একুশের সেরা ২১

ঋ, ণ, ঞ-র সমুদ্রযাত্রা

অভ্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০০:০৪
Share:

"ঋ, ণ ও ঞ ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে বঙ্গোপসাগরের দিকে উড়ে যাচ্ছিল। ঋ একটা হলুদ-কালো মাফলার দিয়ে গলা, মাথা, কান জোরসে পেঁচিয়ে নিয়েছে। ণ পরেছে নীল সোয়েটার। বুকে সাদা খরগোশ, খরগোশের চোখের পুঁতি মরকত লাল। ঞ অবশ্য চিরকালই লুঙ্গি পড়েছে মালকোচা মেরে। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি।

ঋ, ণ, ঞ কখনো হাত ধরাধরি করে, কখনো একে অপরকে লেঙ্গি মেরে উড়ে যাচ্ছিল বঙ্গোপসাগরের দিকে।

অনেক বছর আগে, যে বার বান এসে ভাসিয়ে দিয়েছিল শিয়ালকাঁটা গ্রামের ঘরদোর, সিন্দুক, মায় ছাগলছানাটাও, ণ-র বাবা, ঞ-র সেজো ঠাকুরদা এবং গ্রামের আর পাঁচ মুরুব্বি মিলে খিদিরপুরের ডক মার্কেট থেকে অস্ত্র কিনে এনে খাটের তলায় লুকিয়ে রেখেছিল। ঋ-রা তখনও শিয়ালকাঁটায় জুড়ে বসেনি। ঋ-র গোটা পরিবার তখনও ধান চাষেই সুখ পায়।

সে বার ণ-র বাবার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল কারা যেন! ঞ-রা সপরিবারে পালিয়ে গিয়েছিল দিনাজপুর। গ্রামের আর পাঁচ মুরুব্বি কেউ বাংলাদেশ, কেউ বিহার, কেউ বা বরাকু উপত্যকায় চলে গিয়েছিল আত্মীয়ের সন্ধানে। ভোরের অন্ধকারে পালাতে পালাতে ঞ তার প্রাইমারি স্কুলটাকে দেখতে ভোলেনি। দু’সপ্তাহ আগে পোলিং বুথ হয়ে যাওয়া স্কুলঘরগুলো এখনও খোঁয়াড়ি কাটাচ্ছে। এ দিক-ও দিক নিশান, পতাকা ঝিমিয়ে আছে গ্রীষ্মের আধিক্যে। অথচ স্কুলের মাঠটার ন্যাড়া জমির উপর সাদা চকের দাগ আশ্চর্য ভাবে টাটকা!

ঞ ভোট দেয় নি সে বার। আরও তিন বছর পর লিস্টে তার নাম উঠবে। তত দিনে সে শিয়ালকাঁটার গণ্ডি পেরিয়ে চলে এসেছে প্রায় সত্তর কিলোমিটার দক্ষিণে। তবে তার বাবা-কাকারা দিয়েছিল। তার পর সপরিবারে পালিয়েছিল কাকডাকা ভোরে। ণ-রা পালাতে পারেনি। বা হয়তো চায়নি কখনও। পর পর দু’বার কুঁড়েঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার পর ণ-র বাবা ইটের বাড়ি বানায়। তত দিনে ঋ-রাও শিয়ালকাঁটায় চলে এসেছে।

“কী বুঝছ স্যাঙাত? মাস্কটা খুলে ফেলা যায়?”

“তোমার তো সর্দিকাশির ধাত। আকাশ ধুলোয় ভরে আছে।”

“ওড়বার আগে হোমিওপ্যাথি বড়ি মেরে দিয়েছি গোটা চারেক। তাতেও আটকাবে না বলছ?”

“দূর দূর! মাস্কগুলো দু’নম্বরি! সুতো খুলে পেটে চলে গেল।”

“হজম হয়েছে?”

“সে আর বলতে। ভুটান যা চা বানাচ্ছে আজকাল। সুতোর সাথে কয়েকটা নাড়িভুঁড়িও বোধ হয় হজম হয়ে গেল এতক্ষণে!”

