ওয়েব সিরিজ: ব্যোমকেশ
আভিনয়: অনির্বাণ ভট্টাচার্য, ঋদ্ধিমা ঘোষ, সুব্রত দত্ত প্রমুখ
পরিচালক: সৌমিক হালদার
বাংলায় রহস্য সিরিজ চিত্রায়িত করার প্রথম বাধাটাই হল, এই ভাষায় রচিত রহস্য কাহিনির অপ্রতুলতা। মোটামুটি ভাবে ওয়াকিবহাল আম বাঙালিকে গোয়েন্দা কাহিনি নিয়ে দু’-পাঁচ কথা আওড়াতে দিলে তা ব্যোমকেশ ও ফেলুদার মধ্যে ঘুরপাক খায়। এই দুই গোয়েন্দার মধ্যে কোনও তুলনাই আসতে পারে না। ফেলুদা ইয়ং-অ্যাডাল্ট নায়ক আর ব্যোমকেশ পরিপূর্ণ প্রাপ্তমনস্ক পাঠকের খোরাক। বাকি কেউ, যথা পরাশর বর্মা, অনুকূল বর্মা প্রমুখ বড় আকারের পাঠকপ্রিয়তা পাননি আর বাকিরা অর্থাৎ গন্ডালু বা হুকাকাশি, জয়ন্ত-মানিক প্রমুখ নেহাতই বালখিল্য হিসেবে পরিগণিত হয়ে লোকস্মৃতির ঘোর ঘোলাজলে লা-পতা হয়েছেন।
থেকে গিয়েছেন কেবল ব্যোমকেশ। টিভি সিরিয়াল, বড় পর্দা ইত্যাদি পেরতে পেরতে ব্যোমকেশ এখন মুঠো পর্দায়। ওয়েব সিরিজ হিসেবেও এই মুহূর্তে ব্যোমকেশের জনপ্রিয়তার পারদ বেশ উপরের দিকেই। নয় নয় করে পাঁচ নম্বর সিজনে পা দিল হইচই-এর ওয়েব-ধারাবাহিক। সৌমিক হালদারের পরিচালনায় সিজন ফাইভে ব্যোমকেশ হিসেবে অনির্বাণ ভট্টাচার্য উপস্থিত থাকলেও বদলে গিয়েছে অজিত। সেই ভূমিকায় এবারে সুপ্রভাত দাস। ফলে পূর্বতন সিজনের চাইতে এখানে কিছুটা স্বাদবদল তো ঘটেছেই।
আরও পড়ুন: ‘সিম্বা’-র গানে এ বার নাচলেন নিক-প্রিয়ঙ্কা
স্বাদবদল ঘটেছে অন্যত্রও। সিজন ফাইভে যে দু’টি ব্যোমকেশ-কাহিনিকে একত্র করা হয়েছে, তাদের ‘মাইনর ব্যোমকেশ’ বলে ধরা হয়। ‘খুঁজি খুঁজি নারি’ আর ‘দুষ্টচক্র’—এই দুই কাহিনিকে একীভূত করে নির্মিত হয়েছে সিজন ফাইভ। এই একীকরণের ব্যাপারে দু’-চার কথা বলার আছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলায় ব্যোমকেশ কাহিনির এত বেশি চিত্ররূপ ঘটে গিয়েছে যে, ‘নতুন’ কিছু করে দেখানো দুরূহ। এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, কিছুদিন আগে ‘বিদায় ব্যোমকেশ’ নামে একটি ছবি বাজারে আসে, যা শরদিন্দু-লিখিত কোনও কাহিনি নয়। শরদিন্দুর রচনাকে এক্সটেন্ড করে লিখিত চিত্রনাট্য-ভিত্তিক ফ্র্যাঞ্চাইজি বলা যেতে পারে। কিন্তু তাতে ব্যোমকেশ-চিত্রায়নের নবীকরণ কি ঘটেছিল?মনে হয় না। পশ্চিমে আজও শার্লক হোমস লেখা হয়, নবীন লেখকদের হোমস-কাহিনি নিয়ে সিনেমা-সিরিজও হয়। কিন্তু বাংলা সেই শরদিন্দু-কাহিনির উপরে নির্ভরতা থেকে বেরতে পারেনি, তার প্রমাণ এই ওয়েব সিরিজ। দুই ‘মাইনর’ব্যোমকেশ-কাহিনিকে একাকার করে একটা ‘মেজর’ রূপদানের প্রচেষ্টা এই সিরিজের পরিচালক সৌমিক হালদার করেছেন। আর সেখানেই এই সিজনের নতুনত্ব।
