স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত তাঁর বাবা। একমাত্র ছেলের নাম রেখেছিলেন স্বামীজির নামেই। কিন্তু পরে সেই ছেলে যখন হিন্দি সিনেমার নায়ক হলেন, নাম থেকে ফেলে দিলেন ‘আনন্দ’ শব্দটি। হিন্দি ছবির কোনও নায়কের সঙ্গে ওই বিশেষ নামটি জড়িয়ে থাকলে নামের মর্যাদার হানি হবে। এরকমই মনে হয়েছিল বিবেক ওবেরয়ের।
বলিউডে তাঁর কেরিয়ারের সূত্রপাত ছিল উল্কার বেগে। কিন্তু আচমকাই হারিয়ে গেলেন তিনি। ইন্ডাস্ট্রিতে বহিরাগত না হয়েও প্রত্যাশাপূরণের কাছে পৌঁছতে পারেননি অভিনেতা সুরেশ ওবেরয়ের ছেলে।
বিবেকের জন্ম ১৯৭৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। তাঁর বাবা সুরেশ পঞ্জাবি বংশোদ্ভূত। মা, যশোদা দক্ষিণ ভারতীয়। ফলে বাড়িতে মিশ্র সংস্কৃতিতে বড় হয়েছেন বিবেক এবং তাঁর বোন মেঘনা। মেঘনা একজন চিত্রশিল্পী এবং গায়িকা।
অজমেঢ়ের মেয়ো কলেজের পরে বিবেকের পড়াশোনা মুম্বইয়ের মিঠিভাই কলেজে। লন্ডনের এক ওয়ার্কশপে তাঁকে চোখে পড়ে যায় নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টরের। তিনি বিবেককে নিউ ইয়র্কে অভিনয়ের উপর স্নাতকোত্তর কোর্স করার জন্য নিয়ে যান।
পরে ভারতে ফিরে বিবেক প্রথমে চিত্রনাট্য লেখার কাজ শুরু করেন। পরে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে অভিনয়ে। ২০০২ সালে তিনি প্রথম অভিনয় করেন রামগোপাল বর্মার ছবি ‘কোম্পানি’তে। ছবি এবং বিবেকের অভিনয়, দুই-ই সুপারহিট। তাঁর পরবর্তী ছবি ছিল ‘রোড’ এবং ‘দম’।
এর পর লাগাতার বক্সঅফিস সফল ছবি উপহার দেন এই অভিনেতা। ‘সাথিয়া’, ‘ওমকারা’, ‘যুবা’, ‘শুট আউট অ্যাট লোখণ্ডওয়ালা’-সহ একাধিক ছকভাঙা ছবিতে নিজেকে নতুন নতুন ভূমিকায় মেলে ধরেন বিবেক।
তাঁর ফিল্মোগ্রাফিতে উল্লেখযোগ্য বাকি ছবি হল ‘ডরনা মানা হ্যায়’, ‘কিসনা:দ্য ওয়ারিয়র পোয়েট’, ‘লাক বাই চান্স’, ‘কৃষ থ্রি’ এবং ‘কুরবান’। কিন্তু তার পরেও সমসাময়িক নায়কদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েন তিনি।
ঘনিষ্ঠ মহলে বিবেকের আক্ষেপ, সলমন খানের জন্যই তাঁর কেরিয়ার খাদের কিনারায় এসে পৌঁছয়। বিতর্কের সূত্রপাত ঐশ্বর্যা রাইয়ের সঙ্গে তাঁর প্রেম ঘিরে। ঐশ্বর্যার সঙ্গে তাঁর আলাপ ‘কিঁউ হো গ্যয়া না’ ছবির শুটিংয়ে।
সে সময় সলমনের সঙ্গে ঐশ্বর্যার সম্পর্ক সদ্য ভেঙেছে। বিবেকের মধ্যে মানসিক আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন অ্যাশ। তাঁদের সম্পর্ক প্রেমে বদলে যেতে সময় নেয়নি। বিবেকের অভিযোগ, তাঁদের ঘনিষ্ঠতা মেনে নিতে পারেননি ঐশ্বর্যার প্রাক্তন প্রেমিক সলমন। সাংবাদিক বৈঠক করে তাঁর নামে প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন বিবেক।
বিবেকের অভিযোগ ছিল, সলমন তাঁকে হুমকি দিয়েছিলেন। সল্লু মিয়াঁ নাকি ৪১ বার ফোন করেছিলেন তাঁকে। তিনি সলমনের কাছ থেকে প্রাণনাশের হুমকি পান বলেও অভিযোগ বিবেকের।
