অবিভক্ত বাংলার ঝকঝকে শরৎকাল, পাবনা জেলার শহর থেকে বরিশালের গ্রামের দিকে পাড়ি দিচ্ছে এক কিশোর। পাবনার স্কুলে পুজোর ছুটি হয়ে গিয়েছে, ডাক পাঠাচ্ছে বরিশালের দেশের বাড়ির পুজো। সে-যাওয়াও এক অ্যাডভেঞ্চারই বটে। ট্রেনের থার্ড ক্লাস কামরায় পাবনা থেকে রানাঘাট আর বনগাঁ হয়ে সোজা খুলনা। সেখান থেকে স্টিমার নিয়ে যেতে হবে অনেকখানি। তার পরও কিছুটা জলপথ নৌকায়। সব মিলিয়ে সে প্রায় দু’দিনের রাস্তা। কিন্তু সেই ক্লান্তি আসলে আনন্দই এনে দিত, কারণ পথের শেষেই অপেক্ষা করে থাকত গ্রামের বাড়ির পুজো।
তার পর তো অনেকগুলো দশক পেরিয়ে গিয়েছে। কাঁটাতার বসেছে বাংলার মাটিতে... স্মৃতিগুলো শুধু আজও অবিভক্ত। সেদিনকার সেই কিশোর আজ আশির চৌকাঠ পেরোনো এক মানুষ। কিন্তু ছোটবেলার সেই ভ্রমণ তাঁর অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তাই আজও পুজো এলে সপরিবার কোথাও না কোথাও বেড়াতে চলে যান তিনি, শঙ্খ ঘোষ। তবে পুজোর চার দিনই কলকাতার বাইরে কেটেছে, এমনটা কখনও হয়নি। কারণ নিজে তিনি যতই স্বল্পবাক হোন না কেন, চারপাশে বয়ে চলা পুজোর হই হট্টগোল তাঁর দিব্যি লাগে। আর ভাল লাগে আবাসনের পুজোয় সমষ্টিভোজে সকলের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া। তাই দুটো দিন কলকাতায় কাটিয়ে তবেই পাড়ি। এই তাঁর পুজোর রুটিন।
কত মানুষ কত বছর ধরে শুধু এই একটি উৎসবকে ঘিরে আসা-যাওয়া করছে... ভাবলে অবাকই লাগে। কত জন দূর থেকে ফিরে আসেন বাড়িতে, আবার কত জন বাড়ি ছেড়ে বেড়াতে যান দূরান্তে। এই যাতায়াতের কাঁটাতার কিন্তু পুজোকে ভাগ করেনি। বরং জুড়ে রেখেছে।
অবশ্য বেড়াতে যেতে কোনও কালেই পছন্দ করেন না ‘আশ্চর্য ভ্রমণ’ নামক অভূতপূর্ব বইটির লেখক। আজ অবধি তাঁর যেটুকু ঘুরে দেখা, সবই এক রকম বাধ্যতামূলক। আবার বাক্সপ্যাঁটরা বগলদাবা করো রে, আবার ট্রেনে-প্লেনে চড়ো রে... ভাবলেই তাঁর গায়ে জ্বর আসে। তবে টি শার্ট-ট্রাউজার-স্নিকার পরা এই মানুষটিকে পাশের দোকানে সব্জি দর করতে দেখলে বা পাশ দিয়ে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে যেতে দেখলে ধন্দে পড়ার কোনও কারণ নেই, হ্যাঁ, তিনিই স্বয়ং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বছরে ৩৬১ দিন বিকেলবেলা বেরোনোর অভ্যেস। কেবল পুজোর চারটে দিন শীর্ষেন্দুদা ঘরবন্দি। ভিড়ভাট্টা তাঁর ধাতে সয় না একেবারেই, ঠাকুর দেখতে যাওয়া তো আরওই নয়।
তাঁর নতুন উপন্যাসে ডুব দিয়ে আপামর বাঙালি পাঠক যখন পুজোয় হিল্লিদিল্লি করে বেড়াচ্ছে, তিনি দিব্যি টেলিভিশন দেখে বই পড়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন ষষ্ঠী থেকে দশমী।
সর্বজনবিদিত হওয়ার আর এক ঝামেলাও আছে। যদি বা পুজোয় বেরোনো গেল, সইশিকার আর সেলফিহিড়িক থেকে বাঁচাবে কে? ঠাকুর দেখাই তো মাটি হবে তা হলে। সেই কারণেই পুজোর ভিড় শুরু হওয়ার আগেই চুপি চুপি বাগবাজারের প্রতিমা দর্শন করে আসেন ‘চতুষ্কোণ’য়ের তৃণাদি, ওরফে আমাদের রিনাদি। ছোটবেলায় অনেক রাত পর্যন্ত বাবা-মা’র সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখার একটা রেওয়াজ ছিল ঠিকই, কিন্তু রুপোলি পর্দার কারণেই একটা সময়ের পর তাঁকে পর্দার আড়ালে চলাফেরা করতে হয়। অবশ্য মণ্ডপে বসে আড্ডাটা তাঁকে কোনও কালেই টানেনি। কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকেই টেনেছে বাগবাজারের প্রতিমার সনাতনী রূপ। বিশাল ওই প্রতিমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে সম্ভ্রমের বোধ জেগে ওঠে আপনা থেকেই। তাই উদ্যোক্তারা প্রতি বছর সমাদর আর গোপনীয়তার আশ্চর্য মিশেলে রেড কার্পেট পেতে রাখেন এক জনের জন্যই। তিনি অপর্ণা সেন।
তাঁর পুজোর কলকাতা যদিও এই অব্দিই। তার পরেই শান্তিনিকেতনের বাড়িতে দিনকয়েক নিরুপদ্রব ছুটি আর আড্ডা। এ দিক সে দিক পুজো দেখতে গেলে বেশির ভাগ সময়টাই বিশ্রামে কাটিয়ে দেন নিরিবিলিতে। কে বলতে পারে, পরের ছবির দৃশ্যগুলো মনে মনে তখনই আঁকা হয়ে যায় কি না! ভিড়ে মিশে গিয়ে ঠাকুর দেখাই হোক, বা বুড়ি ছুঁয়ে দূরে চলে যাওয়াই হোক, পুজোর কলকাতা কিন্তু বরাবর সকলকে কাছে টেনে নিয়েছে। সারা বছরের ক্লান্তি আর বিরোধ, বারো মাসের গ্লানি আর হতাশার বিরুদ্ধে সে বারবার উপহার দিয়েছে মন ভাল করে দেওয়া চারখানা ঝলমলে দিন আর রাত। সেখানে বহিরাগত বলে কেউ নেই।
ঠিক যেমন উত্তরপ্রদেশের বদায়ুন থেকে এসেও কলকাতার উৎসবে নির্দ্বিধায় মিশে গিয়েছিলেন এক তরুণ গায়ক। তাঁর গলার জোয়ারি আর গায়কির অদা-তে তখন অবাক হয়ে গিয়েছিল কলকাতা থেকে শুরু করে সারা দেশের সঙ্গীতমহল। আজও তিনি শ্রোতাদের তেমনই অবাক করে দিতে পারেন, এক নিমেষে। গানের কারণে ঘুরে বেড়াতে হয় সারা পৃথিবী, কিন্তু পুজোর চার দিন কলকাতা ছেড়ে কোত্থাও নড়বেন না উস্তাদ রাশিদ খান। একটু বেশি রাতের দিকে কোনও না কোনও প্যান্ডেলে ছেলেমেয়েদের হাত ধরে দেখেও ফেলা যেতে পারে তাঁকে। ঈদে রাশিদদার বাড়িতে মজলিশ বিখ্যাত। পুজোতেও এক দিন আড্ডা মাস্ট। গাইয়ে-বাজিয়ে বন্ধুরা হাজির হন সন্ধের পর। তবে মেনুতে ঈদও যা পুজোও তাই। বিরিয়ানি আর কাবাব ছাড়া রামপুর ঘরানার এই গাইয়ের মন ওঠে না কিছুতেই।
আড্ডার প্রসঙ্গ এলে আর এক জনের কথা মনে পড়ে যায় যে... তাঁর পুজো মানেও ছিল শান্তিনিকেতনের বাড়ি। গড়িয়াহাটের অ্যাপার্টমেন্টের ঠিক সামনেই বিখ্যাত পুজোয় মানুষের ঢল। ভিড়ভাট্টা আর শোরগোল তুঙ্গে ওঠার আগেই সস্ত্রীক তিনি পৌঁছে যেতেন প্রান্তিকের বাড়িটার বারান্দায়। টানা লেখালেখির পর ক’ দিন ঝাড়া হাত-পা। কেবল টুকটাক আড্ডা আর পানভোজনেই কেটে যেত তাঁর পুজোর চারটে দিন। কিন্তু চলে যাওয়ার আগে আমাদের সঙ্গে একটা দীর্ঘ আড্ডা উশুল করে দিয়ে যেতেন সুনীলদা। এই তো, বছর চারেক আগেও, ষষ্ঠীর সন্ধেবেলা হইহই গান-কবিতার তোড়জোড়। সঙ্গে স্বাতীদির আয়োজনে জব্বর ডিনার। সামনের ক’দিন থাকবেন না বলেই বোধ হয় আড্ডা চলল প্রায় রাত দু’টো পর্যন্ত। বাইরে তখন জমজমাট। দশতলার ঘরে একা এবং কয়েকজনের পুজোর বোধন হয়েছিল এই ভাবেই। তখনও বুঝিনি তার দু’ বছরের মাথায় এক অষ্টমীর রাতেই শেষ বার পাড়ি দেবেন নীললোহিত। একমাত্র সেই বারের পুজোটাই বাঙালি মন খারাপে কাটিয়েছে।
মনখারাপের টুকরোটাকরা রসদ হয়তো থাকে প্রতিবারই। কিন্তু সে সব ঝেড়ে ফেলে এক দফা সেজে ওঠার জন্যই তো পুজো। সাধারণ মানুষ যেমন পুজোর চারটে দিন তারকা, তেমন সারা বছরের তারকারাও এই চারটে দিন একটু সাধারণ হয়ে উঠতে চান। লুকিয়ে হলেও ঠাকুর দেখেন, বেড়াতে গেলেও মিলেমিশে খাওয়াদাওয়াটা ছাড়েন না। সাধারণ একটা শরৎকালকে তাঁরা উপভোগ করেন, একটু দূর থেকে হলেও। উদযাপন তো উৎসবের। জীবনেরও। মর্জিমাফিক সবটা না হলেও, শরিফ মেজাজের ক’খানা দিন কাটিয়ে নিতে বাধা কই? আর কে না জানে, মেজাজটাই তো আসল রাজা।
ছবি: সোমনাথ রায়; প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়-এর মেকআপ: সুভাষ বেরা, হেয়ারস্টাইল: পরভেজ আলম,
পোশাক: সঞ্জয় দাস অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়-এর মেকআপ: অয়ন রায়, হেয়ারস্টাইল: শেখর অধিকারী ও ভুলু
লোকেশন সৌজন্য: মানিকতলা চালতাবাগান লোহাপট্টি দুর্গাপূজা বিশেষ সহযোগিতা: সন্দীপ ভুতোরিয়া।