সত্যবতী ও ব্যোমকেশের চরিত্রে ঋদ্ধিমা ঘোষ এবং অনির্বাণ ভট্টাচার্য
‘খুঁজি খুঁজি নারি’ আর ‘দুষ্টচক্র’ এই অর্থেই ‘মাইনর’ যে, এই কাহিনি দু’টিতে ‘রক্তের দাগ’ অথবা ‘আদিম রিপু’-র মতো মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা নেই, ‘দুর্গরহস্য’ বা ‘চিড়িয়াখানা’-র মতো বিস্তার নেই। ফ্রয়েডপ্রিয় শরদিন্দুকে এই দুই কাহিনিতে পাওয়া যায় না। কাহিনি হিসেবে এ দু’টি অনেক বেশি বুদ্ধি-নির্ভর। তার মধ্যে আবার ‘খুঁজি খুঁজি নারি’-তে রহস্য থাকলেও ক্রাইম নেই। এই দুই কাহিনিকে একত্র করতে এবং সেই সঙ্গে একটা বিস্তার দিতে পরিচালককে নজর দিতে হয়েছে পটভূমিকার উপরে। শরদিন্দুর একনিষ্ঠ পাঠক মাত্রেই জানেন, এই দুই কাহিনি ব্যোমকেশের কেরিয়ারের শেষার্ধের। দেশ তখন স্বাধীন। ব্যোমকেশ তখন অনেক বেশি পরিণত। কিন্তু দুই কাহিনিকে এক সূত্রে গাঁথতে গিয়ে পরিচালক নিয়ে এসেছেন ১৯৪৩-এর মন্বন্তরকে। ব্যোমকেশ কাহিনিতে রাজনৈতিক প্রেক্ষিতের এই অবতারণা পরিচালকের সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ খাড়া করেছে, সন্দেহ নেই। একে দুই ভিন্নধর্মী কাহিনির একীকরণ, তার উপরে রাজনৈতিক ডাইমেনশনকে তার সঙ্গে ফিট করানো, রীতিমতো শক্ত কাজ। এই সিজনের পরিচালক সৌমিক হালদার সেই চেষ্টাটা ঐকান্তিক ভাবেই করেছেন, বলা যায়।
আরও পড়ুন: টুইঙ্কলের ‘কুকীর্তি’ ফাঁস, রেগে গেলেন অক্ষয়
রহস্য-ছবির কাহিনি নিয়ে ঘণ্ট পাকিয়ে স্পয়লার দিতে চাইছি না। কিন্তু এটুকু না বললেই নয় যে, যে আঠাগুলি দিয়ে এই কাহিনি দু’টিকে জোড়া হয়েছে, তার সবক’টি খুব জোরদার নয়। যেমন,‘খুঁজি খুঁজি নারি’-র হেঁয়ালিপ্রিয় সুরসিক রামেশ্বরবাবুর পুত্র কুশেশ্বর যে কারণে ‘দুষ্টচক্র’-র বিশু পালের খপ্পরে গিয়ে পড়ে, তার বিশদ রামেশ্বরবাবুর জানার কথা নয়। আর বিশু পালের সঙ্গে রামেশ্বরবাবুর সম্পর্কটাও কেমন জোড়াতালি-মার্কা বলে বোধ হয়। কেন রামেশ্বরবাবু বিশু পালকে নববর্ষে চিঠি লিখবেন, তার কোনও দৃঢ় কারণ এখানে খুঁজে পাওয়া গেল না।
ঋদ্ধিমা ঘোষ
তবে এ সবই বাহ্য। রাষ্ট্রিক গোলযোগের কালে যে ক্রাইম এক ভিন্ন চেহারা পরিগ্রহ করে, সেই ব্যাপারটিকেই তুলে ধরতে চেয়েছে এই সিজন। ব্যক্তিগত ক্রাইম আর রাজনৈতিক কারণে করা নৈর্ব্যক্তিক ‘অপরাধ’কোথায় পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হতে পারে, সেটা দেখানোর ঐকান্তিক চেষ্টা এখানে পরিচালক করেছেন। দেশ যখন সঙ্কটাপন্ন, সেই