“প্রজাপতি বিস্কুট খাওনি?”

“না। গজা খেলাম দুটো। সেও তো বোধ হয় ভুটানের জন্মের আগে কেনা। জিভটা টক টক করছে।”

“তা হলে খুলেই ফেলো মাস্কটা। বমি হলে উড়ে যাবে।”

ণ নীচে তাকায়। সুন্দরবনের কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। এ বার মাস্ক খুলে ফেলা যায়। সে দিন ভুটানের দোকানে এক রকম ঝগড়াই হয়ে গেল বৃন্দাবনদা আর মিত্তিরের মধ্যে। মিত্তির বলে ক্যানিং থেকে সুন্দরবন শুরু। বৃন্দাবনদা বলে ক্যানিং এখন কলকাতার মধ্যে চলে এসেছে। ঋ, ণ আর ঞ ভাবে, তাতে কী যায় আসে! সেই তো চা আর মুরগির ডিমে দিন শুরু হবে। শেষ হবে রুটি আর ঝাল ঝাল সয়াবিনের তরকারিতে। বৃন্দাবনদা আর মিত্তির একই দলের লোক। আগে আলাদা ছিল যদিও। এখন সব মিশে গিয়েছে। তফাত করা যায় না। ণ আকাশি-নীল মাস্ক খুলে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয়। ওর দেখাদেখি ঋ আর ঞ। সবাই জানে কলকাতা পেরোলে আর মাস্ক পড়তে হয় না।

ক্যানিং পুরাতন বাজার থেকে বাঁ দিকে গোত্তা মেরে কিছুটা উড়ে আলতো পায়ে নেমে পড়ে তিন স্যাঙাত। এই জায়গাটার নাম ডাবু পিকনিক স্পট। এখানে দিনের বেলায় খেজুর গাছগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমোয়। রাতে ভিডিয়ো গেম খেলতে আসে ছেলেদের দল। কী তাদের উৎসাহ! সে বার আমফানে বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সবার। এখনও তার চিহ্ন এ দিকে-সে দিকে ছড়িয়ে আছে। ডাবু পিকনিক স্পটের ঈশান কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে শ্বাস নেয় ঋ, ণ আর ঞ। অনেকটা ওড়া হয়েছে আজ!

লোকে বলে, আসল সুন্দরবন আরও গভীরে। সেখানে উড়তে পারার জন্য এলেম চাই। একটু এ দিক-দিক হয়েছে তো বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপ ঘাড় ধরে এমন টান দেবে, সোজা গিয়ে ভারত মহাসাগরে গিয়ে পড়লেও বলবার কিছু থাকবে না। ঋ, ণ, ঞ কখনও সুন্দরবনের গভীরে ওড়ার চেষ্টা করে নি। খুব বড়জোর মাতলা নদীর পাড় পর্যন্ত। তা-ও গরমের দিনে। যখন হাওয়ার তেজ কম। যে সময়ে ভাটার টানে জল সরে গিয়ে কাদামাটিতে ফসিল বেরিয়ে পড়ে এক-আধটা।

ঋ-র সেই দিনটার কথা মনে পড়ে। মাতলা নদীর দু’পাড় ঘেঁষে অল্প অল্প ধানের চাষ। বাকিটা জলা আর জমিতে মিলমিশ। পুষ্পর দলবল সে বার সাতমুখো অঙ্গনওয়াড়ির বাচ্চাগুলোকে নিয়ে পিকনিক করতে এসেছিল এই জলাজমিতে। পনেরোটা মেয়ে, তেরোটা ছেলে। প্রথমে দৌড়, লং জাম্প, ফুটবল খেলা। তার পর খাওয়াদাওয়া। পুষ্প সাউন্ড বক্সে মিউজ়িকের ব্যবস্থা রাখেনি। ও এ সব পছন্দ করে না। তার বদলে সবাই মিলে অন্ত্যাক্ষরী খেলা হয়েছিল। মেয়েগুলোর কী লজ্জা! ছেলেগুলো সবাই টাইগার শ্রফের ভক্ত।

