এরা কারা

সকলেই হিট হিন্দি ছবির পরিচালক। কিন্তু আমদর্শক তাদের চেনে না। এটাই বলিউডের নতুন ট্রেন্ড। কেন? লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।উপরের কথোপকথন হচ্ছিল পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। যাঁকে তিনি পাকিস্তানের সত্তর দশকের ক্রিকেটার বলে ভুল করলেন, তিনি পরিণীতি চোপড়া আর অর্জুন কপূরকে নিয়ে পরিচালনা করেছেন ‘ইশাকজাদে’। প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার ‘মেরি কম’য়ের সঙ্গে একই দিনে মুক্তি পেতে চলেছে তাঁর পরিচালিত ‘দাওয়াত এ ইশক্’।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share:

কুইন

—হাবিব ফয়জলকে চেনেন?

Advertisement

—কে?

—নামটার সঙ্গে কি আপনি পরিচিত?

Advertisement

—মনে হচ্ছে সত্তর দশকের পকিস্তানের কোনও ক্রিকেটার!

—আর ভিনিল ম্যাথিউ?

—উঁহু, তবে নামটা শুনে মনে হচ্ছে কেরলের কোনও যাজক!

উপরের কথোপকথন হচ্ছিল পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। যাঁকে তিনি পাকিস্তানের সত্তর দশকের ক্রিকেটার বলে ভুল করলেন, তিনি পরিণীতি চোপড়া আর অর্জুন কপূরকে নিয়ে পরিচালনা করেছেন ‘ইশাকজাদে’। প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার ‘মেরি কম’য়ের সঙ্গে একই দিনে মুক্তি পেতে চলেছে তাঁর পরিচালিত ‘দাওয়াত এ ইশক্’। আর ভিনিল ম্যাথিউ? বিজ্ঞাপন জগতের পরিচিত নাম ভিনিল। পরিচালনা করেছেন ‘হসি তো ফসি’।

‘ইশাকজাদে’ আর ‘হসি তো ফসি’ দুটো ছবিই সৃজিতের দেখা। কিন্তু হাবিব আর ভিনিল? এঁরা যে বলিউডের পরিচালক, সেটাই সৃজিতের মাথায় আসেনি।

তবে সৃজিত একা নন।

অঙ্কুশকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল শশাঙ্ক খৈতানকে তিনি চেনেন কি না। অঙ্কুশ ‘হাম্পটি শর্মা কী দুলহনিয়া’ দেখেছেন। কিন্তু গুগল না করে সে ছবির পরিচালকের নাম বলতে পারবেন না! যদি বলা হয় কোনও হেল্পলাইন না নিয়ে ‘টু স্টেটস’, ‘শুদ্ধ দেশি রোম্যান্স’, ‘জন্নত’র পরিচালকদের নাম বলতে, নব্বই শতাংশ দর্শকই বলতে পারবেন না।

ছবি হিট। কিন্তু পরিচালক?

তাঁরা আবার কারা?

অভিষেক বর্মন পরিচালনা করেছেন ‘টু স্টেটস’। ‘কুইন’য়ের পরিচালক বিকাশ বহেল। কেমন দেখতে এই অভিষেক আর বিকাশকে? অজুহাত হিসেবে বলতেই পারেন যে মাত্র একটা ছবি করেছেন বলে হয়তো লোকে চেনে না। তবে সে যুক্তি ধোপে টিকবে না। ছবিগুলো নিয়ে এত আলোচনা হয়েছে! সেখানে পরিচালকেরা আড়ালেই থেকে গিয়েছেন। সানি লিওনের ‘বেবি ডল’ গানটার জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু বলুন তো দেখি সানির ছবিটা কে পরিচালনা করেছিলেন? ‘রাগিণী এমএমএস ২’ তো এ বছরের হিট ছবি। তবু কেন ভূষণ পটেলের নামটা এত অচেনা লাগে?

