ছবি: কৌশিক সরকার।
আত্মজীবনী লিখছেন? আমরা কবে পড়তে পারব?
লেখা প্রায় শেষ। রোজই রাতে চেষ্টা করি লেখার। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি আপনাদের হাতে তুলে দিতে পারব বইটা।
আজকের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, ফিল্ম মিউজিকের কথা আপনার লেখায় থাকবে?
আজকের ফিল্ম মিউজিক বলে কিছু হয় না।
কেন, এখনকার হিন্দি ছবি দেখেন না?
নাহ্। আমার ইচ্ছেও করে না।
হিন্দি ছবির গান বা কোনও অ্যালবামের গান কেমন লাগে?
খুব খারাপ। না ভাল কোনও কথা আছে। না কোনও সুর মনে ধরে। আমাদের সঙ্গীতশাস্ত্র বলে ছেলেরা নীচের পর্দায় গাইবে। আর মেয়েরা উঁচু পর্দায়। সেখানেই তো শিল্পীর পারদশির্র্তা। আমাদের সময় তো আমরা উঁচু পর্দাতেই গাইতাম। রেওয়াজের জাদু তো সেখানেই ধরা পড়ত। এখন উল্টো। ছেলেরা চড়া গাইছে, মেয়েরা নীচে। কেন, মেয়েরা কি আজকাল চড়াতে গাইতে পারে না?
এখন ডুয়েট গাওয়ার ক্ষেত্রেও কি ছেলে-মেয়ের গানের ফারাক বোঝা যায়?
আমাদের সময় ডুয়েট গাওয়া একটা দারুণ ব্যাপার ছিল। এখন ডুয়েট গানও লোকে একা গায়। ট্র্যাক করা থাকে। শিল্পীরা যে যার সুবিধা মতো আলাদা আলাদা গান রেকর্ড করে। ডুয়েটের সেই প্যাশনটা গানে পাওয়া যায় না। আসলে ভাল গান গাইবার লোকেরই বড় অভাব।
সে কী! ইন্ডাস্ট্রিতে এত লোক নাম করেছে!
(থামিয়ে দিয়ে) দেখুন, নাম করা আর গান গাওয়া এক নয়। নাম তো যে কেউ, যে ভাবেই হোক করে ফেলে। ওটা কোনও কাজের কথা নয়। এখন সব আইটেম সং। শুধুই রিদম। গানে কোনও অনুভবও নেই। গানের কথা অন্তরকে নাড়া দিয়ে যায় না।
এখনকার কোনও গানই আপনার পছন্দ হয় না?
মাঝে সামান্য একটু বদল চোখে পড়েছিল। পাকিস্তানি সঙ্গীতশিল্পীরা গান গাইছিলেন। কথা ভাল হচ্ছিল। ওই যে ‘যব সে তুনে দেখা হ্যায় সনম’ বা ‘তেরে নয়নো সে নয়না লাগে রে’ শুনে ভেবেছিলাম আরও ভাল গান আসবে বুঝি। কিন্তু কই? এখন তো সব ধুম ধাড়াক্কার গান। নাচ আছে। সুর নেই। এখন মনেও হয় না সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ভাল কিছু আর হবে!
অরিজিত্ সিংহ-র গান শুনেছেন? উনি তো ভীষণ জনপ্রিয়...
কে? নাহ্। অরিজিত্ সিংহ-র গান ঠিক মনে পড়ছে না। তবে হানি সিংহ-র নাম শুনেছি। গান যদিও শুনিনি। এ রকম প্রচুর নাম আসে। কিন্তু কেউ নিজস্ব গায়কি নিয়ে, ঘরানা নিয়ে অনেক দিন ধরে টিকে গিয়েছে, এমনটা তো দেখিনি।
এখন তো শিল্পীদের ফিল্মের গানের নিরিখে রেটিং করা হয়। এটা কি ঠিক?
এটা একদমই ভুল। ফিল্মে গান না গাইলে যে শিল্পী হবে না এমনটা আমি মনে করি না। নিজেদের গান গাইতে হবে। এইচ.এম.ভি যখন থেকে রেকর্ড করা বন্ধ করে দিল, মানুষের সিডি কেনা বা রেকর্ড শোনার আগ্রহই চলে গেল। তার পরে গানের চোদ্দোটা বাজিয়ে দিল আপনাদের এই কম্পিউটার। যে যেমন খুশি গান ডাউনলোড করছে, অ্যালবাম কপি করছে। আরে! শিল্পীদের কোনও সম্মানই নেই? সফটওয়্যার সুর, লয় বসিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বোধটা কেমন করে আনবে?
কম্পিউটারের ওপর আপনার এত রাগ?
শুনুন, যখন থেকে এই যন্ত্রটা আমার, আপনার জীবনের মধ্যে ঢুকেছে, তখন থেকে মানুষের ভাবনা, কিছু সৃষ্টি করার ইচ্ছে সবই বন্ধ হয়ে গেছে। না কোনও কবিতা লেখা হচ্ছে, না ভাল গান তৈরি হচ্ছে, না কলম থেকে শব্দ ঝরছে! এই যে আগামী প্রজন্ম, তারা আর কিচ্ছু করবে না। মিলিয়ে নেবেন আমার কথা। শুধুমাত্র কম্পিউটারের সঙ্গে জীবন কাটিয়ে দেবে এরা। আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনার ফোন নাম্বার কী? আপনি হোঁচট খাবেন। কারণ ওটা আপনার ফোনে আছে। আমাদের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু কম্পিউটারের ইশারায় আমরা উঠি বসি। বাচ্চারা মাঠের গন্ধই চিনল না। খেলছে তো কেবল কম্পিউটার। নামতা শিখছে কম্পিউটারে। ওদের কল্পনাশক্তিকে তো আমরাই মেরে ফেলছি।
আর রিয়্যালিটি শো? সেখানে যোগদান করেও কি কিশোর কিশোরীরা নিজেদের সম্ভাবনাকে নষ্ট করছে?
