বৌদিমণির কাগজওয়ালা কী বলল জাতীয় পুরস্কারের কথা শুনে?
(হাসি) বৌদিমণি, কাগজওয়ালা, চাঁদের বান্ধবীরা সকলেই খুব খুশি। বলল যে, ‘দারুণ হয়েছে’। এও বলল যে, পুরস্কারের আনন্দে ভেসে যেয়ো না। কাজটা চালিয়ে যাও। এই সব পুরস্কারের হইচই নাকি ক্ষণিকের ব্যাপার। আসলে এরা আমার দীর্ঘদিনের যাত্রার সঙ্গী তো! তাই সতর্ক করেছে।
বৌদিমণির কাগজওয়ালা কি খুব গেরস্ত লোক নাকি?
কাগজওয়ালাই হোক কি বৌদিমণি সকলেই গেরস্ত। কিন্তু আমি গেরস্ত নই। ওরা আমার রাশ টেনে ধরতে চায়। যাতে না উড়ু উড়ু হয়ে যাই (হাসি)।
কেন উড়ুউড়ু লাগছে নাকি?
না। তবে ডানা গজাবার প্রবণতা হতে পারে। উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলতেও পারি। তাই পুরস্কার পাওয়ার পর পণ করেছি অনেক বেশি রেওয়াজ করব, অন্যদের গান শুনব, শিল্পের সব শাখায় আগ্রহ রাখব।
কেউ কেউ বলেন শিল্পীর জীবনে পুরস্কারের থেকেও বেশি মূল্যবান মানুষের ভালবাসা....
সেটা তো অবশ্যই অংশত সত্যি। যখন জাতীয় পুরস্কারের পেতে পারি এ রকম খবর পাচ্ছিলাম, ভেবেছিলাম যদি সত্যি হয় তা হলে কী না কী করব! আনন্দে আত্মহারা হব! কিন্তু শেষমেশ এগুলো কিছুই করে উঠতে পারিনি। কেমন যেন ম্যাদা মেরে গেলাম। তবে আমার পরিবার ভীষণ খুশি হয়েছে। আমার মা এই বছর চলে গেলেন। উনি থাকলেও নিশ্চয়ই খুব খুশি হতেন। মা-বাবার কাছে যে শিক্ষায় বড় হয়েছি তাতে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড অনেক বড় মানে রাখে। আমাকে শেখানো হয়েছে কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কী প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি এঁদের ব্যক্তিত্বই আলাদা। এঁদের সংস্পর্শে যে কোনও ভাবে মুহূর্তের জন্য আসা মানেও বিরাট প্রাপ্তি। তা ছাড়া এই পুরস্কার পাওয়াটা সেলিব্রেশনও...
কীসের সেলিব্রেশন? সাফল্যের?
না। বলা যায় একঘেয়ে ভাবে কাজ করে চলার। এই পুরস্কার উৎসর্গ করতে চাই আমার সেই সব সহশিল্পীকে যাঁরা দিনের পর দিন কাজ করে চলেছেন। কোনও পুরস্কার ছাড়াই। সৎ ভাবে কাজ করে গেলে কিছু না কিছু স্বীকৃতি আসতেই পারে জীবনে। যেমন আমার এল....
একজন বাঙালি যখন রাষ্ট্রপতি তখন জাতীয় পুরস্কারের একটা আলাদা মাত্রাও তো যোগ হয়...
নিশ্চয়ই। খুব ইচ্ছে ছিল ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলার। প্রোটোকল মেনে ‘নমস্তে’ বলেই চলে আসতে হল। এই আক্ষেপটা রয়ে গেল।
অনেকে বলে থাকেন জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পিছনে নানা ধরনের লবির ব্যাপার থাকে। আপনার কী মনে হয়?
