ছবি: কৌশিক সরকার।
শান্তিনিকেতনের অবাঙালি শিল্পী এই ব্র্যান্ডিং কি মনোজ আর মনীষাকে জনপ্রিয় করেছিল?
মনোজ: অবশ্যই। শান্তিনিকেতনের ভাই-বোন কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের গান গাইছে। এ ব্র্যান্ডিংটা মিডিয়ার জন্য, বিজ্ঞাপনের জন্য খুব সফল হয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই দু’জনে একসঙ্গে গান গাইতাম। এই দু’জনে গাওয়ার আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা আমাদের পারফর্ম্যান্সে খুব কাজে লেগেছে। শেষে এমন হল, আমাদের দ্বৈত গানকেই মানুষ একক হিসেবে নিল।
মনীষা: আমি ব্র্যান্ডিং বুঝি না। দাদাইয়ের জন্যই আমার কলকাতায় গান গাইতে আসা। আমি যে পারফর্ম করতে পারি, এই বিশ্বাসটা ও আমার মধ্যে এনেছিল। গানের ক্ষেত্রে ও-ই আমার একমাত্র ভরসা। তবে অনুষ্ঠান চলাকালীন কোনও ভুল হলে দর্শকদের সামনেই ও যে ভাবে কটমট করে চায়, তখন সত্যি অস্বস্তি হয়। কিন্তু কী-ই বা করি? কিছু বলার নেই। ও-ই আমার ব্র্যান্ড!
শান্তিনিকেতন বললে জনপ্রিয়তার নিরিখে কি আজও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীরা এক্সট্রা মাইলেজ পান?
মনোজ: শান্তিনিকেতনের শিল্পী বলে নিজেকে জাহির করেও এখন তো দেখি শিল্পীরা স্টেজে হাই হিল পরে, শাড়ির বিজ্ঞাপনের মতো এক হাতে আঁচল ধরে কবিপক্ষে বীভত্স ট্র্যাকে গান গাইছেন। আর থেকে থেকেই বলছেন আমি কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান গাই না। তা-ও গাইছি! চাইলে যে কেউ জিনস্ পরেও রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে পারে। সেটা কথা নয়। কিন্তু শান্তিনিকেতন বলতে কি এই ছবিটা আমাদের মনে আসে? কমপক্ষে পঁচিশটা বছর অন্তত শান্তিনিকেতনে থাকলে তবে তো তাঁকে শান্তিনিকেতনের মানুষ বলা যাবে। আজ অবশ্য শান্তিনিকেতনে যিনি সুরে এস্রাজ বাজাতে পারেন না, তিনি গান শেখান। যিনি নাটক নিয়ে পড়েছেন তিনি বাংলা পড়ান।
মনীষা: কলকাতার লোকে আমাদের শান্তিনিকেতনের মানুষ ভাবলেও মজার কথা, শান্তিনিকেতনের প্রথম দিকের মানুষ বাদ দিলে কেউই আমাদের আশ্রমিক বলে স্বীকার করেন না। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।
কেন? আপনাকে তো শান্তিনিকেতনের ‘কণিকা’ বলা হয়। এটা আপনি কী ভাবে নেন? প্রশংসা, নাকি সমালোচনা?
মনীষা: দেখুন আমি শান্তিনিকেতনে বুলবুল বসুর ছাত্রী। উনি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরানার। একটা সময় আমি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া আর কারও গানই শুনতাম না। ফলে আমার গানে ওঁর ছাপ থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে এটা আমি আমার গানের সমালোচনা হিসেবেই দেখি। চেষ্টাও করছি এই তকমাটা থেকে নিজেকে বের করে আনতে। শান্তিনিকেতনে গানের ক্ষেত্রে আর কাকেই বা ভাবব বলুন তো?
আপনি তো পীযূষকান্তি সরকারকে অনুকরণ করতে চেয়েছিলেন? আপনার মনে হয় না সেটা করতে গিয়ে আপনার গানে মেলোড্রামা এসে যাচ্ছিল?
