জিত্ এ বার গায়ক।
তো, তাতে নতুন কী?
‘পরান যায় জ্বলিয়া রে’ থেকে ‘চ্যালেঞ্জ নিবি না... শালা’ সবই তো তাঁরই গাওয়া।
ভুল। এখানে তো সুরকার-গায়ক জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা হচ্ছেই না।
নায়ক জিৎ এ বার গায়ক। গান গেয়েছেন তাঁর অভিনীত ছবি ‘বচ্চন’য়ে। আর সে গানের সুর দিয়েছেন জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। গানের শ্যুটিং হয়েছে পর্তুগালে।
হঠাৎ অভিনয়ের সঙ্গে গানে মন দিলেন কেন ‘বচ্চন’য়ের নায়ক?
“অনেক দিন ধরেই শো করতে গিয়ে গান গাইতে হত স্টেজে। ওই ছবির গানটা কম্পোজ হওয়ার পর জিৎ আমায় অনুরোধ করল গাইতে। আমি ভাবলাম চেষ্টা করে দেখি। এই গানটা দর্শকের কেমন লাগে। তার পর আরও গাইব কি না সেটা ভেবে দেখব,” বলেন নায়ক।
রিলায়্যান্স এন্টারটেনমেন্ট আর গ্রাসরুট এন্টারটেনমেন্ট প্রযোজিত ছবির এই গানের সুরটা মুম্বইয়ে বসে বেঁধে ফেলেন জিৎ। তার পর সেটা পাঠিয়ে দেন ‘বচ্চন’য়ের পরিচালক রাজা চন্দকে। এত দিন পর্যন্ত নিজের পরিচালিত সব ছবির গানের কথা রাজা নিজেই লিখে এসেছেন। এ বারেও কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। তবে রাজার গান লেখার পদ্ধতিটা বেশ অদ্ভুত। “গাড়ি চালাতে চালাতে আমি সুরটা শুনি। তার পর নিজের মনে হিজিবিজি কথা বসিয়ে গানটা গুনগুন করি। অদ্ভুত ব্যাপার হল স্টিয়ারিংয়ে হাতটা পড়তেই অমনি যেন অনুপ্রেরণা পেয়ে যাই আমি। কোথা থেকে কথাগুলো ভেসে আসে,” হাসতে হাসতে বলেন রাজা।
ঠিক এই রকম হয়েছিল ‘বচ্চন’য়ের ‘টাটকা প্রিয়া মারি’ গানটা লিখতে গিয়ে। “লেক-এর মধ্য দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসছিলাম জিতের অফিসে। গানের সুরটা গুনগুন করছিলাম। তখনই গানের কথাগুলো মাথায় আসে। জিতের অফিসে এসে সঙ্গে সঙ্গে কাগজ নিয়ে লিখে ফেলি ‘অলি গলি কেসটা বলি কেষ্টকলির কানাই রে/ কবে তুই করবি বিয়ে ফিক্স করেছি সানাই রে’। ছবিতে নায়িকা ঐন্দ্রিতার নাম প্রিয়া। সবাই ওকে প্রিয়া মারি বলেই ডাকে। সেখান থেকেই ক্যাচলাইনটা আসে‘টাটকা প্রিয়া মারি’। কথাগুলোর মধ্যে একটা বাঙালিয়ানা আছে। দুষ্টুমি আছে। টেবিল বাজিয়ে জিতের অফিসে আমরা খালি গলায় গানটা গেয়ে ফেলি সে দিন,” পরিচালক জানান।
তার পর শুরু হয় নায়কের গান তোলার ট্রেনিং। সুরকার নিজের গলায় গানটা রেকর্ড করে মুম্বই থেকে মেল করে দেন। সেটা শুনে জিৎ রেওয়াজ শুরু করেন। “তিন-চার বছর ধরেই জিতের ইচ্ছে ছিল গান গাওয়ার। কিন্তু স্যুটেবল গান না পেলে তো আমি ওকে গান গাইতে অনুরোধ করতে পারতাম না। এই গানটা একদম যাকে বলে ফান সং। স্পিরিটটা হল ‘আতি ক্যায়া খন্ডালা’র মতো,” সুরকার জানান।
এক মাস ধরে রেওয়াজ চলতে থাকে। প্রায়ই তারকার কাছে মুম্বই থেকে ফোন আসত সুরকারের।
প্রশ্নটা একই “কী, রেওয়াজ কেমন হচ্ছে?”
