জয়া আহসান।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস এলে আজকাল আমার কাছে শঙ্খ ঘোষের অতিপরিচিত সেই কবিতার চরণটিই মনে ফিরে ফিরে আসে, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে'। পণ্য, ভোগ আর প্রচার—এ সবের আতিশয্যে এই দিনটির মহিমা যেন ঢাকাই পড়ে গিয়েছে। কী এক উত্তাল আকাঙ্ক্ষা থেকে এই দিনটির শুরু হয়েছিল, আর বাণিজ্যিকরণের ধাক্কায় দিনটি আজ কোথায় এসে পড়েছে!
যেই চেতনা থেকে এই দিনটি শুরু হয়েছিল, সেই চেতনাটি ফিরিয়ে আনা দরকার সবার আগে।
কী সেই চেতনা? ১৫ হাজার নারী সেই ১৯০৮ সালে নিউ ইয়র্কের রাজপথে নেমে এসেছিলেন। কেন? তাঁদের দাবি ছিল, তাঁদের কাজের সময়সীমাটা সহনীয় মাত্রায় নেমে আসুক। মজুরি সামান্য বাড়ুক। তাঁদের ভোটের অধিকার দেওয়া হোক। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় মেয়েরা যে ৪ দিন ধরে ধর্মঘট করেছিলেন, তাঁদের দাবি ছিল সামান্য— ‘রুটি আর শান্তি’। ভাল মতো খেয়াল করলে দেখব, আলাদা করে এ সবে কিন্তু নারীর জন্য বিশেষ কোনও দাবি নেই। এর সবটাই মানুষ হিসেবে বাঁচারই দাবি। ব্যাপারটা তা–ই। নারীর দাবি তো আসলে মানুষ হিসেবে জীবনযাপন করারই দাবি। নারীর এই দাবি সে অর্থে পুরুষের দাবিই বা হবে না কেন? পুরুষদেরও তো নিছক পুরুষ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেই বাঁচতে হবে। তারা যদি নারীর বাঁচার দাবির অংশ থেকে বেশিটা কেড়ে নেয়, তা হলে যে মনুষ্যত্বের মধ্যেই টান পড়ে।
কিন্তু যে দাবির জন্য মেয়েরা এক দিন পথে নেমেছিলেন, এক শতাব্দীর বেশি সময় পেরিয়ে এসেও সে দাবির কতটা পূরণ হল তাঁদের? এখনও যখন পথে–প্রান্তরে কলে–কারখানায় নারী শ্রমিকদের এই একই দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে দেখি, বিষণ্ণ হয়ে ভাবি, সভ্যতা তা হলে কত দূর এগোল? হ্যাঁ, আমাদের মতো সমাজের একটি অংশের কাছে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে, এসেছে কিছুটা আরাম। বড় একটা অংশ তো পড়ে আছে বিভেদের দুর্ভাগ্যজনক একটা রেখার তলায়। ওঁদের বাঁচার দাবি এখনও অপূর্ণ।
এ জন্য বলতে চাই, উদ্যাপনের চাকচিক্যে যেন নারী দিবসের চেতনাটা আমরা হারিয়ে না ফেলি।
‘উদ্যাপনের আগে দরকার কর্তব্য, আমাদের যে যার দিক থেকে।’
আগের কথা দুটোর আভাসই যেন দেখতে পাই আমাদের দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে। এত এত নারীশ্রমিক যে যুক্ত হলেন এখানে, তাতে কী যে যুগান্তকারী একটা বদল ঘটিয়ে দিলেন তাঁরা দেশের অর্থনীতিতে! বিদেশ থেকে যে ডলার আসছে, সেখানে বড় সংখ্যাটাই এ সব দরিদ্র মেয়ের অবদান। তাঁরা বদলাতে এসেছিলেন নিজের জীবন, অথচ পাল্টে দিলেন সারা দেশের জীবনধারা। বিনিময়ে নিজেদের জীবন কতটুকুই বা বদলাতে পারলেন তাঁরা? যৎসামান্য।
মেয়েরা যে ঘরে ঘরে কাজ করছেন; সংসার সামলে, পরিবারের সকলের ভালমন্দ দেখে রেখে, সন্তান মানুষ করে শুধু নিজেদের নয়— পুরো সমাজটাকেই তাঁরা এগিয়ে নিচ্ছেন। খবরে পড়েছিলাম, অর্ধেকের কাছাকাছি নারী ঘরের কাজে যুক্ত, পুরুষেরা ১ শতাংশেরও কম। কী করুণ দৃশ্য! এই আমাদের চারপাশের দেশগুলোর ছবিও তো এর চেয়ে বড় রকমের আলাদা কিছু হওয়ার কারণ নেই। এর হিসেব তো আমরা নিচ্ছি না। এ সব নিয়ে কথা হচ্ছে বিস্তর, কিন্তু কোনও একটা জায়গায় আমাদের হৃদয় সেখান থেকে নিদারুণ ভাবে বিচ্ছিন্ন। সে জন্য কথা হলেও কোনও কাজ হচ্ছে না।
এই যে বৈষম্য, কোভিড–১৯ অতিমারির পরে তা আরও গভীর হয়ে উঠেছে। একটা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, অস্বাভাবিক এই সময়ে মেয়েদের উপরে যৌন নির্যাতন বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। গবেষণা বলছে, নারী আর পুরুষের মধ্যে গত ২৫ বছরে যতটুকু সমতা এসেছিল, এই অতিমারি তা ধুয়ে–মুছে দিয়েছে। গবেষণা বলছে আরও নিষ্ঠুর কথা, আগামী এক শতাব্দীতেও নাকি নারী আর পুরুষের মধ্যে পরিপূর্ণ সাম্য প্রতিষ্ঠার কোনও সম্ভাবনা নেই।
ছবিটি যখন এমনই বিষণ্ণ, রঙিন চশমাটা খুলে তখন সত্যের দিকে সোজা চোখে তাকানো দরকার। উদ্যাপনের আগে দরকার কর্তব্য, আমাদের যে যার দিক থেকে।
‘খবরে পড়েছিলাম, বাংলাদেশের অর্ধেকের কাছাকাছি নারী ঘরের কাজে যুক্ত, পুরুষেরা ১ শতাংশেরও কম।’
আমি এ সব কথা যে বলছি, তার মানে এই নয় যে আমি হতাশ। আমি বরং ভীষণ ভাবে আশাবাদী। কারণ নিজের জীবনে আমি দেখেছি, পথ সব সময়েই এবড়ো–খেবড়োই থাকে। সেই পথ ভেঙেই এগিয়ে যেতে হয়। ইতিহাসে সে ভাবেই আমরা এগিয়েছি। তবে এর জন্য দরকার হয় নিরন্তর স্বপ্ন, প্রতিজ্ঞা, অধ্যবসায়। প্রয়োজন নিজের শক্তির উপরে আস্থা রাখার।
আর রবীন্দ্রনাথের এই কথায় তো আমার প্রবল আস্থা যে, ‘মানুষের উপরে বিশ্বাস হারানো পাপ’। মানুষই পারে অসম্ভবকে সম্ভব করতে। সেখানে সবাইকে নিয়ে বৃহত্তর জীবনে সাধ্যমতো আমাদের যুক্ত হতে হয়, ভালোবেসে হাত বাড়িয়ে দিতে হয়। এটা শুধু মানুষ হিসেবে আমাদের কর্তব্য নয়, মানুষ হিসেবে আমাদের নিয়তি।
‘উদ্যাপনের চাকচিক্যে যেন নারী দিবসের চেতনাটা আমরা হারিয়ে না ফেলি।’