রিয়্যালিটি শো-এ বাচ্চারা যখন গান করে তখন স্ক্রিনে নিজেদের দেখতে দেখতে ওরা ভাবে যে আমরা স্টার হয়ে গেলাম। স্টার ওই ভাবে তৈরি হয় না। রিয়্যালিটি শোয়ের প্রতিযোগীরা অন্যের গান রেকর্ড থেকে তুলে গায়। যেদিন ওরা নিজেদের গান গাইবে, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ইম্প্রোভাইজ করতে পারবে সেদিন ওরা স্টার হতে পারবে। সেটা দীর্ঘদিনের সাধনার ফলেই সম্ভব। সবাইকেই যে প্লে ব্যাক করতে হবে এমনটাও বলতে চাইছি না। কিন্তু স্টেজ-এ পারফর্ম করার সময় যেন একটা ছাপ রাখতে পারে। রিয়্যালিটি শো-এর অ্যাচিভারদের কাছে আমি এটা আশা করি। রিয়্যালিটি শো স্টার হওয়ার সম্ভাবনাকে কেবলমাত্র জাগিয়ে দেয়। সেদিক থেকে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব আছে।
সেই গুরুত্বের কারণেই আপনি কলকাতায়? কোন রিয়্যালিটি শো-এর জন্য আপনি এসেছেন?
আমি জি-বাংলার ‘সারেগামাপা’-র জন্য কলকাতায় এসেছি। ১২ জুন থেকে আপনারা সকলে আমাকে জি বাংলার ‘সারেগামাপা’-র ‘মাস্টারক্লাস উইথ আশাজি’-র এপিসোডে দেখতে পাবেন। আমি মাসে দু’বার ‘সারেগামাপা’-র বিচারক হয়ে আসব। আগের বার ‘সারেগামাপা’-র ফাইনালে একদিনের জন্য এসেছিলাম। খুব ভাল লেগেছিল। ভাল গান শুনতে পেয়েছিলাম। এ বার তো মনে হচ্ছে আরও অনেক অনেক বার আসতে হবে আমায়। আসলে কলকাতায় আসার অজুহাত খুঁজতে থাকি আমি।
কেন, কলকাতা আপনাকে টানে?
শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমায় কলকাতাকে, বাংলা আর বাঙালিকে প্রথম চিনিয়েছেন। কী অনায়াস ওঁর লেখা। আজও চোখে জল এসে যায়। আমার বাড়িতে ওঁর সব লেখা আছে। ওঁর লেখা পড়েই তো মুড়ি যে এমন লোভনীয় খাবার আমি জানতে পারি। তার পরে তো বর্মন সাব ওঁর স্কুল, কলেজ, কলকাতার রাস্তা চেনাতে চেনাতে, কলকাতায় গান বাঁধতে বাঁধতে, কলকাতাকে আমার নিজের জায়গা করে দিয়ে চলে গেলেন। সেই স্মৃতির তরতাজা গন্ধ আজও কলকাতা এলে আমি পাই।
বাংলার টানেই কি বড় ছেলের নাম রেখেছিলেন হেমন্ত?
বাংলা আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধায়, ভালবাসায়। সে সব কবেকার কথা! কলকাতা আসলে ‘আর্টিস্ট হাব’। যেখানে আশাপূর্ণা দেবীর মতো লেখিকাও আছেন, আছেন অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। ওঁর ‘গোরা’ আমার খুব প্রিয়।
রবীন্দ্রনাথের গানের অ্যালবাম করার ইচ্ছে নেই? শ্রোতারা আজও আপনার কণ্ঠে ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’ শুনে মুগ্ধ হন।
আজই প্রথম প্রকাশ্যে বলছি, নতুন প্রজন্মের জন্য রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে অ্যালবাম করব ভাবছি।
নতুন প্রজন্মের জন্য যখন, তখন নিশ্চয়ই কোনও এক্সপেরিমেন্ট করবেন?
কথা, সুর সব কিছু এক রেখে অর্কেস্ট্রেশন করার কথা ভাবছি।
লতাজি আপনার রিয়্যালিটি শোয়ের এই এপিসোড দেখবেন?
হ্যাঁ। ওখানে বাংলা চ্যানেল এলে নিশ্চয়ই দেখবেন।
উনি কোনও রিয়্যালিটি শো-এ আসেন না কেন?
লতাদিদি অসুস্থ। ওঁর পক্ষে দৌড়ঝাঁপ করা সম্ভব না।
এখন লতাজির সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
এখন বলতে?
আসলে শোনা যায় আপনাদের সম্পর্ক না কি ভাল ছিল না...
আজও, এত দিন পরেও আপনারা বস্তাপচা গসিপ নিয়ে বসে আছেন? শুনুন তা হলে, লতাদিদি আমার মায়ের মতো। মা চলে যাওয়ার আগে আমায় বলে গিয়েছিলেন লতাদিদিই আমাদের সকলের মা। বাড়ির সকলেই ওঁকে আমরা অসম্ভব শ্রদ্ধা করি।
নতুন প্রজন্মের মেয়েরা যাঁরা সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চাইছেন, তাঁদের কেরিয়ার না বিয়ে কোনটা বেছে নেওয়া উচিত?
আমাদের সময় আলাদা ছিল। আজকে যাঁরা সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চাইছেন তাঁদের কেরিয়ারকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বিয়ে করে আবেগে ভেসে গেলে চলবে না।