জিৎ মন দিয়ে গানটা রোজ প্র্যাকটিস করেন। যতক্ষণ না গানটা একশো পারসেন্ট মন দিয়ে তোলা হচ্ছে, হাল ছাড়েননি। মুম্বইতে গিয়ে গানের রেকর্ডিং হয়। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলে রেকর্ডিং। “প্রথমে একটু টেনশন ছিল, গানটা ঠিক ভাবে গাইতে পারব কি না। যেটা সুবিধে হয়েছে তা হল, নতুন অনেক সফ্টওয়্যার বেরিয়ে গিয়েছে। যে কারণে কিছু ত্রুটি থাকলেও সেগুলো শুধরে দেওয়া যায়,” অভিনেতা জানান।
তবে নায়ক বলেই যে সফ্টওয়্যার বেশি ব্যবহার করছেন এমনটা নয়। “আজকাল তো ফুলটাইম গায়কদের ক্ষেত্রেও আমরা সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে অনেক জায়গায় ঠিক করে দিই। তাই জিতের গানের জন্য যে আলাদা করে সফ্টওয়্যার বেশি ব্যবহৃত হয়েছে এমন নয়। তবে রেকর্ডিংয়ের সময় আমি যতক্ষণ না হানড্রেড পারসেন্ট সন্তুষ্ট হই, ততক্ষণ চেষ্টা করে যাই। প্রফেশনাল সিঙ্গারেরা আমার কাজের এই ধরনটা জানে। জিৎ তো এর আগে আমার সঙ্গে এ ভাবে কাজ করেনি। তাই ওর কাছে এটা একদম নতুন ছিল। রেকর্ডিংয়ের শেষে আমায় ও একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল। তাতে লেখা ছিল: ‘ইউ আর এ টাফ মাস্টার। আ টাস্ক মাস্টার!’ আমার কাছে এটা একটা বড় কমপ্লিমেন্ট ছিল,” বলছেন সুরকার।
কিন্তু গানে এমন কী ছিল যে জন্য জিতের গলাটাই প্রয়োজন ছিল? গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়ার একটা নজির হয়ে থাকবে না তো এটা? মিঠুন চক্রবর্তীকে দিয়ে জিৎ গঙ্গোপাধ্যায় গাইয়েছিলেন ‘মেরেছি পাড়ার রকে আড্ডা রে’। ছবির নাম ‘মিনিস্টার ফাটাকেষ্ট’। ‘বাপি বাড়ি যা’তে ‘সজনা’ গানটাতে আবার সুরকার জিৎ গাইয়েছিলেন অভিনেত্রী অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে। উস্তাদ রাশিদ খানের সঙ্গে। বহু বছর আগে প্রভাত রায়ের ‘তুমি এলে তাই’ ছবিতে গান গেয়েছেন প্রসেনজিৎও। সাম্প্রতিক কালে দেব গেয়েছিলেন ‘খোকা চালু চিজ’। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ‘অনুরণন’য়ে গেয়েছিলেন ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র একটি গান। সব তারকাই যখন গান গাইছেন, তখন জিৎ ব্যতিক্রম থাকবেন কেনএটাই কি একটা কারণ ছিল না? “না, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানো নয়। জিতের গলায় একটা টেক্সচার আছে। যেটা এই গানের জন্য জরুরি ছিল। কথাগুলোর মধ্যে এক ধরনের বাঙালিয়ানা আছে। মুম্বইয়ের যে-কোনও সিঙ্গারকে দিয়ে যে এটা গাওয়ানো যেত না, তা নয়। তবে গানের কথাগুলোর এমন একটা ফ্লেভার আছে যেটা আমি জানি জিৎ খুব ভাল বুঝতে পারবে। আর সেই জন্য এক্সপ্রেসও করতে পারবে,” রাজা জানান।
কিন্তু গলার টেক্সচারের অভিনবত্ব সুরকারের নিজেরও ছিল। ইচ্ছে করেনি এই রকম একটা গান নিজেই গাইতে? এই ছবিতেই তো ‘ভাল কইর্যা বাজাও রে দোতারা’ গানটা সুরকার জিতই গেয়েছেন। “আপনি বোধ হয় জানতে চাইছেন এই গানটা আমরা চমক হিসেবে রাখতে চেয়েছি কি না? তারকা এই প্রথম গান গাইলেন, তার একটা অন্য আবেদন তো থাকবেই। কিন্তু সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট না হলে আমি গানটা এ ভাবে রেকর্ড করতাম না। কত বার নিজের রেকর্ড করা গান আমি শেষ পর্যন্ত অন্যকে দিয়ে গাইয়েছি। চমক হোক বা অন্য কিছু, ফাইনাল কাজটা ভাল হওয়া দরকার,” জোর দিয়ে বলছেন সুরকার।
সিনেমার ইতিহাস বলছে এ দেশে গায়ক-অভিনেতার সংখ্যা নেহাত কম নয়। কে এল সায়গল থেকে শুরু করে কিশোরকুমার, সুরাইয়া, নূরজাহান সবাই বলিউডে অভিনয়ের সঙ্গে গানও গেয়েছেন। মনে আছে ‘নিকাহ’ ছবিতে নায়িকা সলমা আগা নিজেই গেয়েছিলেন তাঁর লিপের সব গানগুলি। টলিউডে সে তালিকায় রয়েছেন কানন দেবী, রবীন মজুদার, পাহাড়ি সান্যাল, রুমা গুহঠাকুরতার মতো গুণীরা। তবে সে জমানায় অভিনেতাদের ফিল্মে গাওয়াটা চমক হিসেবে পরিবেশিত হত না।