এই সাংবাদিক বৈঠকই কাল হয় বিবেকের কেরিয়ারে। বলিউডের অন্দরমহলে কান পাতলে শোনা যায়, সলমন ক্ষমা করতে পারেননি বিবেককে। তাঁর কথাতেই নাকি ইন্ডাস্ট্রিতে ব্রাত্য হয়ে যান বিবেক।
সলমন-ঐশ্বর্যা-বিবেক এই ত্রিকোণ সম্পর্কে সবথেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে বিবেকের। ঐশ্বর্যার সঙ্গে তাঁর প্রেম ভেঙে যায়। আবার সলমনের নেকনজরে না থাকায় তাঁর কেরিয়ারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরে সলমনের সঙ্গে সম্পর্ক শুধরে নেওয়ার বহু চেষ্টা করেছেন বিবেক। প্রকাশ্যে ক্ষমাও চেয়েছেন। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ অধরাই থেকে গিয়েছে তাঁর কাছে।
পরে একটি টেলিভিশন শো-এ এসে সলমন জানান, বিবেকের সঙ্গে তাঁর কোনও শত্রুতা নেই। কিন্তু তিনি কোনও ঘনিষ্ঠতাও চান না। তিনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন, বিবেকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কোনওদিন স্বাভাবিক হবে না।
২০১৯-এ বিবেক সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি মিম শেয়ার করেছিলেন। তাঁর এবং সলমনের সঙ্গে ঐশ্বর্যার প্রেম এবং পরে অভিষেকের সঙ্গে বিয়ে—এটাই ছিল মিমের বিষয়। এই মিম পোস্ট করা নিয়ে তীব্র বিতর্ক দেখা দেয়। জাতীয় মহিলা কমিশন থেকে নোটিসও পাঠানো হয় বিবেককে। শেষে তিনি ক্ষমা চান এবং টুইটার হ্যান্ডল থেকে মিমটি সরিয়ে নেন।
ঐশ্বর্যা ছাড়াও বিবেকের প্রেমিকা ছিলেন গুরপ্রীত গিল। পরে সেই সম্পর্কও ভেঙে যায়। ২০১০ সালে বিবেক বিয়ে করেন প্রিয়ঙ্কা আলভাকে। প্রিয়ঙ্কার বাবা প্রয়াত জীবরাজ আলভা ছিলেন জনতা দল ইউনাইটেডের নেতা তথা কর্নাটকের প্রাক্তন মন্ত্রী।
বিবেক-প্রিয়ঙ্কার ছেলের নাম ভিভান এবং মেয়ের নাম তাঁরা রেখেছেন আমেয়া। অভিনয়ের পাশাপাশি বিবেকের শখ দামী গাড়ির। একাধিকল বিলাসবহুল গাড়ির মালিক তিনি।
বলিউডে তাঁর প্রিয় অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, অজয় দেবগণ এবং হৃতিক রোশন। নায়িকাদের মধ্যে পছন্দ মাধুরী দীক্ষিত, বিদ্যা বালন এবং প্রিয়ঙ্কা চোপড়াকে। প্রিয় পরিচালক রামগোপাল বর্মা।
ছাত্রজীবনে টেনিস, ফুটবল, ক্রিকেট-সহ বিভিন্ন স্পোর্টসে দক্ষ বিবেক ভক্ত সচিন তেন্ডুলকরের। ইন্ডাস্ট্রিতে বিবেকের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে করিনা কপূর অন্যতম। করিনার প্রভাবেই তিনি সম্পূর্ণ নিরামিষাশী হয়ে গিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিবেক।
বিবেক এবং তাঁর পরিবার একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালনা করেন। তামিলনাড়ুর কাড্ডালোরে সুনামিবিধ্বস্ত একটি গ্রাম দত্তক নিয়েছিলেন বিবেক। এই গ্রামটিকে গড়ে তোলার জন্য অর্থসাহায্য করেন তিনি। সমাজসেবার ক্ষেত্রে পুরস্কৃতও হয়েছেন বলিউডের দৌড়ে আপাতভাবে ‘পিছিয়ে পড়া’ এই নায়ক।