মনোজ: মনীষার সামনে মোহরদি ছিলেন। কিন্তু আমার সামনে কেউ ছিল না। আমি কার কাছেই বা যেতাম? জানি না কেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে কোনও বন্ধুত্ব দেখতে পাই না। কেউ কাউকে দেখতে পারে না। আমাকে লোকে এমনও বলেছে যে কই আপনার গান শুনে তো মনে হয় না আপনি শান্তিনিকেতনের?
শান্তিনিকেতনের গায়কি বলতে?
মনোজ: দাঁত চিপে গাওয়াকে কেন জানি না লোকে শান্তিনিকেতনের গায়কি ভাবে! ওটা ভুল। কলকাতায় এসে পীযূষকান্তি সরকারের গান শুনে চমকে উঠেছিলাম। কথার ঝোঁক, ছন্দ সবটাই আমার শেখা ফ্রেমের বাইরে!
কখনও মনে হয়নি আলাদা করে গাইলেই মনোজ বা মনীষা আজ একক শিল্পী হিসেবে অনেক বেশি জনপ্রিয় হতেন?
মনীষা: না। তবে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ওঁর ছবির জন্য আমাকেই গাইতে বলেছিলেন। পরিস্থিতি এলে আমরা আলাদা অবশ্যই গাই। তবে দাদাই আমার গানের ক্ষেত্রে শেষ কথা। ওকে বাদ দিয়ে গান নিয়ে কোনও দিনই কিছু ভাবতে পারি না।
আর আপনার স্বামী গানের বিষয়ে কিছু বলেন না?
মনীষা: গানের ক্ষেত্রে আমাদের ভাই-বোনের আন্ডারস্ট্যান্ডিং উনি খুব ভাল ভাবেই জানেন।
মনোজ: আসলে বিয়ের সঙ্গে গান গাওয়ার তো কোনও সম্পর্ক নেই। কিছু দিন আগে আমিও একক করেছি। তাতে কেউ যেমন মনীষাকে মিস করেছেন, কেউ আবার বলেছেন মনীষাকে ছেড়েও মনোজ গাইল অবশেষে। দু’রকমই হয়। তবে প্রয়োজন ছাড়া একা গাওয়ার কথা ভাবি না।
মনীষাকে বাদ দিয়ে তো অভিনয় আর নাচও করলেন?
মনোজ: ‘রক্তকরবী’তে রাজা করেছিলাম।
কিন্তু ‘রক্তকরবী’র অন্ধকারের রাজা মঞ্চের আলোয় নাচলেন! এটা কি খুব ভাল হল?
মনোজ: মন্দই বা কী হল? শান্তিনিকেতনে সারা জীবন দেখে এলাম ‘চিত্রাঙ্গদা’য় খারাপ দেখতে মেয়ে কুরূপা, আর ভাল দেখতে মেয়ে সুরূপা করছে। সুরূপাকেই দেখব বলে আমরা অপেক্ষা করতাম। কিন্তু কলকাতায় এসে জেনেছি এক নারীর মধ্যেই সুরূপা আর কুরূপা থাকে। রবীন্দ্রনাথ সব কিছু বলে দিয়ে যাননি, অনেক জায়গা ছেড়েও রেখেছেন। সেই ছাড়া জায়গাগুলোকে জেনে নিয়ে কাজ তো করাই যায়।
আপনি তো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ছাত্র। রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে তান দিয়ে বা বিস্তার করে গাওয়া, অজয় চক্রবর্তী যেমন করে রবীন্দ্রনাথের গান করেছিলেন সেটা কেমন লেগেছিল?
মনীষা: রবীন্দ্রনাথ তো কেবল সুর দিয়ে চলে যাননি। বলেও গিয়েছেন তাঁর গানে কালোয়াতি চলবে না। তা হলে গানের মাঝে রাগ বিস্তার, তান করব কেন?
মনোজ: অজয় চক্রবর্তীর রবীন্দ্রসঙ্গীত নেওয়া যায় না। আবার ওঁর গানের অপভ্রংশ হল সৌম্যজিত্ আর সৌরিন্দ্রর গান। ওঁরা দুজনেই কী অসম্ভব ট্যালেন্টেড! নিজেদের গানে করুন না যা খুশি। আচ্ছা ওঁরা কি বোঝেন না? রবীন্দ্রনাথ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যে পরিবেশে ছিলেন, সেখান থেকে উনি চাইলেই তো নিজের গানের মধ্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্যাটার্ন ব্যবহার করতে পারতেন! এখন মানুষকে ‘স্টার’-এ এনে রবীন্দ্রনাথের গান শোনাতে হয়। নয়তো লোকে টিকিট কেটে অনুষ্ঠানে আসবে না বা দু’টো টিকিট কিনে বলবে দু’টো নিচ্ছি, দাদা কিছু কম হবে?
