ছবি: কৌশিক সরকার
তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর ’পরে রাগ করো—
আর তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো—
তার বেলা?
অন্নদাশঙ্কর রায়ের এই ছড়া বলতে গিয়ে চোখের কোণটা সামান্য চিকচিক করে ওঠে। দেশভাগের স্মৃতি স্বভাবতই বেদনাদায়ক। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের বালিগঞ্জের বাড়িতে বসে তাঁর পরবর্তী সিনেমা নিয়ে আড্ডা দিতে গিয়ে গৌতম ঘোষের মনটা মেঘলা হয়ে আসে। নিজের ভিটে মাটির কাছে দে ছুট বলে যেতে না পারার দুঃখটা মোচড় দেয়।
মঙ্গলবার সকালে এই নিয়েই আড্ডা দিচ্ছিলেন পরিচালক গৌতম ঘোষ। শুধুমাত্র স্মৃতিচারণা নয়। এই অনুভূতি থেকেই তিনি লিখেছেন তাঁর পরবর্তী চিত্রনাট্য। যে ছবির নায়ক প্রসেনজিৎ। ‘মনের মানুষ’য়ের পরে আবার দু’জনে একসঙ্গে। তবে কোনও পিরিয়ড কাহিনি নয়। সমকালীন এক ছবি। “এক ব্যক্তি, তার স্ত্রী এবং কন্যার ধাবমান যাত্রার গল্প। যাদের বর্ডারের এপার থেকে ওপার যাওয়াটাই জীবনের সব থেকে বড় সংগ্রাম। এই ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করবে বুম্বা,” জানান পরিচালক।
প্রথম যে দিন গৌতম তাঁকে চিত্রনাট্যর খসড়া শুনিয়েছিলেন তখন মনের মধ্যে নিজেই একটা ছবি এঁকে ফেলেছিলেন প্রসেনজিৎ। “গল্পটা শুনেই আমি গ্যারেজের সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ি। গৌতমদা বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইলে বলি: ‘এ ভাবেই তো আমার চরিত্রটা নদীর ধারে বসে থাকবে, তাই না?”’ বলেন প্রসেনজিৎ।
সে দিনই গৌতম বুঝতে পারেন ছবির জন্য প্রসেনজিতের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে।
পরিচালক নিজে ফিরে যান ছোটবেলার স্মৃতিতে। “যখন স্কুলে পড়তাম তখন সহপাঠীরা বলত গরমের ছুটিতে দেশের বাড়ি যাবে। আমি মাকে জিজ্ঞেস করতাম, আমাদের দেশের বাড়ি নেই? আমরা যেতে পারি না সেখানে? মা বলতেন: ‘আছে। যাওয়াটা অত সহজ নয়...’” বলে চলেন তিনি।
প্রসেনজিৎ ফিরে যান তাঁর দাদামশায়ের স্মৃতিতে। “বাড়ি ফেলে এসেছিলেন বাংলাদেশে। অদ্ভুত এক সংকট। সব রয়েছে ও দেশে। কিন্তু তা নাকি এখন ‘এনিমি প্রপার্টি’। বাংলাদেশের ফেলে আসা বাড়িঘর তো আর শুধু কংক্রিটের খাঁচা নয়। সেখানে পরতে পরতে রয়েছে অনুভূতির ছোঁয়া,” বলেন প্রসেনজিৎ।
টুকরো টুকরো এই রকম নানা প্রসঙ্গ ভেসে আসে কথার মাঝে। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ শু্যটিং করতে এসে বাংলা দেশের অভিনেতা রইসুল ইসলাম আসাদ নাকি একদিন কাজ থেকে ছুটি চেয়েছিলেন। কারণ? হুগলিতে নিজের আদি গ্রাম দেখে আসবেন বলে। এই রকম আরও কত গল্প মনে ভিড় করে আসে। “দেশভাগের সময় বর্ডারটা অদ্ভুতভাবে টানা হয়েছিল। এমনও দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে বাড়ির মধ্যে দিয়ে বর্ডার চলে গিয়েছে,” বললেন পরিচালক। ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসে নানা ঘটনা। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, এমনকী র্যাডক্লিফ লাইন প্রসঙ্গ। “বর্ডার কমিশন-এর ইনচার্জ স্যর সিরিল র্যাডক্লিফ বর্ডার ঠিক করার চার্জ নিয়েছিলেন ৮ জুলাই, ১৯৪৭। রিপোর্ট তৈরি করে ফেলেন ৯ অগস্টের মধ্যে। কিন্তু অদ্ভুত সেই বর্ডার। নদী ভাগ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু নদী তো এক জায়গা দিয়ে বয়ে চলে না। সে কথা কেউ ভাবেননি তো?” প্রশ্ন তোলেন পরিচালক।
বর্ডার সিকিওরিটির ফোর্সের অধিকর্তা বি ডি শর্মার সঙ্গে নানা সময়ে কথা বলেছেন পরিচালক। কত রকমের গল্প শুনেছেন তাঁর মুখে। “একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম বাঘেরা যদি বর্ডার টপকে অন্য দেশে চলে যায় তখন সীমান্তরক্ষীরা কী করবেন সেখানে? ওরা মুচকি হেসে বলেছিল কার সাহস বাঘেদেরকে বর্ডারে নিয়ে টিউশন দেয়! পাখি উড়ে যায় এ দেশ থেকে ও দেশে। সেখানে কিচ্ছুটি করার নেই। সব কোপ পড়ে মানুষের ওপর,” বলেন তিনি।
আর এই পারাপার নিয়েই তো তাঁর ছবি। এই ফিল্মের সঙ্গে কি নাসিরুদ্দিন শাহ-শাবানা আজমি অভিনীত ‘পার’য়ের কোনও মিল রয়েছে? আজও অনেকেই ভুলতে পারেন না সেই ছবিতে নাসিরউদ্দিনের বাড়ি ফেরার দৃশ্য। এক পাল শুয়োরকে সঙ্গে নিয়ে সাঁতরে পার করার সেই শট। শোনা যায় নাসিরউদ্দিন নাকি শু্যাটিংয়ের সময় তেমন ভাল সাঁতার জানতেন না। “জানত না তো, শাবানা ভাল সাঁতার জানত। তবে নাসির সেইরকম কিছুই জানত না। আর তা না জেনেও ওই রকম শট। মনে আছে ‘মনের মানুষ’য়ে অভিনয় করার সময়য়ও বুম্বাও তেমন ভাল সাঁতার জানত না,” গৌতম বলেন। সে কথার খেই ধরেই প্রসেনজিৎ বলেন, “সাঁতার তেমন জানতাম না তবে এমন জায়গায় গিয়ে শট দিয়েছি যেখানে মাইলের পর মাইল কারও দেখা মিলত না। চারিদিকে শুধু জল আর কুয়াশা। আমি একটা ছোট ডিঙিতে...” বলতে গিয়ে ফিরে আসেন ‘পার’ ছবির প্রসঙ্গে। জানান, “আমাদের ছবিতে পারাপার আছে ঠিকই তবে এটা ঠিক ‘পার’ নয়...”
এ ছবিতে আর এক বার প্রসেনজিৎকে নায়ক হিসেবে পেয়ে কেমন লাগছে গৌতমের? “আমি ভাল খারাপ— সব রকমের অভিনেতার সঙ্গে কাজ করেছি। বুম্বার মতো এত ডিসিপ্লিনড অ্যাক্টর আমি খুব কম দেখেছি। ডিসিপ্লিন মানে শুধু সময়ে আসা নয়। চরিত্র নিয়ে ও ভাবে। ভিতরে ঢুকে যায়...।”
প্রশংসা শুনে প্রসেনজিতের মুখে মৃদু হাসি। এ ছবিতে কি আবারও নিজের লুকটা পাল্টাবেন তিনি? ইতিবাচক উত্তর দেন প্রসেনজিৎ।
তবে এখনও লুকটা ঠিক হয়নি। বলেন, “প্রত্যেক ছবিতেই আজকাল চেষ্টা করছি নিজের লুকটা পাল্টাতে। সে দেখে সৃজিত আমাকে মজা করে বলেছিল, এ বার তোমার সঙ্গে এমন একটা ছবি করতে হবে, যেখানে তোমাকে তোমার মতো দেখতে লাগবে। সেই কথাটা মাথায় থেকে যায়। তারপর ‘ফোর্স’ আর ‘লড়াই’ করি। সেখানে লুক নিয়ে মারাত্মক পরীক্ষানিরীক্ষা নেই।”
তবে চেহারা নিয়ে পরীক্ষা করতে তাঁর ভালই লাগে। “বলিউডের অভিনেতাদের এ নিয়ে অনেক সুযোগ থাকে। মাসের পর মাস একটাই ছবি করে। আমরা তো তা পারি না। তার মধ্যেও চেষ্টা করি,” বলেন প্রসেনজিৎ। এই চেহারা নিয়ে অভিনেতাদের পরীক্ষা প্রসঙ্গে গৌতম জানান রবার্ট ডি নিরোর সঙ্গে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতা। “তখন ‘রেজিম’ বলে একটা ছবি করেছিল রবার্ট। শুধু ওই রোলটার জন্য দেড় বছর আর কোনও কাজ করেনি। ওই দেড় বছর দিয়ে দিয়েছিল স্করসেসেকে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে অবশ্য কোনও অভিনেতার পক্ষে শুধুমাত্র একজন পরিচালকের জন্যই দেড় বছর দেওয়াটা খুবই মুশকিল,” বলেন পরিচালক।
তবে যেটুকু সুযোগ আর সময় পাওয়া যাবে, তার সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করবেন প্রসেনজিৎ। শু্যটিংয়ের জন্য এ বারও ফিরে যাবেন বাংলাদেশে। মনে পড়ে যায় ‘মনের মানুষ’য়ের সময় সুনামগঞ্জ-এর হাওরাঞ্চল বলে এক জেলায় গিয়ে শু্যটং করার অভিজ্ঞতা। “এক হাঁটু জলের মধ্যে দেখি হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন শু্যটিং দেখতে। দেখে আমি এতটাই আপ্লুত হয়েছিলাম যে চোখ বেয়ে ঝর ঝর করে জল নেমে এসেছিল সে দিন,’’ বলেন অভিনেতা।
আসলে এই মানুষগুলোর কাছে বর্ডার কখনই ভালবাসার ইতি টানতে পারে না। “ভাষা এক, অনুভূতিগুলো একরকম। বিদেশে গেলেও দেখি সেভেন্টি পারসেন্ট যাঁরা বাঙালি রয়েছেন তাঁদের আদি বাড়ি বাংলাদেশ। আমাদের সঙ্গে দেখা হলে ওঁদের উষ্ণতার ছোঁয়া অনুভব করি। একেবারে আপন করে নেয় আমাদের,” বলেন গৌতম।
প্রসেনজিতের মনে পড়ে যায় টরোন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের এক ঘটনা। বলেন, “ওখানকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ এক বাংলাদেশি ট্যাক্সি ড্রাইভার এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ফেস্টিভ্যাল থেকে আমাকে যাতায়াতের জন্য গাড়ি দিলেও সেটা যেন ব্যবহার না-করে আমি ওর গাড়িটাই ব্যবহার করি। ওই ভদ্রলোকের গাড়িটাই ব্যবহার না-করলে দুঃখ পেতেন...।”
বিশ্বজুড়ে এই যে বিশাল বাংলাভাষী দর্শক রয়েছেন তাঁদের কাছে বাংলা ছবির মার্কেটটা খুলে দিতে চান গৌতম-প্রসেনজিৎ। “শুধু হিন্দি-তামিল-মরাঠি নয়। আজকাল পঞ্জাবি ছবিও নিজের মার্কেটটা বাড়াচ্ছে। বিদেশে রিলিজ হচ্ছে এই ছবি। হিন্দি ছবি তো আজ পাকিস্তানেও মুক্তি পাচ্ছে। টলিউডে এখন যা অবস্থা মার্কেটটা না-বাড়ালে কোনও উপায় নেই। ‘মনের মানুষ’ ছবিটা একদিনে বাংলাদেশ আর ভারতে রিলিজ করেছিল। ছবিটা পুরস্কৃত হয়েছিল। আর তার সঙ্গে বহু মানুষ সেটা দেখেছিল,” বলেন প্রসেনজিৎ।
‘মনের মানুষ’য়ের সহ-প্রযোজক ছিলেন বাংলাদেশের হাবিবুর রহমান খান আর ফরিদুর রেজা সাগর। এ ছবির সহ-প্রযোজনা করতে তাঁরাই এগিয়ে আসছেন। “আমরা এখানে ছবি নিয়ে আড্ডা দিচ্ছি শুনে হাবিবভাই বললেন, ‘এত পাসপোর্ট-ভিসার ঝামেলা না-থাকলে আমিও বালিগঞ্জের বাড়িতে গিয়েই আপনাদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম’। মুম্বইয়ে থাকলে তো আজকে সেটা অসুবিধা হত না। কিন্তু ওই এক বর্ডার পারের ঝামেলা। তার জন্য তিরিশ মিনিটের দূরত্বটাও কত বেশি মনে হয়,” বলেন পরিচালক।
আড্ডা শেষে গৌতম আবার ফিরে যান তাঁর ছোটবেলার স্মৃতিতে। “দেশভাগের পরে ঠাকুর্দা কিছুতেই ফরিদপুর ছেড়ে আসতেই চাননি। তখন কলকাতায় এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর কোনও দিন সুস্থ হননি তিনি। আজ এই ছবিটা করতে গিয়ে ঠাকুর্দার একটা কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। উনি বলতেন, ‘জিন্না-নেহরুর পাগলামোটা বেশিদিন টিকবে না রে...’।”
কিন্তু ৬৭ বছর হয়ে গেল। বাস্তবটা আজও পাল্টায়নি।