সময়ে গণনৈতিকতারও যে বদল ঘটে, তা শরদিন্দুও বেশ কিছু লেখায় দেখিয়েছেন। ’৪৩-এর দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষিতে তাই একদিকে যেমন তেজারতি কারবারির মজুতদার হয়ে ওঠা সম্ভব, তেমনই কোনও বিপ্লবীর আদর্শভ্রষ্ট হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। এই টানাপড়েনটাই এই সিজনের প্রাণভ্রমরা।
আরও পড়ুন: আমার মায়ের গালে বাবার অফিসের ট্রেসের থাপ্পড়: তাপসী পান্নু
দুর্ভিক্ষের ক্যানভাসে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যোমকেশ আদ্যন্ত মানবিক, যে মানবিকতা দেখা গিয়েছিল ‘আদিম রিপু’-র অন্তিম পর্বে। ব্যোমকেশ চরিত্রের এই দিকটিকে তুলে ধরে পরিচালক একটা অন্য মাত্রা আনতে চেয়েছেন। আর সেই প্রচেষ্টার রূপদানে অভিনেতা অনির্বাণ যথেষ্ট সফল। কিন্তু নতুন অজিত জায়গায় জায়গায় একটু আড়ষ্ট। যদিও চিত্রনাট্য অজিতকে নেহাত লেজুড় হিসেবে দেখাতে চায়নি। অনেক সময়ে লেখকই গোয়েন্দাকে তৈরি করে—এই ধাঁচের সংলাপ অজিতকে একটা স্বাধীনতার স্কোপ দেয় ঠিকই। কিন্তু সেই স্কোপটির প্রতি জাস্টিস করতে হলে যে পরিসরগুলি প্রয়োজন ছিল, সেগুলির দেখা মেলে না এই সিজনে। আশা করা যায়, পরের সিজনে সেই ভূমিকায় অজিতকে দেখা যাবে। বিশু পালের ভূমিকায় রাজর্ষি দে সাবলীল। কিন্তু কয়েক ক্ষেত্রে তাঁকে খানিকটা অতি-আরোপ আনতে হয়েছে। একটু পরিশীলন ঘটলে আমরা ভাল ভিলেন পেতেই পারি তাঁর কাছ থেকে।
অজিতের চরিত্রে এ বার নতুন মুখ সুব্রত দত্ত, সঙ্গে ঋদ্ধিমা ঘোষ
ব্যোমকেশের সিজন ফাইভ কি ডিটেকটিভ কাহিনি থেকে নিও-ন্যর আখ্যানের দিকে মুখ ফেরাল, যেখানে সামাজিক উপাখ্যান আর রহস্য হাতে হাত দিয়ে চলবে? সুইডিশ ক্রাইম সিরিজগুলি ১৯৯০-এর দশক থেকেই হাওয়া সেদিকে ঘুরিয়েছে। সেই হাওয়ায় বদলেছে হোমস-এর নতুন অবতারও। ব্যোমকেশ কি সেদিকেই ঢলছে? পরের সিজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তবে একটা কথা। পিরিয়ড পিস তৈরি করতে হলে কতগুলো খুঁটিনাটি ব্যাপারে সচেতন থাকাটা জরুরি। যেমন, এখানে কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘মহাভারত’-এর যে সংস্করণটি দেখা গিয়েছে সেটি হাল আমলের দু’খণ্ডে লভ্য রয়্যাল সাইজের। আর ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর মলাটটিও যে হাল আমলের অফসেট-জাত, তা বেশ বোঝা যায়। আর, ১৯৪৩-এ ফ্রেমবিহীন ছবি দেওয়ালে টাঙানোর রেওয়াজ ছিল না, এটা মনে রাখলে মন্দ হত না। তবে, এ সব কিচির-মিচির বাদ দিলে সিজন জমজমাট। অপেক্ষা সিজন সিক্সের জন্য।