‘‘রাতের ঝড়ে পড়ে যাওয়া আম কুড়োসনি দীপ?’’ মোবাইল ফোনে জিজ্ঞাসা করে সুদীপা।
‘‘না রে, মা বেরোতে দেয়নি। তবে আমগুলো এখনও উঠোনে পড়ে আছে। নিয়ে আসব।’’ উত্তর দীপের। দীপ চিন্তাও করল না সুদীপা কেমন করে আমেরিকায় থেকেও, এই ছোট্ট শহরে যে গত রাতে ঝড় হয়েছে সেই খবর জানল।
‘‘তুই এত বাধ্য ছেলে হলি কবে থেকে রে! তুই সারা জীবন ধরেই তো সবার হাড়-মাংস জ্বালিয়ে খেলি। তোকে নিয়ে তো মাসিমার দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না।’’ সুদীপা এ বার দীপকে খেপাতে চায়।
দীপ খেপে না। সে নিরীহ কণ্ঠে বলল, ‘‘না রে, সময়টা ভাল না। ঠান্ডা লেগে জ্বর, সর্দি হলেই শেষ। সবাই সন্দেহ করবে কী না কী হল ছেলেটার। সবাই এড়িয়ে থাকবে আমাদের পরিবারকে। যা হোক, তুই বোস্টন থেকে কাঁচা আমের কথা এত জানতে চাইছিস কেন। ভর্তা খেতে ইচ্ছে করছে?’’
‘‘না রে, এখন আর কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না। ঘরে থাকতে থাকতে একেবারে বোর হয়ে উঠেছি। রাতে ঘুম আসে না। সারা রাত একে-ওকে ফোন করি। ভিডিয়ো কনফারেন্স করে রাত কাটানোর চেষ্টা করি। ইউএসএ-এর খবর তো জানিসই। এখন প্রতিদিন দু’হাজারের উপর মানুষ মারা যাচ্ছে। প্রায় দেড়শোর উপর বাংলাদেশি বাঙালিই নেই হয়ে গিয়েছে এই ক’দিনে। অবস্থা যে কী হবে।’’ দীপার কণ্ঠে অসহায়ত্ব পরিষ্কার।
কী বলে সান্ত্বনা দেবে, দীপ বুঝতে পারছে না। প্রতিদিনই এমন অবস্থায় পড়ে দীপ, গত দেড় মাস ধরে। দিনে এক-দু’ বারই হয় সে সুদীপাকে, নয় সুদীপা তাকে ফোন করে। দু’জনের কথোপকথন এক-দু’ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। সময়ের অভাব নেই এখন কারও। ঘরবন্দি দু’জনেরই এখন অফুরন্ত অবসর। আগে যেখানে এক-দুই মিনিট কথা বললেই এক জন আর এক জনকে কথা সংক্ষিপ্ত করার তাগাদা দিত, এখন আর সে রকম দরকার পড়ে না। একটি বৈশ্বিক ক্রান্তিকাল তাদেরকে অনেক সময় ধরে কথা বলার সুযোগ করে দিল।
দীপের কয়েক মিনিট কেটে গেল নির্বাক। ঘড়ির দিকে তাকাল। এখন বিকেল ৪টে। তার মানে বোস্টনে ভোর ৬টা। কতটা উৎকণ্ঠায় সুদীপারা বাস করছে, দীপ হৃদয়ঙ্গম করল। কয়েক মিনিট পর দীপ উত্তর দিল, ‘‘সুদীপা, এতটা ভেঙে পড়িস না। তাকিয়ে দেখ, পৃথিবীর একটি দেশও আজ এই দুর্যোগের বাইরে নেই। আমাদের অবস্থা দেখ। আজ নতুন করে দশ জন মারা গেল। একশো ছাড়িয়ে গিয়েছে মৃতের সংখ্যা। আক্রান্তের সংখ্যাও ৪ হাজার ছুঁই ছুঁই। এখানে যে হেতু আমাদের করার কিছু নেই, তাই তুই ভয় পেয়ে কেন নিজেকে আরও বিপন্ন করবি বল? বেটার এভার বি স্ট্রং অ্যান্ড স্টাউট।’’
সুদীপা বলল, ‘‘ঠিক বলেছিস। এই দুর্যোগ সারা বিশ্বকে এক কাতারে নিয়ে আসল। উন্নত কিংবা কম উন্নত, ধনী কিংবা গরিব, অভিজাত কিংবা অনভিজাত, সাদা-বাদামি-কালো, কাউকেই ছাড়ছে না করোনা। করোনা দ্য গ্রেট ইগনোর ক্লাস অ্যন্ড পাওয়ার।’’ এ বার হাসল সুদীপা। হেসেই বলল, ‘‘চিন সুপারপাওয়ার হতে কী সর্বনাশটাই না করল পুরো পৃথিবীর।’’
‘‘তুই দেখি ট্রাম্প দাদুর মতো করে বলছিস। এ বার তো তার নমিনেশন পাওয়ার চান্স জ়িরো। এমন বুড়ো-হাবড়ার সুরে কথা বলছিস তুই, বিশ্বাস করতে পারছি না। দেখ, এ বার তোদের ট্রাম্প বলেছে ৪ মে থেকে কোনও কোনও জায়গা থেকে লকডাউন তুলে দেবে। পাগল আর কাকে বলে।’’ দীপ শ্লেষ ঝাড়ল।
এ বার রেগে গেল সুদীপা। ‘‘তোদের তো টেস্ট করারই মুরোদ নেই। তাই স্ট্য়াটিক্সটিক্স পুওর দেখাচ্ছে… কথা শেষ করতে দেয় না দীপ। পাল্টা ঝাড়ি দিল,‘‘ হোয়াট ডু ইউ মিন বাই তোদের? ইজ় নট দিস কান্ট্রি ইওরস?''
