সন্দেহ আর মানসিক পীড়নকারী প্রেমিক বা লিভ-ইন পার্টনার থাকলেই যে শেক্সপিয়রের ‘ওথেলো’ তৈরি করা যায় না, রঞ্জন ঘোষের ‘হৃদ্মাঝারে’ দেখতে গিয়ে সেই কথাই বার বার মনে আসছিল। রবীন্দ্রনাথের মতো শেক্সপিয়র নিয়েও বাঙালির বাড়াবাড়ির অন্ত নেই। তার ওপর ছবির পোস্টারে ইংরেজি হরফের বিশেষ বার্তা ‘ইন্সপায়ার্ড বাই উইলিয়াম শেকসপিয়র্স ‘ওথেলো’। সেই দেখে তো বাঙালি দর্শক বুকভরা আশা নিয়ে, বাঙালির চিরকালীন ডেসডিমোনা, সুচিত্রা সেনের নস্ট্যালজিয়াকে রাইমার মধ্যে ফিরে পেতে হৃদয় দিয়ে ‘হৃদ্মাঝারে’ দেখতে যাচ্ছেন।
সত্যি কি ওথেলোর ছায়া
‘হৃদ্মাঝারে’তে পড়েছে? এক কথায় না বলা যাচ্ছে না। ছবিতে নায়ক-নায়িকার অজয় করের ‘সপ্তপদী’ দেখার দৃশ্য, সঙ্গে উত্পল দত্ত-জেনিফার কেন্ডেলের সংলাপে ওথেলো-ডেসডিমোনাকে ‘হৃদ্মাঝারে’ পাওয়া গেছে। কিন্তু এটুকুতে কি হৃদ্ ভরে? আসলে শেক্সপিয়র, ‘ওথেলো’ এ সবের বাইরে গিয়ে ছবিতে আবির-রাইমার গভীর চুম্বনের গহন রাত্রির দৃশ্য যদি দেখি, বৃষ্টি মাখা কলকাতার রোমাঞ্চকে যদি খুঁজে পাই, ফুচকা আর ভাঁড়ের চায়ের গন্ধকাব্যকে যখন ভালবাসার ফ্রেমে ঝলসাতে দেখি, তখন মনে হয় এ ছবি অগোচরেই যেন প্রেমের মুগ্ধতা আর সর্বনাশের কঠোরতাকে আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। এই সর্বনাশা প্রেমই এই ছবি দেখার একমাত্র কারণ।
তবে ছবির গল্পও যে সাঙ্ঘাতিক কোনও নতুন বিষয় নিয়ে কথা বলেছে এমনটাও নয়। প্রফেসরের প্রেম, প্রেমিকার বন্ধুকে নিয়ে প্রেমিকের সন্দেহএ নিয়ে বহু ছবিই হয়েছে। শীর্ষ রায়ের সিনেমাটোগ্রাফিতে কলকাতা আর পোর্ট ব্লেয়ারের দিন-রাতের নরম প্রেমের আলো ছবির আশিকানা মেজাজে এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। বিষয়ে নতুনত্ব না থাকলেও ছবির ট্রিটমেন্টে, ফ্রেমে, সংলাপে একটা নতুনত্ব আছে।
পরিচালক রঞ্জন ঘোষ ছবিতে লিভ-ইন সম্পর্ককে খুব সহজ করে দেখিয়েছেন। প্রেমের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের স্তরগুলো বেশ তারিয়ে তারিয়ে দর্শকদের মনে সঞ্চার করেছেন। তবে ছবিতে লিফ্ট নিতে গিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা দেবযানী (রাইমা সেন) খুব দ্রুতই অভিজিতের (আবির চট্টোপাধ্যায়) ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম দিকে দেবযানী আর অভিজিত্কে দেখে মনে হচ্ছিল যেন তাঁদের কেউ প্রেম করতে বলে দিয়েছেন। পরে যদিও আবির আর রাইমার উষ্ণ রসায়ন জটিল প্রেমের মাত্রা যোগ করে।
আবির এ ছবিতে ভিন্ন ব্যঞ্জনার চরিত্র করেছেন। রোম্যান্টিক অভিজিত্ থেকে সন্দেহের ফাঁদে পড়া যন্ত্রণার অভিজিতের চরিত্রে আবিরের অভিনয় দর্শকের মনে থেকে যাবে। লাস্য আর দৃপ্ততা নিয়ে দেবযানীর ভূমিকায় রাইমা নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। বিশেষ করে রাইমা আর আবিরের গভীরতর আদরের দৃশ্য যেমন দর্শকদের ছুঁয়ে গেছে, ঠিক তেমনই দু’জনের কঠিন মনের দৃশ্য শেষ পর্যায়ে উভয়ের সম্পর্ককে জীবন্ত করে তুলেছে। চায়না টাউনের মালকিনের চরিত্রে সোহাগ সেনের কণ্ঠ, সাজ নিঃসন্দেহে একটা চমক। ময়ূখ ভৌমিকের আবহসঙ্গীত ছবির সঙ্গে মানানসই। বেশ লেগেছে ‘তোর জন্যই’ গানটা।
এত আয়োজনের পরও আসল খামতি চিত্রনাট্যে। অঙ্কের প্রফেসর, বই লিখে যিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতির স্বপ্ন দেখেন তিনি কেমন করে একজন ফেস রিডারের (যাঁকে তিনি কয়েক মিনিটের জন্য দেখেছেন) ‘হো সকে তো ইশক সে দূর রহে না’ এমন আবছায়া কথায় বিশ্বাস করে প্রেমিকার ওপর অকারণ অবিশ্বাসে নিজের মনকে অন্ধকারে খুইয়ে ফেলেন? এ প্রশ্ন ছবি দেখার পরেও থেকে যায়। ‘হৃদ্মাঝারে’ হৃদি ভরায় না, কেবল দোলা দিয়ে যায়।
আদুরে প্রেমের দোলা...
আনাচে কানাচে
আমাদের শান্তিনিকেতন: বোলপুরে সপরিবার পরিচালক অনুরাগ বসু। ছবি: কৌশিক সরকার।
‘কম’ নয়: ‘মেরি কম’ ছবির ফার্স্ট লুকে প্রিয়ঙ্কা চোপড়া।