শশাঙ্ক, অভিষেক আর ভূষণের না-হয় এটা প্রথম ছবি। বলা যেতেই পারে প্রথম ছবির সঙ্গে সঙ্গেই জনপ্রিয়তার আশা করা উচিত নয়।

কিন্তু এটাও যে বলিউডে হয়নি, তা-ও কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় না। ‘খামোশি’র পরে তো সঞ্জয় লীলা বনশালি অপরিচিত ছিলেন না। দ্বিতীয় ছবি ‘হম দিল দে চুকে সনম’য়ের সময় তো তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়।

সামনেই মুক্তি পাচ্ছে ইমরান হাশমি অভিনীত ‘রাজা নটওয়রলাল’। পরিচালক কুণাল দেশমুখ। এর আগে পরিচালনা করেছেন ‘জন্নত’। কিন্তু কুণালের আজও সে রকম

পরিচিতি নেই।

‘ফাইন্ডিং ফ্যানি’র ট্রেলার নিয়ে এত হইচই চারিদিকে। কত জন পরিচিত ছবির পরিচালক হোমি আদাজানিয়ার সঙ্গে? তিনি তো এর আগে ‘বিইং সাইরাস’ আর ‘ককটেল’-এর মতো ফিল্মও পরিচালনা করেছেন।

তৃতীয় হিন্দি ছবি ‘রঙ্গিলা’ পরিচালনা করার পর থেকেই রামগোপাল বর্মার বেশ নামডাক হয়েছিল। তার পর ‘দৌড়’, ‘সত্য’র মতো সিনেমা বানিয়ে রামগোপাল বেশ কেউকেটা পরিচালকদের তালিকায় নাম লেখালেন।

কিন্তু বিজয় কৃষ্ণ আচার্য? ‘ধুম থ্রি’র পরিচালক। এর আগে পরিচালনা করেছিলেন ‘টশন’ ছবিটি। ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে চেনে ভিক্টর হিসেবেই। তবে আমজনতা? ভিক্টর বা বিজয় কৃষ্ণ আচার্য দুটো নামই তাঁদের কাছে বেশ অপরিচিত।

এ সবের কারণ কি শুধুমাত্র পরিচালকদের লাজুক স্বভাব? খারাপ পিআর? না কি আরও কিছু রয়েছে? নতুন পরিচালকরা ডেব্যু ফিল্মে শাহরুখ খান, সলমনের মতো তারকাদের সঙ্গে কাজ করছেন না বলেই কি তাঁরা হারিয়ে যাচ্ছেন? “ছবিতে সিগনেচার স্টাইল থাকা দরকার। তা হলে দর্শক জানতে চাইবে তাঁদের সম্পর্কে,” বলছেন সৃজিত। “আসলে যশরাজ বা ধর্মা প্রোডাকশনের মতো ব্যানার এক-একটা ফিল্মে এক-একজন পরিচালক নিয়ে আসে। রিপিট খুব কম হয়। তাই হয়তো...,” যুক্তি দেন অঙ্কুশ।

না, সে যুক্তিও টিকবে না। সুপারহিট ফিল্ম ‘ব্যান্ড বাজা বারাত’য়ের পরিচালক মণীশ শর্মা। রণবীর সিংহের তারকা হওয়ার পিছনে এই মণীশের কম অবদান নেই। তা আবার রণবীরকে নিয়েই পরিচালনা করেছেন ‘লেডিস ভার্সাস রিকি বহেল’। সেখানে আবিষ্কার করলেন পরিণীতিকে। তাঁকে নিয়েই পরিচালনা করলেন ‘শুদ্ধ দেশি রোম্যান্স’। প্রযোজনা করছেন ‘দম লগা কে হইসা’। নিজে পরিচালনা করবেন ‘ফ্যান’। মুখ্য ভূমিকায় শাহরুখ খান। যশরাজ মনীশকে তিনটে ছবিতে রিপিট করেছে। তা সত্ত্বেও সৃজিতের মতো অনেকেই কেন তাঁকে চেনেন না? শুধু তাই নয়, ‘ওয়েক আপ সিড’ এবং ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’র পরিচালক অয়ন মুখোপাধ্যায়ের নাম এবং তাঁর পরিচালিত ছবির সঙ্গে পরিচিতি থাকলেও রাস্তায় অয়নকে দেখলে সৃজিত তাঁকে না-ও চিনতে পারেন! “ও যে কাজল-রানির আত্মীয়, সেটাও জানি। কিন্তু কেমন দেখতে, জানি না,” স্বীকার করছেন সৃজিত।

মনীশের কোনও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে অ্যাকাউন্টই নেই। “লোকে বলে ট্যুইটার করলে হয়। কিন্তু আমার পোষায় না। ছবির আগে বা পরে প্রচারে আমি যাই। মিডিয়াকে এড়িয়ে চলি না। তবে পরপর তিনটে ছবি করার জন্য আমাকে শু্যটিংয়ের পর অনেকটা সময় অফিসে কাজ করতে হয়েছে,” বলছেন মনীশ। যশরাজের তিনটে ছবি করার পর চতুর্থটা আবার যশরাজের সঙ্গে করতে আপত্তি নেই তাঁর। বরং নামী এই প্রোডাকশনের ছাতার তলায় থেকে কাজ করার নিরাপত্তাটা বেশ এনজয় করেন এই পরিচালক। বলছেন, “দিল্লি থেকে মুম্বই এসে পরপর ছবি করে যেতে পারছি। কোনও দিন ভাবিনি যশরাজের হয়ে ছবি প্রযোজনা করব। সেটাও করলাম। এত পেয়েও আবার বলব স্পটলাইটটা আমার উপরই ফেলো, তার কী প্রয়োজন?”

তা হলে কি দর্শক আজকাল ছবির ব্যানার আর তারকা নিয়ে এতটাই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে যে, পরিচালকদের খালি উদাসীনতাই প্রাপ্য? শু্যটিং আর পোস্ট প্রোডাকশনের পর থেকে প্রচার পর্বের পুরো দায়িত্ব নিয়ে নেন প্রযোজক। সেখানে ব্যানারের নাম আর নায়কদের জনপ্রিয়তা আসল। ‘হাম্পটি শর্মা...’র প্রোমোশনের ব্যাপারটা আলিয়া ভট্ট, বরুণ ধাওয়ান আর স্বয়ং কর্ণ জোহর পুরোটাই সামলে নিয়েছিলেন। আর এর ফল? শশাঙ্কের ছবি ১০০ কোটির ক্লাবে চলে গেল। দর্শক না-ই বা চিনলেন পরিচালককে।

শশাঙ্কের এই নিয়ে কোনও ক্ষোভও নেই। “আমার এক বারও মনে হয় না যে আমি কোনও ক্রেডিট পাইনি। কর্ণ জোহর সবাইকে ক্রেডিট দেন। আমার কাছে কাজটাই মুখ্য। আমি জানি ‘হাম্পটি শর্মা...’র পরে কর্ণের কোম্পানি থেকেই আমার পরের ছবিটা হবে। সেটা থেকেই ইন্ডাস্ট্রিতে আমার আয়ু বাড়বে। বাংলা বা বিহারের গ্রামে পরিচিতি পাওয়ার থেকে সেটাই বেশি জরুরি,” বলছেন শশাঙ্ক।

বলিউডের কর্পোরেটাইজেশনের পরে ছবির প্রোমোশনাল স্ট্র্যাটেজিতেও অনেক বদল এসেছে। স্টুডিয়োর ছবি এলে তার প্রেস রিলিজে সিইও-র কমেন্ট দেওয়া হয়। পরিচালক আসেন অনেক পরে। যশরাজ ফিল্মস, ধর্মা প্রোডাকশন্স, ইউটিভি, ফক্স স্টুডিয়োজ, রেড চিলিজ, বিশেষ ফিল্মস, বালাজি টেলিফিল্মস, রিলায়্যান্স এন্টারটেনমেন্ট এ সবের সঙ্গে সঙ্গে আমদর্শকও আজকাল বলিউডের বড় বড় ব্যানারের সঙ্গে অনেক বেশি পরিচিত হয়ে গিয়েছে। কোন প্রোডাকশন হাউস কী ধরনের ছবি বানাতে পারে, সেটাও দর্শক অনুমান করতে পারে। তারকা আর ব্যানার এই দুয়ের রাজযোটকই প্রচার পর্বের জন্য যথেষ্ট।

যশরাজ ফিল্মস-এর মার্কেটিং আর কমিউনিকেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট রফিক গঞ্জী অবশ্য বলছেন যে তাঁদের কোম্পানি কখনওই কোনও পরিচালককে প্রচার থেকে সরিয়ে রাখেন না। “এখন পরিচালকরা চান তাঁদের কাজটাই কথা বলুক। প্রথম ছবির আগে কাজ না দেখে কী করে কেউ নিজের প্রচার করবে? এ ছাড়াও পরিচালকদের মানসিকতার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করে,” বলছেন রফিক।

