পেলের সেই স্ট্যাচু।
কোপাকাবানায় সবাই ফুটবল নিয়ে মত্ত। সামনে পেলের দুর্দান্ত স্ট্যাচু এবং ভারত শুনলেই লোকে বলছে ‘চেষ্টা করো, তোমাদেরও হবে।’
মিডিয়া সেন্টারে পাশের চেয়ারে বসে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কোন দেশ?” বললাম, “ইন্ডিয়া”। প্রায় চোখ কপালে তুলে বললেন, “ইন্ডিয়া! তা হলে এখানে কী করছ?” বিশ্বাস করুন, বেশ সম্মানে লেগেছিল। ভদ্রলোক বোধহয় বুঝতেও পেরেছিলেন একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। সঙ্গে সঙ্গেই নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন তিনি জার্মানির সাংবাদিক। কয়েক দিন আগে পল ব্রাইটনারের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছিল ভারতীয় ফুটবল নিয়ে। ভারতের কোনও একটা জুনিয়র ফুটবল টিমকে ব্রাইটনার না কি কোথাও খেলতে দেখেছেন। এবং প্রচণ্ড প্রশংসা করেছেন ভারতের ছোটদের। ওই জার্মান সাংবাদিক প্রায় সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বলে গেলেন, “তোমরা সঠিক ভাবে চেষ্টা করো। নিশ্চয়ই ইন্ডিয়াও কোনও একদিন বিশ্বকাপে খেলবে।” সেই মুহূর্তে সান্ত্বনার চেয়ে গায়ে জ্বালা ধরছিল বেশি।
এই বিশ্বকাপে সত্যিই আমরা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক। ইন্ডিয়া থেকে আসছি শুনলে প্রত্যেকের প্রতিক্রিয়াই প্রায় একই রকম। বিস্ময়, অবিশ্বাস সব মিলেমিশে একাকার।
এই ক’দিনে ব্রাজিলে ফুটবলের অন্দরমহলে যত দূর উঁকি মারতে পেরেছি, তাতে প্রতিদিন একটু একটু করে বিস্ময় বেড়েছে। গোটা পৃথিবীতে ফুটবল নিয়ে কী অসম্ভব ভালবাসা, কী দুরন্ত আবেগ! ব্রাজিলের কথাই ভাবুন। এই কয়েক দিন বাসে, ট্যাক্সিতে প্রচুর ঘোরাফেরা করলাম। যেদিকে তাকিয়েছি, ফুটবল পায়ে মানুষ। সব বয়সের। বিচে ফুটবল, পার্কে ফুটবল, রাস্তায় ফুটবল। এই দেশটা শুধুই ফুটবলের। ফোর্তালেজায় খেলছে ব্রাজিল। আমি সেদিন রিওতে।
অবাক হয়ে দেখছিলাম রাস্তায় প্রতিটি মানুষের গায়ের হলুদ জার্সিটা। না, ওঁরা কেউ স্টেডিয়ামে যাবেন না। বাড়িতে টিভির সামনে গিয়ে বসবেন। অথচ ওই হলুদ জার্সিটা এমন একটা গর্ববোধ দেয়, যাতে ওঁরা সবাই শামিল হতে চান। কোপাকাবানা বিচের সামনে রাস্তায় রাস্তায় দেখলাম মেলা বসে গিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ
বসে গিয়েছেন বার-কিয়স্কগুলোয়। বিয়ার, ভদকা, কাসাসা, ওয়ারেনার ঢালাও আয়োজন। টিভির সামনে শুধু মানুষের ভিড়। কোপাকাবানা বিচেই ফিফা এ বার ফ্যান ফেস্টের আয়োজন করেছিল। বিশ্বকাপের সময় গত কয়েক বছর ধরেই ফ্যান ফেস্টের আয়োজন করে আসছে ফিফা। বিরাট একটা জায়গা জুড়ে জায়ান্ট স্ক্রিন
রাখা থাকে। সামনে হাজার হাজার মানুষ। কোপাকাবানা বিচের রাস্তা সেদিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মানুষে মানুষে। ফ্যান ফেস্টের ভেতরে যাঁরা জায়গা পাননি, তাঁরা চলে এসেছেন বাইরে, রাস্তায়। সেখানে দাঁড়িয়েই চোখ রেখেছেন জায়ান্ট স্ক্রিনে। আর ফ্যান জোনের ভিতর হাজার হাজার মানুষ। বিচিত্র তাঁদের সাজ। শরীর জুড়ে ব্রাজিল আর হৃদয় জুড়ে ফুটবল। মেক্সিকোর সঙ্গে সেদিন ড্র করল ব্রাজিল। ম্যাচ শেষে কিছু শোকাহত মুখ দেখব ভেবেছিলাম। কিন্তু কোথায় কী! ফেস্টে গান শোনাতে এলেন ডুডু নোরবে। ব্রাজিলের অন্যতম জনপ্রিয় সাম্বা গায়ক। শুরু হয়ে গেল গোটা ম্যান জোন জুড়ে সাম্বা নাচ। ওই হাজার হাজার মানুষের মধ্যে একজনও নেই যিনি নাচছেন না। পায়ের কিছু স্টেপ বদলের সঙ্গে শরীর দোলানো চলছেই। সবারই এক স্টাইল সাম্বা।
রিওতে একটা অদ্ভুত মিউজিক ব্যান্ডের সঙ্গে আলাপ হল। ওদের নাম ‘সাম্বা ফুটবল ক্লাব’। গত দু’মাস ধরে ওরা রিওর ব্রাজিলিয়ান কালচারাল সেন্টারে টানা শো করে যাচ্ছে। ওদের ডিরেক্টর গুস্তাভো গ্যাসপারানি। বছরখানেক আগে থেকেই গোটা শো নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয় তাঁর। একজন ফুটবলার বা ফুটবল সমর্থকের জীবন, তার আবেগ-ভালবাসা-বেঁচে থাকা গানের মাধ্যমে তুলে ধরেন তাঁরা। এঁদের কথা জানতে পারি রিওতে ‘গ্লোবো’ নিউজপেপারে বিজ্ঞাপন দেখে। হোটেলের রিসেপশনিস্ট মেয়েটি ইংরেজি জানত। ওই জানিয়ে দিল ব্রাজিলিয়ান কালচারাল সেন্টারের ঠিকানা। রাতে ওখানে পৌঁছে অবাক আমি। ব্যান্ড মেম্বাররা জার্সি, শর্টস, বুটস পরে স্টেজের উপরে। কেউ গিটার হাতে, কারও গলায় ঝোলানো কী-বোর্ড কিংবা ড্রাম। কী অনবদ্য ওদের প্রাণশক্তি। আড়াই ঘণ্টার অনুষ্ঠানে ওঁরা শুধুই ফুটবলের কথা বললেন। শো শেষ হচ্ছে, তখন দেখি অডিটোরিয়ামের সবাই একসঙ্গে গাইছেন ফুটবলের গান। ব্রাজিলে এই হল ফুটবল। এই হল আবেগ।
স্যান্টোসে ক্যানাল ফাইভের পাশে ‘আ সাল্টিসা’ নামের এক কফিশপ কাম বার আছে। ‘আ সাল্টিসা’কে বলা হয় স্যান্টোস সমর্থকদের নিজস্ব দোকান। এমনিতেই স্যান্টোসের ক্যানাল ফাইভ রীতিমতো ঐতিহাসিক জায়গা। গোটা স্যান্টোস শহরটা সাতটা ক্যানেলে বিভক্ত। স্যান্টোসের এক দিকের সমুদ্রের সঙ্গে অন্য দিকের সমুদ্রের যোগাযোগ এই ক্যানেলগুলোর মাধ্যমে। ক্যানাল ফাইভটা সত্যিই যেন অদ্ভুত জায়গা। এখানেই এক সময় পেলে থাকতেন তাঁর প্রথম স্ত্রী-র সঙ্গে। পরে তিনি অন্য বাড়িতে উঠে গেলে বাবা ডনডিনহো আর মা ডোনা থাকতে শুরু করেন এখানে। শেষ অবধি এখানেই থাকতেন ওঁরা। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর পেলে এক বিজনেস পার্টনারের সঙ্গে এখানে বিরাট এক মাল্টি-স্টোরিড তুলেছেন। নাম দিয়েছেন বাবার নামে রেসিডেন্সিয়াল ডনডিনহো। ফুটবলার বাবাকে দেখেই নিজের ফুটবলে আসা। বাবাই তাঁর অনুপ্রেরণা। বারবার বিভিন্ন সাক্ষাত্কারে বলেছেন পেলে। তাই বাবার মৃত্যুর পর এই সৌধটা বানিয়ে রেখেছেন বাবার স্মৃতিতেই।
আর স্যান্টোসের সাপোর্টাররা তাদের প্রিয় পেলের জন্য স্মারক বানিয়ে রেখেছেন এই ‘ডনডিনহো হাউস’ থেকে ঠিক দশ হাত দূরেই। ক্যানাল ফাইভের ঠিক পাশে। দুূর্দান্ত একটা পেলের স্ট্যাচু। পেলে গোল করে যে ভাবে সেলিব্রেট করতেন, ঠিক সেই ভঙ্গিমায়। “যে দিন স্ট্যাচুর উদ্বোধন হল, সে দিন পেলে এসেছিল এখানে। আমার দোকানেও। খুব ইমোশনাল দেখেছিলাম সে দিন পেলেকে। কেঁদে ফেলেছিল মূর্তিটা দেখে,” এক নাগাড়ে বলছিলেন মার্সিলিন। ‘আ স্যান্টিসা’র মালিক। ক্যানাল ফাইভে পেলের স্ট্যাচুর উল্টো দিকেই মার্সিলিনের এই বার কাম কফিশপ। পেলের স্ট্যাচুর যাবতীয় দেখাশোনার দায়িত্বও তাঁর। বিশ্বকাপের সময় পেলের গায়ে চাপানো স্যান্টোসের সাদা-কালো জার্সি, মাথায় সেই বিখ্যাত টুপি। মার্সিলিনই সব ব্যবস্থা করেছেন। আর দোকানটা যেন মিনি স্যান্টোস ফুটবল ক্লাব। টিভিতে চলছে স্যান্টোসের ডকুমেন্টারি। যার বেশিটাই এই দোকানে শু্যট করা। দেওয়াল জুড়ে স্যান্টোসের নানা ছবি।
সকাল থেকেই ওখানে যাঁরা ব্রেকফাস্ট নিয়ে বসে গিয়েছেন, তাঁরা সবাই স্যান্টোসের সাপোর্টার। স্যান্টোসের প্রতিটা ম্যাচের পর এখানেই জমায়েত হয় সাপোর্টাররা। পেলের মূর্তির সামনে এ যেন এক ধর্নামঞ্চ। সব জয়-পরাজয়, আনন্দ-শোকের সঙ্গমস্থল। মার্সিলিন বলছিলেন, “ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে স্যান্টোসের খেলা দেখতে যেতাম। মা ছিলেন স্যান্টোসের সাপোর্টার। আমিও তার পর এই ক্লাবের বাইরে কিছু ভাবতে পারছিলাম না। ১২ হাজারের বেশি গোল করেছে আমার ক্লাব। আমার নিজেরই বোধহয় বেশ কয়েক হাজার গোল দেখা,” প্লেটে ফ্র্যাঙ্গো আসওয়াডো তুলে দিতে দিতে বলছিলেন মার্সিলিন। পর্তুগিজে চিকেন হল ফ্র্যাঙ্গো। ‘আ স্যান্টিসা’য় ফেভারিট ডিশ। রবিবার সকালে অনেকেই দেখলাম রোস্টেড চিকেন, পোটাটো আর রেড ওয়াইন নিয়ে বসে গিয়েছেন। সবার আলোচনায় স্যান্টোস এফসি। বিশ্বকাপ বলে অবশ্য অনেকটাই ব্রাজিল। মার্সিলিনের দোকানও সাদা-কালো থেকে হলুদ-সবুজ চেহারা নিয়েছে। বাইরে একটা ফেস্টুন টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্যান্টোস থেকে জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করা সবার ছবি দিয়ে। গিলমার থেকে রবিনহো, নেইমার। আর সম্রাট যিনি, তাঁকে তো রীতিমতো মূর্তি বানিয়ে পুজো করে স্যান্টোসের এই মানুষজন। তেরেসে-পোলিসে ব্রাজিলের বেস ক্যাম্প দেখতে গিয়েছি। দেখি, পাহাড়ের ওই মাথায় হাজার হাজার ব্রাজিলিয়ান সাপোর্টার দাঁড়িয়ে আছেন। একবার নেইমারদের দেখবেন বলে। বেস ক্যাম্পের বাইরে একটা রেস্তোরাঁয় অপেক্ষায় বেশ কিছু মানুষ। সবাই গান গাইছেন, ড্রাম বাজাচ্ছেন। যে ভাবেই হোক, দেশের ফুটবল দলের পাশে ওঁরা। ওঁদের ড্রামের আওয়াজ বা গানের শব্দ হয়তো নেইমারদের কান অবধি পৌঁছয় না। কিন্তু নেইমাররা জানেন, তাঁদের জন্য এ ভাবেই অপেক্ষায় অনেক মানুষ।
জার্মান ওই সাংবাদিকের কথাটা আবার মনে পড়ছিল, “ইন্ডিয়া! হোয়াট আর ইউ ডুইং হিয়ার?” এই কয়েক দিনে মনের মধ্যে তোলপাড় করে চলেছে কয়েকটা হিসেবনিকেশ। আবেগের ব্যালেন্স শিটে আমাদের কম কিছু তো নেই। বঙ্গোপসাগরের পাশে প্রিয় ক্লাবের পরাজয় সহ্য করতে না-পেরে আত্মহত্যার ঘটনা আছে। এখনও যুবভারতীতে যে এক লাখ লোক খেলা দেখতে আসেন, তাঁরাও প্রিয় ক্লাবের জন্য হাসেন, কাঁদেন, অ্যাটলান্টিকের পাশের এই সমর্থকরা তো জাতীয় দলের সমার্থক। অথচ আমরা জাতীয় দলকে সমর্থন করার স্বাদটাই পেলাম না।
মারাকানা স্টেডিয়ামে সে দিন স্পেন-চিলি ম্যাচ দেখছিলাম। সান দিয়াগো থেকে প্রায় ষাট হাজার চিলি সমর্থক এসেছেন রিওতে। স্টেডিয়ামের ভিতরে-বাইরে চিলি-চিলি চিত্কারে কান পাতা দায়। বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে বিদায়ের রাস্তাটা দেখিয়ে দেবার পরে চিলির রঙে লাল হয়ে যাওয়া স্টেডিয়ামে যখন ওঁরা সবাই মিলে জাতীয় সঙ্গীত গাইছিলেন, বিশ্বাস করুন, আপসোস হচ্ছিল খুব। ইস্, এই আসরে যদি কোনও দিন খেলতে পারতাম আমরা।
বিশ্বাস করি, সে দিন নীল হয়ে যাবে সবটা। বিশ্বকাপ ফুটবলের গ্যালারিতে চেনাচেনা মানুষজন। আমরা সবাই মিলে গাইছি, ‘জনগণমন অধিনায়ক, জয় হে’।
কে জানে, এই জীবনে এই শিহরন, এই রোমাঞ্চটা কোনও দিন পাব কি না!