সাধনা (১৯৪১-২০১৫)
ষাটের দশকের ছোকরা আমরা বলতে পারতাম, দুনিয়া এক দিকে ও সাধনা আর এক দিকে। বলতামও।
তখনকার ছোকরাদের মধ্যে বিয়ে করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ঢুকিয়েছিল তরুণ মজুমদারের ‘বালিকা বধূ’ ছবি। কিন্তু তাদের বিয়ের ইচ্ছে হত একমাত্র সাধনাকে। ওঁর প্রথম ছবির ডিরেক্টর আর কে নায়ারের সঙ্গে বিয়ের পরও আমরা কেউ হাল ছাড়িনি।
ওঁকে ভাল কম্পিটিশন দিতেন ওয়াহিদা (কত বড় অভিনেত্রী), কিন্তু শেষ অবধি সাধনা ‘সাধনাই’। ‘মেরা সায়া’, ‘ওহ কৌন থি’র মতো রোম্যান্টিক থ্রিলারে রহস্যময়ীর ভূমিকার জন্য ‘মিস্ট্রি গার্ল’ তকমা জুটেছিল ঠিকই, কিন্তু ওঁর আসল মিস্ট্রিটা ছিল হাসিতে, চাহনিতে, চলনে-বলনে, পরিধান ছাড়িয়ে ধরা এক অপ্রতিরোধ্য সেক্স অ্যাপিলে।
কয়েকটা দৃশ্যই চরম সাবুদ। ‘রাজকুমার’ ছবিতে গ্রামের রাস্তা ধরে ‘হম হ্যায় রাজকুমার’ গাইতে গাইতে মিছিল করে যাচ্ছেন শাম্মি কপূর। সহসা এক তির এসে পড়ল জুলুসে। শাম্মি, দলবল এবং ছবির দর্শক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল তিরন্দাজকে। গাছের উঁচু ডালে হেলান দিয়ে বসা, ধনুক হাতে, কাঁচুলি পরা, দৃষ্টির ছুরি শানানো নাগিনী কন্যাকে। সাধনা।
চিত্রনাট্যে নায়িকার এমন একটা আবির্ভাব ভারতীয় ছবি আগে দেখেছিল কিনা সন্দেহ। সেই দৃশ্যে কেবল ছবির রাজকুমার নয়, সাধনায় প’টে গেল এক আস্ত জমানা।
আর একটা দৃশ্য — ‘মেরে মেহবুব’য়ে অবিস্মরণীয় গজল দৃশ্য। মেহফিলে রাজেন্দ্রকুমার গাইছেন ‘মেরে মেহবুব তুঝে মেরি মহব্বত কি কসম’ আর দর্শকদের মধ্যে কালো পোশাক ও নিকাবে আপাদমস্তক ঢাকা সাধনা শুনছেন, যেন ওই গান ওঁরই গান। শুধু ওঁরই জন্য গাওয়া হচ্ছে। গাইতে গাইতেও নায়কের দৃষ্টি নিবদ্ধ হচ্ছে ওই দুই চোখে।
এবং রবীন্দ্রনাথের কথায় বলতে হলে (আর রবীন্দ্রনাথের কথাতেই বলতে হবে সাধনার বাঙালি প্রেমিকদের!) ‘‘ওই আঁখি রে! ফিরে ফিরে চেয়ো না, চেয়ো না, ফিরে যাও— কী আর রেখেছ বাকি রে’’, এই ওঠা পড়া ঘটে বুকের ভেতর।
তৃতীয় দৃশ্য ‘আরজু’ ছবির শেষের দিক থেকে। নায়ক রাজেন্দ্রর একটা পা নেই দেখে নায়িকা ছুটল কাঠকাটা করাত মেশিনে পা গলিয়ে দিতে। কাটতে কাটতে করাত এগিয়ে আসছে। নায়িকার পা ছিন্নভিন্ন করবে বলে। আর আমরা দর্শকেরা ভেতরে ভেতরে ছিন্নভিন্ন হচ্ছি। এই সেন্টিমেন্ট থেকে ওই জমানার দর্শক আজও মুক্তি পায়নি। সেন্টিমেন্টটা ঘোরতর হয়েছিল হঠাৎ এক চোখের অসুখে সাধনার সিনেমা ছেড়ে অন্তরালে চলে যাওয়ায়। সাধনার চোখের অসুখ এবং গীতা দত্তের মৃত্যু— সত্তর দশকের প্রথম পাদের দুই মস্ত দাগা বাঙালি জীবনে। রূপে-গুণে-স্টাইলে সাধনা ছিলেন আমাদের অতি নিজস্ব অড্রে হেপবার্ন। চুলের ফ্রিঞ্জ কাট, চাহনির কৌতুক বা বিষণ্ণতা এবং একটা ‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফেনিজ’য়ের নায়িকাসুলভ অধরা মাধুরী।