হয়তো থাকে। কিন্তু আমার কোনও লবি ছিল না। কোনও একজন শিল্পীনাম করতে চাই না তিনি সে দিন এক সংবাদপত্রে বলেছেন পুরস্কার তো কিনতে পাওয়া যায়। হয়তো আজকের দুনিয়াদারিতে পুরস্কার সত্যিই কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমি পুরস্কারটা কিনিনি। আজ পর্যন্ত যা যা পুরস্কার পেয়েছি তার কোনওটাই কেনা নয়। যাঁরা এই সব বলেন তাঁদের বলব আমরা তো তাঁদেরই সতীর্থ। সৎ ভাবে কাজ করে কেউ যদি পুরস্কার পান সেটাকে খাটো করাটা খুব একটা গর্বের ব্যাপার নয়। তার চেয়ে বরং আমরা বাংলা আধুনিক গানের কী হবে তা নিয়ে ভাবি।
আপনি কি নিজেকে সিনেমার গানের শিল্পী মনে করেন না?
না, প্রথমত আমি বাংলা আধুনিক গানেরই শিল্পী।
‘প্রেম বাই চান্স’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন আপনি। তার পর সঙ্গীত পরিচালনা করলেন না কেন?
কোনও অফার আসেনি সে ভাবে। তাই করা হয়নি। যদিও আমি খুব ইচ্ছুক।
পুরস্কার পাওয়ার পর আপনার সঙ্গে কবীর সুমনের বেশ হাসি হাসি ছবি দেখা গেল প্রচার মাধ্যমে। কিন্তু ‘এ তুমি কেমন তুমি’ গানটা গাওয়া নিয়ে আপনার সঙ্গে কবীরের তো একটা মনো-বিভাজন হয়েছিল। সেটা ঠিক হল কী করে?
কবীরদা কোনও দিন গানটি নিয়ে সরাসরি আমাকে ভর্ৎসনা করেননি। হয়তো ওঁর নিজের লেখা, সুর দেওয়া, নিজের গাওয়া গান তাই নিজস্ব একটা গায়কির প্রতি অনুরাগ তো থাকতেই পারে ওঁর। হয়তো উনি যে ভাবে চেয়েছেন, যতটা চেয়েছেন গানটা সে ভাবে পুরোটা হয়নি। তবে আমি কিন্তু ওঁর কথা মেনেই চলেছি। রেকর্ডিংয়ের সময় উনি বললেন এই গানটা একটা স্টেটমেন্টের মতো প্রেমের গান। বলেছিলেন প্রেম একটা সত্য। সেই সত্যের একটা নির্লিপ্ত প্রকাশ থাকবে গানে। সেই অনুসারে আবেগ কম দিয়ে গেয়ে দেখলাম গানটা সত্যিই অন্য মাত্রা পেয়েছে। যে ভাবনা একমাত্র কবীরদারই নিজস্ব। এই তো সেদিন বিজ্ঞান ভবনের স্টেজে গানটা গাওয়ার পর বললেন, দু’য়েকটা জায়গায় কালোয়াতি করে ফেলেছি। সেটা না করলেই ভাল হত। আমি তাতে কিছুই মনে করিনি। উনি তো আমার বাবার বয়সি। পিতৃতুল্য কেউ বকলে কি অত ধরতে আছে?
আপনার গান লেখা, সুর দেওয়া, নিজে সেই গান গাওয়া এই সবে তো কবীর সুমনের একটা প্রভাব আছে— এ কথা আপনি বহুবার বলেছেন। ওঁর সঙ্গে আপনার আসল সম্পর্কটা কেমন?
দেখুন উনি আমার হিরো। আর হিরোদের থেকে একটা নিরাপদ দূরত্বে থাকাই ভাল। তা না হলে নায়ককে ঘিরে যে মনে মনে মহিমা বা ধারণা তৈরি হয় সেটা ভেঙে যেতে পারে। বেশি কথায় আমি যাই না ওঁর সঙ্গে। যখন ‘জাতিস্মর’য়ের গানের মহড়া হত তখনও গিয়ে শুনতাম ইনস্ট্রাকশনগুলো। বলা যায় না, কবীরদা এত আনপ্রেডিক্টেবল, কোন কথা কেমন ভাবে নেবেন। যদি বকে দেন! তবে ভবিষ্যতে ওঁর সঙ্গে আবারও কাজ করার ইচ্ছে রইল। কবীরদার সঙ্গে কাজ করাটাই তো একটা পুরস্কার।
পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পর পর তিনটে ছবিতে গান গাইলেন। ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘হেমলক সোসাইটি’, ‘জাতিস্মর’। কেমন লাগল ওঁর সঙ্গে কাজ করে?
সৃজিত মানুষ হিসাবে খুব মিউজিক্যাল। কাজ করে খুব ভাল লাগে। সাধারণত প্রযোজক-পরিচালকেরা গান-বাজনার ব্যাপারে খুব একটা মাথা ঘামান না। অনেকটাই ছেড়ে দেন সঙ্গীত পরিচালকের ওপর। সেখানে সৃজিত ওর ছবির মিউজিক নিয়ে খুবই জড়িত থাকে। এতে শিল্পীদের সুবিধে হয়। কোন গানের পিকচারাইজেশন কেমন হচ্ছে, তার সঙ্গে গানটা কেমন ভাবে গাইতে হবে সে সব ব্রিফ খুব পরিষ্কার ভাবে দিতে পারে।
জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর রেট কি বেড়ে যাবে জলসায়?
বন্ধুরা বাড়াতে বলছে। আমি এটা নিয়ে ভাবিনি। মনে হয় না দশ বারো দিন বাদে জাতীয় পুরস্কারের এই ঘোরটা থাকবে। তখন যে কে সেই!
যখন স্টেজে উঠে পুরস্কার নিচ্ছিলেন তখন ঠিক কী মনে হচ্ছিল?
মনে হচ্ছিল বাদল ধর চৌধুরী নামে এক ইমপ্রেশারিওর কথা। যিনি আমাকে কোনও পারিশ্রমিক না দিয়ে লন্ডনে নিয়ে গিয়ে গান গাইয়েছিলেন দিনের পর দিন। লন্ডনটা তখন আমার নরক মনে হয়েছিল। মনে পড়েছিল এমন অনেক কমপোজারের কথা যাঁরা এক সময় দিনের পর দিন রেকর্ডিংয়ের জন্য ডেকে সারা দিন বসিয়ে রেখে আবার পর দিন যেতে বলতেন। স্যাডিস্ট আর কী! মনে পড়েছে আমার এক জেঠিমার কথা, যিনি আমার মাকে বলেছিলেন “তোমার ছেলে ভিক্ষে করে খাবে।” কেন জানি না পুরস্কার নিতে ওঠার আগে এই সব কুস্মৃতিও মনে আসছিল।
এঁরা তো সব শত্রুর পর্যায়ে। কিন্তু আপনার জীবনের ধ্রুবতারা কে? আপনার প্রথম শেখা গান তো ছিল ‘তোমারে করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’....
আমার ধ্রুবতারা আমার বৌ চৈতালি। শুনে খুব ক্লিশে যদি মনে হয়, তা হলেও বলব এটাই সত্যি। ওর সহযোগিতা ছাড়া আমি এই জায়গায় পৌঁছাতাম না। আর একটা কথা। লোকে বলে বিয়ের পর কত বদলে যেতে হয়। চৈতালি আমাকে বদলাতে দেয়নি। আমি যেমন ছিলাম তেমনি আছি। খাসা।
আর চাঁদের বান্ধবীরা জীবনের কোথায় দাঁড়িয়ে?
চাঁদের বান্ধবীদের জন্মদিনে ভদকা খাওয়ার কোনও প্ল্যান করি না। আমি যে তাদের জ্যাঠামশাই হয়ে গিয়েছি নিজেকেই বুঝতে হবে।
হাতে জাতীয় পুরস্কার। আর পরশু পঁচিশে বৈশাখ। এই দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোন গানটা গাওয়া যায়?
“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায় দেখতে আমি পাইনি”। নিজেকে খুঁজে চলার নিরন্তর প্রয়াস চলবেই। কোনও পুরস্কারই তা থামাতে পারবে না। বরং হিয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকা নিজেকে জানার দিকে এগিয়ে দেবে।