সুদীপা এ বার সুর নরম করে। ‘‘ডোন্ট বি এক্সাইটেড ডিয়ার। আই জাস্ট এক্সপ্লেন দ্য এ্যাকচুয়াল সিচুয়েশন। তুই দেখ, বাংলাদেশে যে টেস্ট হচ্ছে তার পরিমাণ কত কম। যদি ওয়াইডলি অল অভার দ্য কান্ট্রি থরো টেস্ট করা হয়, অবস্থাটা কী দাঁড়াবে চিন্তা করতে পারছিস! তার পর দেখছি বাংলাদেশের লোকজন লকডাউন, সোস্যাল ডিসট্যান্স মানছে না। সিএনএনে একটা রিপোর্ট দেখলাম, ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় এক হুজুরের ফিউনারেলে গ্য়াদারড ল্য়াক্স অব পিপল। দুই দিন পরই নাকি ওই জেলাতেই এক সরকারি নেতার পক্ষে বড় জমায়েত হয়েছে। লোকজন নাকি বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বেরোচ্ছে।’’
স্বীকার করল দীপ। তবে পরিহাস করতে ছাড়ল না।‘‘ হবে না কেন বল, দেখলি না মুদিজির ইন্ডিয়ায় একটি গরুর শেষকৃত্যে কত লোক হল। আমরা সাবকন্টিনেন্টালরা হ্যাজিমনিক সুখের চাইতে হেভেনলি হ্যাপিনেসই প্রেফার করি কিনা।''
''হালকা করবি না, প্লিজ়। বাংলাদেশে যেটুকু টেস্ট হচ্ছে সেটুকুই লজিক্যালি এ্যানালাইজ় কর। দেখ বাংলাদেশে এখন ইলেেভেন পার্সেন্ট পজ়িটিভ হয়ে যাচ্ছে। ডেথ রেট ইজ় পুওর বাট রিকভারি রেট ইজ় পুওরার দ্যান দ্যাট। ওয়ার্ল্ডওয়াইড যেখানে এ্যাবাভ টুয়েন্টি পার্সেন্ট ইনফেকটেড পারসন রিকভার্ড অ্যান্ড দ্যা কামব্যাক ইন নরমাল লাইফ সেখানে বাংলাদেশে রিকভারি রেট ইজ় লোয়ার দ্যান থ্রি। এটাও একটা বড় রিস্ক।’’ সুদীপা এক নিশ্বাসে টক শো-র দক্ষ বক্তার মত কথাগুলো বলে গেল।
উভয়েই কিছু ক্ষণ আবার মৌনব্রত পালন করল। দীপের ঘরের জানালায় এমন সময় দু’টি পাখি এসে বসল। এরা ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে কিছুক্ষণ খুনসুটি করে উড়ে চলে গেল। ও দিকে তাকিয়ে দীপ ভাবল ওই পাখি দু’টি বুঝি তারা দু’জনই— দীপ আর সুদীপা।
ও দিকে বোস্টনে স্নোফল হচ্ছে। স্নো জমে বরফ হচ্ছে না। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে আর ছোট ছোট বিন্দু জমছে জানালার কাচে। সুদীপা উঠে গিয়ে জানালার কাচে হাত দিল। জমে থাকা জলবিন্দুতে আঁকিবুঁকি করতে লাগল। এক সময় দেখল সেই আঁকিবুৃকির মধ্যে ভেসে উঠেছে একটি নাম:দীপ। লজ্জা পেল যেন সুদীপা। ফিরে আসল আবার বেডে। হাতে নিল মোবাইল সেট।
সুদীপার মনে পড়ল একটু আগেই দীপ প্রসঙ্গক্রমে হেভেনলি হ্যাপিনেসের কথা বলছিল। মনে পড়তেই হেসে কুটিকুটি হল সুদীপা। তার গলা থেকে কথা ঝরতে শুরু করল। ঠিক বোস্টনের আকাশের মিষ্টি স্নোফলের মত, ‘‘হ্যাপিনেস বলতেই মনে হল তুই একদিন বলেছিলি, উই ব্রিংডাউন হেভেন ইন আওয়ার টুইন'স ওয়ার্ল্ড। মনে আছে সেই কথা। কবে আসবে সেই সময়?’’ সিরিয়াস মনে হচ্ছে এ বার সুদীপাকে।
দীপ প্রাচীন ঋষির মত এবার বলা শুরু করল,‘‘ নিশ্চয়ই সেই শুভ সময় সমাগত হবে। আঁধার কেটে যাবে। আলোর বিচ্ছুরণ শুরু হবেই। সেই আলোর সময়েই আমরা রচনা করব দুই জনের স্বর্গোদ্যান।’’ দীপ যেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা এক মহাপুরুষ। সুদীপার মার গলা শোনা গেল এ বার। তিনি দরজায় নক করে ডাকছেন সুদীপাকে, ‘‘কী রে মা, ক’টা বাজল খেয়াল আছে! সারা রাতই বকবক করে কাটালি। এবার হাতমুখ ধো। কিছু মুখে দিয়ে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা কর মা।'' দীপ ভাবল সত্যিই পৃথিবীর মানুষ এখন সময়ের অতিক্রমণ ভুলে গিয়েছে। করোনা মানুষকে স্থির করে দিতে পারলেও সময়কে আটকাতে পারেনি। দীপের মনে হল,উঠোনে ঝরে পড়া আমগুলো কুড়োতে হবে। সুদীপার জন্য আমের আচার বানিয়ে রাখার কথা বলতে হবে মাকে। সে দ্রুত বেরিয়ে আসল ঘরের বাইরে।