ঋ-ই খুঁজে পেয়েছিল আঙুলটা। জলার মধ্যে নালিঘাসের ফাঁক থেকে উঁকি মেরেছিল। পিতলের আংটিটা চকচক করছিল দুপুরের রৌদ্রে। ঋ বাথরুম সারতে গিয়েছিল। পিতলকে ভেবেছিল সোনা। পরে যখন বুঝতে পারে পিতল, তখন আরও মনোযোগী হয় এবং শেষ পর্যন্ত গোটা লাশটা আবিষ্কার করে।

সে দিন মাংসের স্বাদ বুঝতে পারে নি কেউ। কার পাতে আলুভাজা কম পড়েছে তা-ই নিয়ে মারামারি করেনি অঙ্গনওয়াড়ির বাচ্চাগুলো। পুলিশ সন্ধের সময় এসে লাশটা নিয়ে যায়। পুষ্পরা কেউ চিনতে পারে নি।

এই ঘটনার প্রায় অনেক দিন পর, এই মাস ছয়েক আগে একটা লোক এসেছিল সাতমুখো পুলিশ থানায়। লোকটার বিজনেস পার্টনার নাকি এই অঞ্চলে জমির দর করতে এসেছিল। তার পর আর বাড়ি ফেরেনি। লোকটার সাথে একটা পাসপোর্ট সাইজ়ের ছবিও ছিল। কিন্তু থানা থেকে তাকে ভাগিয়ে দেওয়া হয়। বিজ়নেস পার্টনারের আঙুলে পিতলের আংটি ছিল কি না, তা সে বলতে পারে নি। আর জলাজমিতে গেঁথে যাওয়া লাশটার মুখ এতটাই ক্ষতবিক্ষত ছিল, ছবি দেখে চেনে কারও বাপের সাধ্যি ছিল না!

ডাবু পিকনিক স্পটে তিনটে খেজুর গাছের ছায়ার ঋ, ণ আর ঞ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই দিনগুলোর কথা ভাবে। পুষ্প তাদের নিতে আসবে। এমনটাই কথা হয়েছিল। গোসাবার শেষ প্রান্তে নিত্যচরণের বাড়ি। নিত্যচরণ হঠযোগী। সুন্দরবনের বেইমান হাওয়ায় ওড়ার সন্ধান রাখে সে। ঋ, ণ, ঞ ভাবে, এক উড়ালে ম্যানগ্রোভ অরণ্য পার করে যেতে পারলে পোর্ট ব্লেয়ার চলে যাবে তারা। ব্রিটিশ আমলে তৈরি কারাগারগুলোয় নাকি এখনও হাওয়ারা কথা চালায়। রাতে নেমে আসে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ভূত। পোর্ট ব্লেয়ার চলে যেতে পারলে আর কোনও দুঃখ থাকবে না।

ক, খ, গ নামাঙ্কিত তিনটে খেজুর গাছ প্রখর রৌদ্রে গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে। দূরে পুষ্প আর সাতমুখো অঙ্গনওয়াড়ির অস্থায়ী শিক্ষক রুবেলাকে দেখতে পাওয়া যায়। ঋ, ণ আর ঞ খয়েরি হয়ে আসা ডানাগুলোর পালক সাফ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পোর্ট ব্লেয়ার চলে যেতে পারলে, ওখানেই আস্তানা গাড়বে তিন জন। পরের বার ভোট দেবে ওখান থেকেই। ণ-র বাবা, ঞ-র সেজো ঠাকুরদা এবং গ্রামের আর পাঁচ মুরুব্বি মিলে খিদিরপুর ডক থেকে যে অস্ত্রগুলো কিনে এনেছিল, সেগুলোও কাজে লেগে যাবে তখন।

ওরা তিন জন পালকের তলায় লুকিয়ে রাখা অস্ত্রগুলোয় হাত বুলিয়ে নেয় এক বার। শরীরের প্রতিটা রোম খাড়া হয়ে ওঠে। বহু দিনের অব্যবহার সত্ত্বেও অস্ত্রগুলো এখনও বেশ সতেজ আছে।

Follow us on:
আরও পড়ুন