তা হলে আপনারা কি রবীন্দ্রনাথের গানের এক্সপেরিমেন্টের বিরোধী?
মনীষা: না। রবীন্দ্রনাথের গান তো এখন সিগন্যালে বাজে। বিস্কুট বা মিষ্টির দোকানের বিজ্ঞাপনে বাজে। সংসদেও তো বাজবে শুনছি এ বার এখন মাথা ঠান্ডা রাখার জন্য। তাতে কী? কিন্তু গানটাকে ভেঙেচুরে নিজের পাণ্ডিত্য দেখানো উচিত নয়।
মনোজ: রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কোনও ভুল তথ্যও মানুষকে দেওয়া উচিত নয়।
ভুল তথ্য বলতে?
মনোজ: সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে ‘বঁধু মিছে রাগ কোরো না’ গানটি গাওয়ার আগে বলা হল রবীন্দ্রনাথ নাকি রাজস্থানের ফোক টিউন থেকে মান্ড রাগের ওপর এই গান রচনা করেছিলেন, বলে ‘কেসরিয়া বালম’ও গাওয়া হল। সেই আসরে মানুষের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মঞ্চে বসে আছেন। তাঁর গান শুনতেই লোকে এসেছে। আমি তাঁকেই ফোন করে বললাম এই তথ্যটা তো ভুল। ‘বঁধু মিছে রাগ কোরো না’ মিশ্র তিলোককামোদের আধারে রচিত।
কে তিনি?
শ্রাবণী সেন। শ্রাবণী সেনের দোষ নেই। কিন্তু ওঁর মতো জনপ্রিয় শিল্পীর উপস্থিতিতে এই ভুল তথ্য মানুষের কাছে যাক, আমি চাইনি। তাই খুব বিনীত ভাবে ফোন করে বলেছিলাম।
মীর নিজের কথা বসিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছেন। কেমন লেগেছে?
মনোজ: খুব সস্তা আর বাজারি মনে হয়েছে। ফেসবুকে অসম্ভব রই্যাকশন হয়েছিল মীরের গান নিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের গানের অনুষ্ঠানের স্পনসর পাওয়ার জন্য আজকের দিনে স্টার আনতে হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব?
মনীষা: ব্যক্তির উচ্চাকাঙ্ক্ষার ওপর গানকে জীবিকা করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মানে আমি যদি ভাবি ঝাঁ-চকচকে বিলাসবহুল গাড়িতে আমি গান গাইতে আসব, আমার চার খানা বাড়ি থাকবে। ফার্মহাউস থাকবে। তা হলে শুধু রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে এই জীবন পাওয়া যাবে না।
মনোজ: উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকুক, সেটা গানকে ঘিরে থাক। নিজের নামকে ঘিরে নয়। কোনও দিন কোনও ক্লাব, মিডিয়া, সঙ্গীত পরিচালককে গিয়ে বলিনি আমায় সুযোগ দিন। তাও তো আছি আমরা। আমার আর শ্রীকান্ত আচার্যর অনুষ্ঠানে লোকে পাঁচশো টাকা দিতে চেয়েছিল দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান শুনবে বলে। তবে এখন গানের সঙ্গে পাশাপাশি অন্য কোনও কাজ করাই ভাল।
গানের কাছ থেকে কী চাওয়ার আছে?
মনোজ: আজও অপেক্ষা করে আছি আমি কবে আমার গান গাইতে পারব। যেদিন বুঝব রবীন্দ্রনাথের গান আমার করে গাইতে পারলাম সেদিন যেন নিশ্বাস থেমে যায়।
মনীষা: গান যা দেবে তাই প্রাণ ভরে নেব। আর গান থেমে গেলে আমিও যেন ফুরিয়ে যাই।