সাধনা যে কত শক্তিময়ী এবং সম্যক অভিনেত্রী এ নিয়ে দর্শক খুব একটা ভাবার সময় পায়নি সে সময়।
ঈশ্বরও সঙ্গ দিয়েছিলেন সাধনাকে। না হলে বছর দশেকের মধ্যে এমন সব কাহিনি, ভূমিকা ও গান পেলেন নায়িকা যা বলিউডের স্টুডিয়োয় নয়, গাথা হয়েছিল স্বর্গে। ‘তু যাঁহা যাঁহা চলেগা, মেরা সায়া সাথ হোগা’, ‘নয়না বরষে রিমঝিম রিমঝিম’, ‘ঝুমকা গিরা রে’ বা ‘আজি হমসে রুঠকর অব কহাঁ জাইয়েগা’ পরের পর কী ভাবে পড়ে যায় একই ঝুলিতে।
মিস্ট্রি গার্ল আখ্যার জন্যই হয়তো এক সময় আমরা হিচককের ‘টু ক্যাচ আ থিফ’ বা ‘নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট’য়ের নায়িকা গ্রেস কেলির ছায়া দেখতাম সাধনায়। রহস্য ছবির রহস্যময়ী।
বিমল রায় অবশ্য সেই গোড়ার দিকে ‘পরখ’ ছবিতে ওঁকে নূতনয়ের আদলে একেবারে আটপৌরে, ঘরের মেয়ের চেহারায় পর্দায় এনেছিলেন বসন্ত চৌধুরীর বিপরীতে। বসন্ত-র মনে হয়েছিল টিপিক্যাল বম্বে গ্ল্যামারের পেছনে মেয়েটার অজস্র গুণ লুকিয়ে আছে। কয়েক বছরের মধ্যে যা বিস্ফোরিত হল।
গ্রেস কেলির মতো হঠাৎ করে সিনেমা থেকে সরে যাওয়ায় সাধনার চৌম্বক আকর্ষণ আর দুর্বল হয়নি। তখনকার হিন্দি হিরোইনদের মতো মা মাসির রোল বা টিভি সিরিয়ালে ইমেজ খেলো করতে হয়নি। নিজের জীবন থেকে সরে যেন এক অন্য জীবনে প্রবেশ করেছিলেন। খুবই কষ্টে ছিলেন হয়তো চেহারা ও চাহনি হারিয়ে, কিন্তু এই নির্ভীক অবসর ও অপসরণ ওঁকে অন্য মাধুর্য ও মহত্ত্ব দিয়েছিল।
ষাটের দশকে সাধনার টানটা কেমন ছিল দর্শক সমাজে, তা বোঝানো পঞ্চাশ দশকের বিনু মাঁকড় কী ষাটের দশকের পটৌডির ক্রিকেটের টান ব্যাখ্যা করার সামিল। সাফল্যের নজির সব চোখের সামনে আছে। কিন্তু নেই যেটা, তা হল সেই ব্যাখ্যার অতীত ‘কী একটা যেন’, ‘এক্সট্রা সামথিং’, ফরাসিতে বলে ‘ জ্যন সে কোয়া’। জানি না কী।
মধুবালা, মীনাকুমারী, বৈজয়ন্তীমালা, ওয়াহিদা, নূতন দেখার পর কী যে একটা হল সাধনার আবির্ভাবে, তা আজও গুছিয়ে বোঝা গেল না। রহস্যময়ী, রহস্যময়ী থেকেই চলে গেলেন। তাই শেষে ওঁর ছবি দিয়ে ওঁকে নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেল ‘ওহ কৌন থি?’