কিন্তু কোনও পরিচালক যদি হিট ছবি দিয়ে চান যে তাঁকে ঘিরেও প্রচার হোক, সেটা বলার মতো জায়গা কি আছে বলিউডে? টলিউডে হিট ছবির সংখ্যা কম। হিট পরিচালকদের সংখ্যা আরও কম। সেখানে পরিচিতিটা স্বাভাবিক ভাবেই আসে। কিন্তু বলিউডে যদি নতুন কোনও হিট ছবির পরিচালক গোঁ ধরে বলেন, তাঁকেও প্রচার দিতে হবে, সেটা শুনবে কে? বলিউডে প্রতিভাবান পরিচালকদের সংখ্যা অনেক। একজন মেজাজ করলে তিন জন এগিয়ে আসবে মোটামুটি একই রকম কাজ করে দেওয়ার জন্য। বেশি চাইলে কোপ পড়বেই। তাই ছবির প্রচারে তারকারা শহরে শহরে গিয়ে প্রচার চালালেও অনেক পরিচালকই কিন্তু ব্রাত্যই থেকে যান। “‘রাজা নটওয়রলাল’য়ের একটা লেখার মধ্যে আমি পরিচালকের নামই খুঁজে পেলাম না,” বলছেন সৃজিত।

এ ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠিত তারকা-পরিচালক আজ প্রযোজনা সংস্থার মালিক। প্রচারের সময় তাঁরাই মধ্যমণি। কর্ণ জোহরের ‘শুদ্ধি’তে হৃতিক না সলমন, কে করবেন, তাই নিয়ে প্রচুর জল্পনা হয়েছে। শেষে লেখা হয়েছে কর্ণ সলমনকে নিয়েই ছবিটি করছেন। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হল ‘শুদ্ধি’র পরিচালক কর্ণ জোহর নন। কর্ণ মলহোত্র, যিনি আগে পরিচালনা করেছেন কর্ণ জোহর প্রযোজিত ‘অগ্নিপথ’।

ধর্মা প্রোডাকশনের সিনিয়র ম্যানেজার (মার্কেটিং) বরুণ গুপ্ত স্বীকার করছেন নতুন পরিচালকের ছবি হলে সেটাকে কর্ণ জোহরের প্রোডাকশন হিসেবেই প্রোমোট করার স্ট্র্যাটেজি নেওয়া হয়। বলছেন, “‘হাম্পটি শর্মা...’র ক্ষেত্রে তাই পোস্টারে প্রথমে আমরা কর্ণর নামটাই দিয়েছিলাম। তার পর শশাঙ্কের নাম।” তার সঙ্গে এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, অনেক পরিচালকই খুব লাজুক প্রকৃতির। যেমন অভিষেক বর্মন। “অভিষেককে আমরা ঠেলে স্টেজে তুলতে পারিনি ‘টু স্টেটস’য়ের সময়। কর্ণ তো একটা প্রেস কনফারেন্সে বলেই দিয়েছিল ও হল ধর্মার ইন-হাউস আদিত্য চোপড়া,” বলেন বরুণ।

তবে যে প্রশ্নটা অনেকেই এড়িয়ে যাচ্ছেন, তা হল এই আড়ালে রেখে দেওয়াটাও কি একটা পরিকল্পনার অঙ্গ? ফ্যাক্টরির মতো ছবি তৈরি করতে হবে। আর প্রতিযোগিতার বাজারে নতুন পরিচালকরা ছবি করার সব সুযোগ চাই। সুযোগ দিচ্ছে এমন প্রোডাকশন হাউস যার কর্ণধারের ভূমিকায় থাকেন তারকা পরিচালকরা। মাঝে মাঝে ‘টক শো’, ‘রিয়্যালিটি শো’র বিচারকের ভূমিকা থেকে ছুটি নিয়ে এসে ছবি পরিচালনা করেন। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সেটাও করেন না। ইন্ডাস্ট্রির শক্তিপুঞ্জ এখন তাঁরাই। বছরে তিন থেকে চারটে ছবি প্রযোজনা করছেন তাঁরা। প্রত্যেকটা ছবির প্রচারে তাঁরাই সামনে। বিধুবিনোদ চোপড়া তৈরি করেছিলেন রাজকুমার হিরানিকে। রামগোপাল বর্মার হাত ধরে যেমন উঠে এসেছেন অনুরাগ কশ্যপ। মহেশ ভট্টও সাহচর্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন অনুরাগ বসুকে।

কিন্তু এ সব হয়েছে প্রায় এক যুগ আগে। আজকের বলিউডে এই জায়গাটা ছেড়ে দেওয়ার মতো শক্তি ক’জনের আছে? মনীশের মতে নতুন সমীকরণে ফায়দা দু’পক্ষেরই। কিংমেকার নিজের সিংহাসন ছাড়তে হয় না। আর যুবরাজরা পর্দার আড়ালেই থেকে যান।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement