পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।
লকডাউনে বাড়িতে বসে ডায়েরি লিখলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়
সকাল ৮টা
ঘুম ভাঙল। আমার বাড়িতে এখন থাকেন রিঙ্কু ও তাঁর মেয়ে। এই সময়ে লকডাউনের জন্য বাড়িতে আছে রিঙ্কুর বোন আর তার ছোট্ট বাচ্চা। এখন এঁরা আমার বাড়ির সব দিক সামলান। এঁরাই আমার পরিবার। আর আছেন ‘কাকা’। উনি আমার আগের বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড ছিলেন। আমি নতুন বাড়িতে আসার সময় বলেছিলেন উনি আমার সঙ্গে আসতে চান। উনিও তাই আমার পরিবারের অঙ্গ। ওঁদের সকলের জন্য বাড়ির কোনও কাজ আমায় করতে হচ্ছে না। ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজে চোখ বোলাই। তার পর কিছু ক্ষণ ওই রিঙ্কুর বোনের বাচ্চাটার সঙ্গে সময় কাটে।
সকাল ৯টা
এখন ব্রেকফাস্টে ফল খাচ্ছি বেশি। ভিটামিন সি যে ফলে আছে। এই সংক্রমণের সঙ্গে ইমিউনিটির কথা তো বার বার বলা হচ্ছে। কত কী-ই তো সেই কবে থেকে বার বার বলা হয়েছে! কে শুনেছে! আমি পরিবেশ সচেতন বলেই আমার মনে হয়েছে প্রকৃতি অনেক সহ্যের পর এ বার প্রতিশোধ নিল। কাউকে বলে বোঝান যায় না জলে প্লাস্টিক ফেলো না! অনেক হয়েছে! পৃথিবী যেন আমার বাবার সম্পত্তি। আচ্ছা, বাবার সম্পত্তি হলে তাতেও তো যত্নের কোনও লক্ষণ নেই! সত্যি মনে হয় এ বার ঠাসিয়ে চড় মেরেছে সকলকে। প্রকৃতি বলছে, ভাই শুধরে যা!
এ বার ছবি দেখব।
সকাল ১০টা
ইদানীং অনেক ছবি দেখা হচ্ছে। ‘প্যারাসাইট’ দেখলাম। ছবিটা ভাল। তবে এই ধরনের সোশ্যাল স্যাটায়ার আগেও দেখেছি আমি। এটাই প্রথম দেখছি, এমনটাও নয়। আর একটা ছবি দেখলাম, ‘প্ল্যাটফর্ম’। আমার মনে হয় এই সময়ে সকলের এই ছবি দেখা উচিত। ‘হান্টারস’ বলে সিরিজটা শেষ করলাম। ‘টেস্ট’ বলে সিরিজ দেখলাম। হিন্দি সিরিজ শেষ করেছি দু’দিনে, ‘অসুর’।
দুপুর ১টা
এ বার এক্সারসাইজ করব। এক ঘণ্টা চলবে। তার পর লাঞ্চ। শুনছি, মানুষের বেরনো নিয়ে চারিদিক সরগরম। আমাদের মতো গরিব দেশে যেখানে বস্তি এলাকায় এক ঘরে দশ জন মানুষ থাকে সেখানে তো অর্ধেক লোক রাস্তায় শোয়। তারা আর কী করবে? তারা এমনিতেই বাড়িতে থাকতে পারে না। তাই তারা অনেক সময় মন্দির, মসজিদেও যাচ্ছে। সকলের বড় বাড়ি, এক ঘরে ইচ্ছে না হলে বারান্দা, অন্য ঘর আছে? তবু বলব, এই অবস্থাতেও অনেকটাই কাজ হচ্ছে। আর যেটুকু হচ্ছে না সেটা নিয়তির উপর ছাড়তে হবে। দিল্লি থেকে দিনমজুররা উত্তরপ্রদেশে ফিরছে। তারা রাস্তায় আছে এখন। তারা কী ভাবে হাইজিন মেনটেন করবে? আমাদের মতো প্রিভিলেজ ক্লাসের পক্ষে এই সমালোচনা সহজ যা বাস্তবে পুরোপুরি সম্ভব নয়।
দুপুর ৩টে
সকালে ছবি দেখলে দুপুরে বই পড়ছি। সেবাস্টিয়ান অরটিজের ‘ঘোস্টস অব ক্যালকাটা’ পড়ছি, আর তেহমিমা আনমের ‘গোল্ডেন এজ’। মাঝে মাঝে উল্টোটাও হচ্ছে।
বিকেল সাড়ে ৫টা
নিজের লেখায় মন দেওয়ার চেষ্টা করছি। আইডিয়া লিখে রাখছি। কিছু নোটস নিয়ে রাখছি। আমাদের কয়েক জনের একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। রাজ, শুভশ্রী, রুদ্র, পদ্মনাভ, আবীর, আমি। এই গ্রুপে টুকটাক কথা চলতেই থাকে। তবে ইকা-র জন্য হঠাৎ হঠাৎ চিন্তা হচ্ছে!
রাত ৮টা
ফোনে কথা হল ইকা-র সঙ্গে। জুন অবধি ওকে নেদারল্যান্ডসেই থাকতে হবে। ফোনে কথা বলে বুঝি, ও অত টেনসড নয়। আসলে ডাক্তার হিসেবে ওকে রোজ বেরতে হয়। কাজের মধ্যে থাকে। ওর থেকে ওকে নিয়ে আমার বেশি চিন্তা হয়। বন্ধুদের সঙ্গেও এই সময়টা কথা হয়। অফিসের লোকজন বা যাদের কিছু লিখতে দিয়েছি তাদের সঙ্গে এক-আধ বার ভিডিয়ো কল করি।
আজ পাওলির সঙ্গেও বেশ কিছু ক্ষণ মেসেজে কথা হল। বেশ কয়েক দিন আগে অনির্বাণের সঙ্গেও অনেক ক্ষণ কথা হল। যাই, এ বার আমার নিজের সময়...
রাত ৯টা
জানি না কেন এই সময় গিটার নিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সুর বের করে আনতে বেশ লাগে। মনে হয় নিজের সঙ্গে থাকছি। গান গাওয়ার চেয়ে গিটার বাজাতে অনেক বেশি ভাল লাগে আমার। অনেক সময় পেরিয়ে যায়। শুতে শুতে রাত ১২টা। ইকা সাবধানে থাকুক...