দিন পাল্টেছে। তার সঙ্গে প্লে ব্যাকের ধারাও। তারকাদের গান আজকাল ফিল্মের ইউএসপি। হালফিলে ‘গুলাম’ ছবিতে আমির খান গেয়েছেন ‘আতি ক্যায়া খন্ডালা’। ‘জোশ’ ছবিতে শাহরুখ মাতিয়ে দিয়েছিলেন ‘আপুন বোলা’ গেয়ে। ‘কাইটস’য়ে হৃতিক রোশন গেয়েছেন ইংরেজিতে। গানের নাম ‘কাইটস্ ইন দ্য স্কাই’। গানটা গেয়েছিলেন সুজান ডিমেলোর সঙ্গে। কিছু অভিনেতা তো একাধিক বার গান গেয়েছেন বলিউডেও। সে তালিকায় রয়েছেন স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন (‘রং বরষে’, ‘ম্যায় ইয়াহাঁ তু ওয়াহাঁ’)। অভিনেতা জিতের গায়ক হওয়ার পেছনেও তিনি সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।
তা ছাড়াও এই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন সলমন খান (‘হ্যাংওভার’, ‘জুম্মে কি রাত’), সঞ্জয় দত্ত (‘এম বোলে তো’, ‘এ শিবানী’) আর অক্ষয়কুমার (‘মুঝ মে তু’, ‘মাঙ্গে মাঙ্গে’)। পরিচালকেরাও পিছিয়ে নেই। ফারহান আখতার একের পর এক ছবিতে নিজে গান গেয়েছেন। নবাগতা আলিয়া ভট্ট আর শ্রদ্ধা কপূর তো ছবিতে অভিষেক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গান গেয়ে ফেললেন। ছবির প্রধান প্রোমোশনাল অস্ত্র হিসেবে সেই গানগুলোই ব্যবহার হয়েছিল।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে এই সব তারকার গান ছবির প্রচারে ব্যবহার করার যে ট্রেন্ড ছেয়ে গিয়েছে হিন্দি/বাংলা ইন্ডাস্ট্রি জুড়ে, তাতে পেশাদার গায়কদের জায়গাটা কি আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে? কিছু দিন আগেও সুরকাররা গান গাইলে পেশাদার গায়কদের অভিমান হত। এখন আর সুরকার নয়, স্বয়ং নায়ক-নায়িকাই গান গাইছেন। তাতে কি পেশাদার গায়কেরা সুরকারদের বলতে শুরু করেছেন, ‘দ্যাখ, এ বার কেমন লাগে’?
এ প্রশ্নের উত্তরে সুরকার জিৎ বলেন, “না, এ রকম কোনও ব্যাপার নেই। আমি নিজে সুরকার হলেও সব গান তো আর নিজেই গাই না। ‘মন মাঝি রে’ গানটার জন্য অরিজিতকেই চাই। সেটা আমি নিজে গাইনি। গায়কদের জায়গা কেউ নিতে পারবে না। এক সময় একচেটিয়া গাইত সোনু-শান-বাবুল-মোহিত চহ্বাণ। এখন অরিজিৎ-বেণী দয়াল। নায়কদের গান গাওয়াটা অনেকটা তেঁতুলের আচারের মতো। টেস্টি। শেষ পাতে ভাল লাগে। তাই বলে ভাত-ডাল তো আর তেঁতুলের আচার দিয়ে রিপ্লেসড হবে না!”
ভাসমান নায়ক
• ‘ভাল কইর্যা বাজাও রে দোতারা’ গানটার শ্যুটিং করতে ‘বচ্চন’য়ের ইউনিট যায় পর্তুগালে।
শ্যুটিংয়ের সময় হঠাৎ রাস্তায় চোখে পড়ে শূন্যে ভাসমান এক সাহেব।
• সাহেবকে সব্বাই ডাকেন ‘স্ট্যাটিক ম্যান’ বলে। কোনও কম্প্যুটার গ্র্যাফিকস নয়। অদ্ভুত ভাবে
একটা রডকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে ত্রিভঙ্গমুরারী এক কাঠামো তৈরি করেছিলেন এই সাহেব। আর
সেটাকেই শার্টের তলায় লুকিয়ে ঢুকিয়ে ফেলেন তিনি। তার পর এক লাফে তার ওপর চেপে
বসে ভেল্কি দেখাতে শুরু করেন। পর্যটকেরা ভাবেন উনি হাওয়ায় ভাসছেন।
আর সেই নিয়েই তাঁদের বিনোদন। আর সাহেবের রোজগার।
• ঠিক হল সাহেবকে রাজি করিয়ে ওই কাঠামোটা একদিনের জন্য ধার নেবে
‘বচ্চন’য়ের ইউনিট। সাহেব রাজি। কিন্তু ধার দেওয়ার মূল্য এক লক্ষ টাকা।
• ইউনিট তাতেই রাজি। সাহেবের উচ্চতা জিতের থেকে অনেক কম।
তাই ওই কাঠামোতে জিৎকে বসতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।
• এখন গেরুয়া আলখাল্লা পরে গানের এই দৃশ্য দর্শকের ভাল লাগলে জিতের পরিশ্রম সার্থক!