন।

ছবি দেখে চিনতে পারবেন স্বাধীনতার এই কারিগরদের?

আবার প্রশ্ন জাগত: তা হলে ব্রিটিশ আমল তো ভালই ছিল, অন্তত গড়পড়তা নিম্ন-মধ্যবিত্তর জন্য। তা হলে খামোকা ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী-টাদী বলার কী দরকার?

বরং এই পূজ্যদের কথা থেকে যেটা বেরিয়ে আসত সেটা এই যে আসল কালপ্রিট হল মুসলমানরা। স্বাধীনতা আমরা, অর্থাৎ হিন্দুরা হারিয়েছিলাম আসলে ‘ওদেরই’ হাতে। ব্রিটিশরা অত্যাচারী, শোষক, সবই ঠিক; কিন্তু তারা আর যা-ই হোক, মুসলিম শাসনের বিশৃঙ্খলা থেকে তো আমাদের, মানে হিন্দুদের মুক্তি দিয়েছিল। আবার অভিমানভরে এ কথাও তাঁরা বলতেন, সেই ব্রিটিশ সরকার কিনা মুসলমানদের তোয়াজ করল! মুসলিগ লিগ শাসনে বাংলায় মুসলমানরা বেশি চাকরি পেত বলে তাঁদের খুব আফসোস দেখতাম। অতি-পাকা কোনও তার্কিক যদি যুক্তি দিত: চিত্তরঞ্জন যে বলেছিলেন, সংখ্যাগুরুত্বই যদি নির্ণায়ক ফ্যাক্টর হয়, তা হলে অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানরাই তো সংখ্যাগুরু এবং সেই সংখ্যাগুরুত্বর প্রতিফলন তো সমাজে ও রাজনীতিতে পড়াই উচিত, তার বেলা? উত্তরে শুনতে হত, ডেঁপোমি কোরো না, যা বোঝো না, তা নিয়ে তর্ক করতে এসো না। একটা কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠত: আমাদের গুরুজন-প্রজন্মর কাছে দেশটা ছিল মূলত হিন্দুদের দেশ; স্বাধীনতা হিন্দুদের স্বাধীনতা; অন্যরা সেখানে গৌণ, বহিরাগত। তারা নিশ্চয়ই থাকবে এখানে, কিন্তু সর্ববিষয়ে হিন্দুদের অগ্রাধিকার মেনে। বিশেষ করে পাকিস্তান হয়ে যাবার পর, এখন আর মুসলিম-‘তোষণ’ কেন? আলাদা করে হিন্দুদের উন্নতির জন্য কিছু করলে সেটা দেশের উন্নতি; কিন্তু আলাদা করে মুসলমানদের উন্নতির জন্য কিছু করলে সেটা মুসলিম তোষণ! এই ‘বিমোহিত চক্র’র বাইরে যাঁরা, তাঁরা সংখ্যায় নগণ্য।

ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত।

কিঞ্চিৎ লায়েক হবার পর ১৫ অগস্ট নিয়ে অদ্ভুত কতকগুলো প্রশ্ন মনে আসত। সত্যি সত্যিই যাঁরা ব্রিটিশ তাড়ানোর জন্য লড়াই করেছিলেন, তাঁরা তো ১৯৩০ সালের পর থেকে ২৬ জানুয়ারিকেই স্বাধীনতা দিবস বলে মেনে এসেছেন। সুভাষচন্দ্রর আজাদ হিন্দ সরকারও তো ওই দিনটাকেই স্বাধীনতা দিবস বলে পালন করেছিল। তা হলে ১৫ অগস্ট কেন স্বাধীনতা দিবস হল, পরে ২৬ জানুয়ারিকে কেন প্রজাতন্ত্র দিবসের সান্ত্বনা পুরস্কার দেওয়া হল? ১৫ অগস্ট তারিখটার কী বিশেষ তাৎপর্য? উত্তরটা জেনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ১৫ অগস্ট ১৯৪৭ দিনটা ঠিক করেছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ‘কারণ ওইটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে জাপানিদের আত্মসমর্পণের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির দিন।’ রামচন্দ্র গুহ তাঁর ‘গাঁধী-উত্তর ভারতবর্ষ’ বইতে এ কথা লিখে আরও জনিয়েছেন, ‘অনেকে চেয়েছিলেন ১৯৪৮ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখেই ক্ষমতা হস্তান্তর হোক, কিন্তু মাউন্টব্যাটেন নিজে এবং যাঁরা ক্ষমতার আসনে বসবার অপেক্ষায় ছিলেন তাঁরা দেরি করতে চাননি। স্বাধীন-পরাধীনে কী মধুর সমঝোতা!’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মাউন্টব্যাটেন ছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সুপ্রিম অ্যালায়েড কমান্ডার। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলে জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার সামরিক কৃতিত্বর দুর্লভ ভাগীদার তিনি (আসল কাজটা যদিও করেছিল আমেরিকানরা)। তাঁর শখ, ভারতের স্বাধীনতার দিনটি তাঁর এই ব্যক্তিগত কৃতিত্বর স্মারক হয়ে থাকুক! অবাক কাণ্ড! যাঁরা স্বাধীনতা পেলেন, তাঁরা মাউন্টব্যাটেনের এই শখ (‘ছেলেবেলাকার’?) মেটানোয় সামিল হলেন। একটু দুষ্টুমি করে রামচন্দ্র জানিয়েছেন, ১৫ অগস্ট নাকি জ্যোতিষমতে শুভ ছিল না, তাই ঠিক হয়, ১৪ অগস্ট থেকেই উৎসব অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে। একদিন বাড়তি উৎসব পাওনা হলে মন্দ কী!

ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত।

ক্ষমতায় বসবার জন্য যাঁরা সাজুগুজু করছিলেন তাঁরা কারা? গাঁধী তাদের ধারেকাছে ছিলেন না। ১৫ অগস্টকে যখন স্বাধীনতা দিবস হিসেবে নির্বাচন করা হল, গাঁধী বলেছিলেন, ওই দিনটা আমি নোয়াখালিতে কাটাব। তার আগে, অগস্টের গোড়ায় তিনি শ্রীনগর গেলেন। জম্মু-কাশ্মীর তখন রাজা হরি সিংহর খাস তালুক। কাশ্মীর কি ভারতে আসবে? না কি পাকিস্তানে যাবে? না কি স্বাধীন দেশ হিসেবে থাকবে? গাঁধীজির স্পষ্ট উত্তর: ‘সেটা কাশ্মীরিরা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী স্থির করবে।’ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। ৬ তারিখে গেলেন লাহৌর। তারপর ১১ অগস্ট এলেন দাঙ্গা-দীর্ণ কলকাতায়। সেখানকার অবস্থা দেখে বললেন, নোয়াখালি নয়, আমি থাকব কলকাতায়, যত দিন না ‘ভারতের এই সর্বগ্রগণ্য শহর তার পাগলামি ছেড়ে প্রকৃতিস্থ হচ্ছে।’ ১৩ অগস্ট থেকে রইলেন বেলেঘাটায়। ১৪ তারিখ পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ১৫ অগস্ট ১৯৪৭ কী ধরনের ধুমধাম হবে? উত্তরে গাঁধী বলেছিলেন, ‘চতুর্দিকে লোকে না খেতে পেয়ে মরছে। এই ভয়াবহ দুর্দশার মাঝখানে আপনি উৎসবের আয়োজন করতে চান?’ ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক তাঁর কাছে বাণী চাইলে জাতির জনক বললেন, ‘আমার ভাঁড়ার নিঃশেষ হয়ে গেছে।’ বিবিসি থেকে বার বার তাঁর কাছে মিনতি আসে কিছু বলবার জন্য, বার বারই তিনি ফিরিয়ে দেন। শেষে বিরক্ত হয়ে তাঁর সচিবকে বলেছিলেন, ‘ওদের বলে দাও, আমি ইংরিজি ভুলে গেছি।’

এ তো ভারী বিচিত্র স্বাধীনতা! স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যখন নিখুঁত অ্যাকসেন্টে ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’র মহলা দিচ্ছেন, তখন ‘জাতির জনক’ বলছেন, আমি ইংরিজি ভুলে গেছি। আমার বাণীর ভাণ্ডার শেষ! গাঁধীর ইচ্ছার তোয়াক্কা না-করে প্রচুর ধুমধামের মধ্য দিয়ে উদ্‌যাপিত হল ১৫ অগস্ট ১৯৪৭। দিল্লি-সহ সারা ভারত, কলকাতা সমেত, সেজে উঠল। কলকাতায় উড়ল অজস্র পতাকা। তার পরই আবার লাগল দাঙ্গা। আবার অনশনে বসলেন গাঁধীজি। রাজ্যপাল রাজাগোপালাচারি তাঁকে বললেন, কতকগুলো গুণ্ডার বিরুদ্ধে আপনি অনশনে বসছেন? উত্তরে গাঁধীর উক্তি অমর হয়ে রয়েছে, অন্তত থাকা উচিত: ‘ওদের গুণ্ডা বানাই আমরাই।’

ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত।

সবথেকে অবাক লাগে, এত বড় একটা দেশ ভাগ হয়ে গেল যেন শতরঞ্জ খেলতে খেলতে। এক দিকে সঞ্জীব কুমার, অন্য দিকে সৈয়দ জাফরি। ২৮ মে ১৯৪৭ মাউন্টব্যাটেন লন্ডনে দুটো রেডিও ভাষণ রেকর্ড করে রেখে দিলেন। পঞ্জাব আর বাংলা দুটোই যদি ভাগ হয়ে যায়, তা হলে ভাষণ ‘এ’ প্রচারিত হবে। আর যদি বাংলা ভাগ না হয়, তা হলে প্রচারিত হবে ভাষণ ‘বি’। ৩০ মে তিনি ভারতে এলেন। নেহরু আর পটেল তাঁকে জানালেন, তাঁরা বাংলাকে অবিভক্ত রাখার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছেন। সুতরাং ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন সাহেবের পূর্ব-রেকর্ডিত ভাষণ ‘এ’ সম্প্রচারিত হল। শুনে গাঁধীজি রেগে আগুন। কেউ তো তাঁকে জানায়নি যে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে ওই প্রস্তাব গৃহীত হয়ে গেছে! নেতাদের মধ্যে গাঁধীজি, খান আবদুল গফ্‌ফর খান, জয়প্রকাশ নারায়ণ আর রাম মনোহর লোহিয়া ছাড়া আর কেউ দেশভাগ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে রা কাড়েননি। কিন্তু গাঁধীজির আপস-ভরা জীবনের চরমতম আপসটি এ বার অনুষ্ঠিত হল। রাগ পড়ে এলে বললেন, যাক গে, যা হবার হয়ে গেছে, এখন বরং দেখা যাক, ব্রিটিশদের বাদ দিয়ে কী ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা সুষ্ঠু বন্দোবস্ত করা যায়। আশ্চর্য! তাঁর এতদিনকার জো-হুজুর ভক্তরা এতেও গররাজি। তারা ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়েই দেশভাগ সুসম্পন্ন করবে! ক্ষমতার সিংহাসনটা তখন চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। জাতির জনক-ফনক নিয়ে আবেগ ফলানোর সময় কোথায়? আর জাতির জনকও ধৃতরাষ্ট্রর মতো সব জেনেবুঝে পুত্রস্নেহে বিচার জলাঞ্জলি দিলেন। ফলে মাউন্টব্যাটেন তাঁর ‘সাধের ব্যাটন’ পছন্দমতো হাতেই তুলে দিলেন। চিরকালের মতো শান্তি বিদায় নিল এই উপমহাদেশ থেকে।

তার মানে, চার্চিলের শিকারসন্ধানী সাম্রাজ্যবাদী শ্যেণচক্ষু সত্যিই কিছু ভুল দেখেনি। তার প্রমাণ তাঁর আরও একটি উক্তি: ‘ব্রাহ্মণদের হাতে ভারতের শাসন ছেড়ে দিয়ে চলে আসাটা নিষ্ঠুর নির্লজ্জ অবহেলার কাজ হবে।... এইসব ব্রাহ্মণরা মুখে পাশ্চাত্য উদারনীতিবাদের বুলি আওড়ায়, ভান করে যেন এরা দর্শনঋদ্ধ গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ, কিন্তু এরাই তো বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু থেকেও বঞ্চিত করে রেখেছে প্রায় ষাট কোটি সহ-দেশবাসীকে, যাদের এরা বলে ‘অচ্ছ্যুৎ’। হাজার বছরের নিপীড়নের মধ্য দিয়ে তাদের এরা শিখিয়েছে এই দুঃসহ দশাটা মেনে নিতে।... ’ (১৯৩১) আজ ২০১৯ সালের ১৫ অগস্টে ভারতে দাঁড়িয়ে তাঁর এ কথার যাথার্থ অস্বীকার করার মতো বুকের পাটা কার আছে?

সব মিলিয়ে তা হলে হাতে পেন্সিল ছাড়া আজকের এই ত্রিধাবিভক্ত উপমহাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে খুব গর্ব করার মতো কিছু রইল কি? ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রীরা অবশ্য তাঁদের অ্যাজেন্ডা পূর্ণ করার পথে জোর কদমে অগ্রসর। লাল কেল্লা গেরুয়া হল বলে। কিন্তু বাকিরা?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement