তপন সিংহের সঙ্গে শিল্পী
দিলীপ কুমারকে আমি জেনেছি আমার স্বামী স্বরূপ দত্তর (দেবু) মাধ্যমে। ‘সাগিনা মাহাতো’ ছবিতে দেবু কাজ করেছিল দিলীপসাবের সঙ্গে। সেই শুরু। উনি দেবুকে এত ভালবেসে ফেলেছিলেন যে, ছবি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও সম্পর্কটা থেকে গিয়েছিল। ’৭০-’৮০র দশকে দেবু যখনই মুম্বই যেত দিলীপসাবের সঙ্গে দেখা করা একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। দেখা না করলে উনি খুব রাগ করতেন। দু’জনের এই পারস্পরিক ভালবাসার পিছনে একটা কারণ অবশ্যই ক্রিকেট। ক্রিকেটপাগল লোক ছিলেন দিলীপ কুমার আর দেবুও ভাল ক্রিকেট খেলত। সাগিনার আউটডোর শুটিংয়ে তপনদা শট রেডি করে অপেক্ষা করছেন। দিলীপসাব বলেই যাচ্ছেন “এই আসছি”। দেবু তো ভয় পাচ্ছে আলো পড়ে আসছে। আরও দেরি হলে তপনদা শট নিতে পারবেন না। কিন্তু দিলীপসাবকে থামাবে কে!
‘সাগিনা মাহাতো’র নব্বই ভাগ শুটিং হয়েছিল আউটডোরে। কার্শিয়ং-এর গয়াবাড়িতে। গুমটি টি এস্টেট, তিনধারিয়া লোকো শেড এই সব জায়গায়। ইলা পালচৌধুরীর বিরাট বাংলো বাড়িতে সবাই একসঙ্গে থাকতেন। দিলীপ কুমার, সায়রা বানু একটা ঘরে। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, পলাশবাবু একটা ঘরে। একটা আউট হাউস ছিল সেখানে তপনদা, অরুন্ধতী দেবী ও ওঁদের ছেলে রানা। একটা বিশাল লাইব্রেরি ঘরে টানা বিছানা করে বাকি সবাই।
গয়াবাড়ির আউটডোরে দিলীপসাব দিনে ১৮টা আপেল খেতেন। সেই নিয়ে ইউনিটের সকলের বিস্ময় ছিল। চিকেন তন্দুরি খেতেও খুব ভালবাসতেন। তখন কলকাতায় তন্দুরি মেশিন পাওয়া যেত না বলে মুম্বই থেকে আনানো হয়েছিল। ইউনিটের ঠাকুর বনমালীর তত্ত্বাবধানে ‘লঙ্গর’ চলত, সকলের জন্য এক খাবার।
ছবির ইনডোরের কাজ হয়েছিল নিউ থিয়েটার্স ২ নং স্টুডিয়োয়। সেখানে চমৎকার একটা বস্তির সেট তৈরি করেছিলেন শিল্প নির্দেশক বিমল মুখোপাধ্যায় দুটো ফ্লোর জুড়ে। বিচারসভার পুরো দৃশ্যটার শুটিং হয়েছিল সেখানে। তার আগের অংশটাও, যেখানে কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়কে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, আর রোমি হাউ হাউ করে কাঁদছেন। সায়রা ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
ইনডোর শুটিংয়ের সময়ে একটা মজার ঘটনা ঘটল। কলকাতার ইনডোর শুটিংয়ের সময়ে ওঁর মনে হল, তেমন ভাবে শারীরচর্চা করা হচ্ছে না। উনি অনিল চট্টোপাধ্যায়কে ধরলেন, টেনিস বা ব্যাডমিন্টন যা হোক একটা খেলার ব্যবস্থা করে দিতে। নিউ থিয়েটার্সে ১নং স্টুডিয়োয় একটা টেনিস কোর্ট ছিল। সেখানে অনিল চট্টোপাধ্যায়, বংশী চন্দ্রগুপ্তরা রোজ টেনিস খেলতেন। কিন্তু দিলীপ কুমার বললেন ওঁর জন্য একজন ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ধরে আনতে যাঁর সঙ্গে উনি খেলবেন। অনিলবাবু অনুরোধ করলেন দীপা চট্টোপাধ্যায়কে (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী) খেলার জন্য। কিন্তু দীপা রাজি নন। উনি ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন বলে কথা। শেষে অনেক কাকুতি মিনতির পর দীপা রাজি হলেন। কী কাণ্ড! খেলায় দিলীপসাব থ্রি-নিল-এ হারিয়ে দিলেন দীপাকে!
অথচ মানুষটার মধ্যে অহমিকা ছিল না। বিরাট মাপের একজন অভিনেতা। সাগিনা চরিত্রটাকে খুব ভালবেসে ফেলেছিলেন। মন প্রাণ ঢেলে অভিনয় করেছিলেন। ওঁর অভিনীত সেরা চরিত্রগুলির একটি হল সাগিনা। আউটডোরে ছবির কাহিনিকার গৌরকিশোর ঘোষ (রূপদর্শী) আসতেন। তপনদার খুব বন্ধু ছিলেন গৌরদা। দিলীপসাব ওঁর সঙ্গে বসে নানা বিষয় নিয়ে গল্প করতেন। শুটিংয়ের আগে কলকাতায় ওয়ার্কশপ হয়েছিল। সেখানেও দিলীপসাব কত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতেন। এক বছর বাদে তৈরি হয়েছিল ছবির হিন্দি ভার্শন। সহ-প্রযোজক ছিলেন দিলীপসাব।
‘সাগিনা মাহাতো’ খুব হিট হয়েছিল। ২৫ সপ্তাহ পার করার পর একটা অনুষ্ঠান হল। দেবু কলকাতায় না থাকার কারণে আমাকে যেতে হয়েছিল মেমেন্টো নিতে। তখন উনি এসেছিলেন কি না মনে নেই। তবে নানা কারণে যেমন ছবি রিলিজ়, প্রদর্শনী ক্রিকেট ম্যাচ ইত্যাদির জন্য তাঁর কলকাতায় আসা যাওয়া লেগেই থাকত। নয়ের দশকে বিএফজে পুরস্কার নিতে এসে দিলীপসাব ফোন করেছিলেন দেবুকে। বাঙালি কায়দায় মাছের ঝোল খেতে চেয়েছিলেন। দেবু ওঁকে বালিগঞ্জের নামকরা এক রেস্তরাঁয় বাঙালি খাবার খাইয়েছিল। খুব হৃদয়বান ও শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। ওঁর বন্ধুমহল জুড়ে ছিল কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, ডাক্তার। স্তাবকদের সঙ্গে কখনও ঘুরতেন না। অসাধারণ গাইতে পারতেন। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম ছবি ‘মুসাফির’-এর টাইটেল ট্র্যাকে ওঁর গাওয়া গান আছে। গায়কের নামের জায়গায় লেখা আছে ইউসুফ খান। সলিল চৌধুরীর সুরে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে গানটি হল ‘অব লাগি নাহি ছুঁতে রামা...’
দিলীপসাব দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন। ওঁর চলে যাওয়া এক অপূরণীয় ক্ষতি।
অনুলিখন