rituparna sengupta

আর রেস নয়, আমি বাঁচতে চাই: ঋতুপর্ণা

লকডাউনের সিঙ্গাপুরে বসে রোজনামচায় ডুব দিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২০ ২০:০৯
Share:

সপরিবারে ঋতুপর্ণা।

লকডাউনের সিঙ্গাপুরে বসে রোজনামচায় ডুব দিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত

Advertisement

আমি এখন সিঙ্গাপুরের বাড়িতে গৃহবন্দি। সকালে ঘুম ভাঙল দেরিতে। রাতে ছবি দেখছি, বই পড়ছি, নানা চিন্তা আসছে, শুতে শুতে বেশ দেরি হচ্ছে। সকালে উঠি রোদের আলো পেয়ে। বিছানা থেকেই এত সুন্দর আকাশ দেখা যায়! আগে ব্যস্ততার জন্য এ ভাবে আকাশ দেখেছি কি?

ঘর থেকেই বারান্দা আর বারান্দার কাছেই আকাশ! ওখানেই কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। প্রাণভরে সূর্যের রোদ নিই। এখন আর ভাবি না সানস্ক্রিন লাগাতে হবে। গ্রিন টি-তে চুমুক আর সূর্যের আলোয় স্নান, খুব দরকার আমাদের জন্য।

Advertisement

সকাল ১০টা

আজ ঠিক করেছিলাম মেয়ের ওয়ার্ড্রোব গুছিয়ে রাখব। সকাল থেকে চার বার ডেকেছি গাজুকে। তিনি উঠছেন না। আমার ছেলে আমার মেয়েকে একটা নাম দিয়েছে, ‘ডি কিউ’ মানে ড্রামা কুইন!

সকাল সাড়ে ১০টা

অনেক কষ্টে তুলেছি। সে তো দেখছি ঘর গুছোতে রাজি নয়। ওকে নিয়ে অবশেষে বসেছি। কত কী যে আছে ওর ঘরে! পুতুল, সাজের জিনিস, খেলার জিনিস। নিজেই কতগুলো জামা দিয়ে আমায় বলল, মা এগুলো আর পরব না, কাউকে দিয়ে দিয়ো। আমি কোনও কিছুই নষ্ট করার পক্ষে নই। ও বলল, প্রবীরদা, দেবাশিসদার মেয়েকে দিয়ে দিয়ো। ভালই লাগল ওর কথা শুনে। কাজ করতে করতে দু’জনেই ক্লান্ত। আইপ্যাড নিয়ে বসল। ইদানীং ও নোরা ফ্যাতেহি আলির নাচ নিয়ে মুগ্ধ। আমাকে বলল, দেখ মা, এই নাচটা দেখ, এই মুভসগুলো দেখ। কত কি জানে না অরা! কোরিয়ান ডান্স দেখিয়ে দিল। তার পর বলল, মা তুমি যে হেয়ার স্ট্রেটনার কিনেছ, চল সেটা ট্রাই কর আমি ভিডিয়ো করি। আমি বললাম, বাপ রে, এত কিছু করে উঠতে পারব না এখন।

সাড়ে ১২টা

এ বার ছেলেকে তোলার পালা। ছেলে অনেক রাতে শোয়। ওমা, গিয়ে দেখি গিয়ে উঠে গিয়েছে, বাবার সঙ্গে কম্পিউটার সামনে রেখে, গম্ভীর আলোচনায় বসেছে। কোথায় পড়তে যাবে? কী করবে? সঞ্জয় আমাকে বলল চা করে আনতে। আমার অনেক কিছুই ওর অপছন্দ, জানি আমি। তবে মনের মতো চা-টা বোধহয় আজও আমার কাছ থেকে পেলে ওর ভাল লাগে। অনেক বছর হয়ে গেল আমাদের, যত পুরনোই হই না কেন আমরা, বউয়ের হাতের চা-টা সঞ্জয়ের আজও নতুন লাগে। আমি সঞ্জয়ের ফরমায়েশি চা বানালাম। দেখলাম, সেটা খেয়ে ও চাঙ্গা হল। শুধু তাই নয়, বলল, আমার হাতের রান্না খাবে সবাই। আর গাজু বলল, ‘মা ডিম খাব।’ আমি ডিমের একটা স্পেশাল রান্না করি। কিন্তু এ বার একটু বদলালাম। রোল করলাম। সবাই বলছিল, তুমি পারবে না। আমি বললাম, দেখি না…

দুপুর ১টা

রোল বানাতে বানাতে আমার হঠাৎ পুরনো দিনের রাজা বসন্ত রায় রোডের বাড়ির জেসিবওর রোলের দোকানের গন্ধ ভেসে উঠল। আহা! সেই সবজেটে গ্রিন চিলি সস! পেয়াজ, লঙ্কা, লেবুর রস দিয়ে ডিমটাকে ফটাফট করে ওই ছেলেগুলো যে ভাবে রোল বানাত, সেটা দেখার জন্যও আমরা ভিড় করতাম। আমিও ধাঁই ধাঁই করে ডিম ফেলে পরোটার ওপর দিয়ে রোল বানাতে চেষ্টা করলাম। স্যালাড বানালাম। রেড স্যালাড। তাতে লেবুর রস, গোলমরিচ, রসুন দিলাম। এখন এই সময়ে রোজের খাবারের মধ্যে লেবুর রস, গোলমরিচ, রসুন রাখার চেষ্টা করছি আমি। স্যালাডে টম্যাটো, চেরি, চিজ গ্রেড করলাম। গাজু আমায় হেল্প করল। তার পরে বলল, ‘মা আমি ম্যাশ মেলজ রোস্ট করে খাব?’ আমি তো জানি না সেটা কী! ওমা, দিব্যি দেখলাম ম্যাশ মেলোজ রোস্ট করল মেয়ে। কেমন দিব্যি বড় হয়ে যাচ্ছে!

দুপুর ২টো

আমাদের লাঞ্চ হল। আগের দিনের কিছু লেফটওভার ছিল। আমি বাড়িতে নিয়ম করেছি, খাবার নষ্ট করা চলবে না। এখন এত মানুষ ঠিক করে খেতেই পাচ্ছে না।

পরিস্থিতি সকলের জন্য সঙ্গিন। সঞ্জয়কে দেখছি সারা ক্ষণ ফোনে। দেশের অর্থনীতি যে ভাবে ওঠানামা করছে। ও বাড়িতে বসে সারা ক্ষণ কাজ করছে। আমি ওকে রেসপেক্ট করি। ডিস্টার্ব করতে চাই না। সমানেই আমেরিকায় ভিডিয়ো কল চলছে। মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলছে, ‘‘কি, তোমার যা ব্যস্ত শিডিউল, এখানে কি ক্লস্ট্রোফোবিক লাগছে?’ সঞ্জয়ের প্রশ্নটা ঘুরছিল মনে মনে। নাহ্, আমার ভাল লাগছে! পরিস্থিতি খুব খারাপ জানি। কিন্তু আমি? আমরা? কবেই বা আমি আমার মেয়ের সঙ্গে স্ক্র্যাবল করেছি? চার জন একসঙ্গে হতে তো চাই। কবে শেষ হয়েছি?

সন্ধে ৬টা

ঠিক করলাম, একসঙ্গে বসে স্ক্র্যাবল করব আমরা চার জন। চায়ের কাপ নিয়ে বসলাম। ছেলেকে অনেক কষ্ট করে বের করে আনলাম ঘর থেকে। বললাম, আমাদের সঙ্গে আজ খেলতেই হবে। আমার ছেলে খুব ভাল কার্ডস গেম খেলে। ও আমায় শিখিয়ে দিল। খুব আনন্দ করে খেললাম। আসলে, একে অন্যকে সময়টা দিতে হবে, তবেই চিনব জানব আমরা, কাছাকাছি আসব। খেলা শেষে উঠতে যাব, ছেলে বলল, ‘মা আমার সঙ্গে মিনিট পনেরো ওয়ার্কআউট করবে চল।’ ছেলের সঙ্গে পনেরো মিনিট ওয়ার্কআউট হল। ওমা, দেখি সঞ্জয়ও যোগ দিল। ছেলে আবার বলল, ‘মা, তোমায় আরও ভাল করতে হবে। রোজ করবে আমার সঙ্গে।’ মনে রেখে দেব এই মুহূর্তদের।

রাত ৮টা

গাজু ডান্স দেখাল আমায়। ওর ভীষণ নাচের শখ। আমি বললাম, চল আজ মুভমেন্ট ছাড়া এক্সপ্রেশন ঠিক করে দিই তোমার।

রাত সাড়ে ৯টা

বই পড়ছিলাম। আচমকা শুনি সুরের আওয়াজ। সঞ্জয় সরোদ নিয়ে বসেছে। তার পর খেয়াল করলাম, ও গাজুকে ছোট সরোদ নিয়ে আসতে বলল। গাজু নিমরাজি। তবু গিয়ে বসল বাবার কাছে। শুরু হল বাবা-মেয়ের সরোদের আলাপ। সুরে ভরে উঠল বাড়িটা। এমন মুহূর্ত শেষ কবে তৈরি হয়েছিল আমার বাড়িতে? হয়েছিল কি? আমার বিশ্বাস, এখন অনেক বাড়িতেই এমন না হওয়া অনেক কিছু হয়ে যাচ্ছে, যা হয়তো আগে হয়নি। আমার বান্ধবী যেমন কুইজ পাঠাল, সল্ভ করলাম। অনেক চাওয়ার জটিলতায় আমরা সিম্পল লিভিং ভুলে যাচ্ছি। এর মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে একে অন্যের প্রতি টান! ভাবছিলাম, কোনও দিন আমার ছেলে বলবে, ‘চল মা, একসঙ্গে ওয়ার্কআউট করি।’ রাত হয়ে আসছে। জানতে ইচ্ছে করছে বাড়িতে আত্মীয়েরা কেমন আছে? মা? ভাই? শাশুড়ি? সবাই ভাল আছে তো? নাহ্, আর মনে হয় না শুধু নিজেরাই ভাল থাকি…

রাত ১০টা

ডিনার টেবিলে আমরা সবাই। একসঙ্গে চারটে চেয়ার তো ভর্তি হয়নি কত দিন! আজ সব ভরা! আজ মেনু সুপ আর পাস্তা। জাঁকজমকের খাওয়া এখন কেউ আমরা খাচ্ছি না।

রাত ১১টা

খাওয়া শেষ। এ সময়ে আমি নেটফ্লিক্স দেখি। আজ ছেলের হুকুমে নেটফ্লিক্স বন্ধ। ছেলে এফ ওয়ান ফর্মুলার কার রেস দেখাবেই আমাকে। দেখছিলাম। বাবা আর ছেলে গাড়ির স্পিড নিয়ে কথা বলছে। স্পিড শুনতে শুনতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল… কথাগুলো ব্লার হতে লাগল… ঘুমিয়ে পড়লাম। দেখি সঞ্জয় ডাকছে, বলছে ঘরে শুতে। ও বলল, ‘রেস শেষ হয়ে গিয়েছে!’ আচ্ছা, এত স্পিড দিয়ে কী হবে? স্পিডেও ব্রেক লাগাতে হয়। আজ যেমন স্পিড বন্ধ। রেস করতে করতে আমরা বড্ড বড় রেসে ঢুকে গিয়েছি। আর এখন আমি রেস করতে চাই না।

আমি বাঁচতে চাই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement