ফেরারি, মাজেরাতি-র মতো বিলাসবহুল গাড়ির ডিলার ছিলেন বাবা। কিন্তু ছেলের ব্যবসায়ে বিশেষ মন ছিল না। তিনি অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। স্বপ্ন সফল করেওছিলেন। পর্দায় জীনত আমন, পর্দার বাইরে অসংখ্য অনুরাগিণীর হৃদয় চুরি করেছিলেন তিনি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিজয় অরোরা দর্শকদের স্মৃতিতে থাকলেন ‘রামায়ণ’-এর মেঘনাদ হয়েই।
বিজয়ের জন্ম ১৯৪৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর, গুজরাতের কচ্ছে। পড়াশোনা শেষ করে বিজয় চলে আসেন মুম্বই, নায়ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। ঘুরতে থাকেন স্টুডিয়োর দরজায় দরজায়। কিন্তু সব জায়গাতেই তাঁর জন্য অপেক্ষা করে ছিল প্রত্যাখ্যান। শুনতে হয়, ‘আরও তৈরি হয়ে তার পর আসুন সুযোগের জন্য’।
বার বার প্রত্যাখ্যাত বিজয় এ বার চলে যান পুণে। ভর্তি হন এফটিআইআই-এ। মেধাবী বিজয় কোর্স শেষে স্বর্ণপদক পান। কোর্স শেষ হওয়ার আগেই তাঁর কাছে আসে অভিনয়ের সুযোগ। ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় সুদর্শন বিজয়ের প্রথম ছবি ‘জরুরত’। বিপরীতে নায়িকা ছিলেন রীনা রায়।
বলিউডে আসার দু’বছরের মধ্যে বিজয় অরোরা চলে আসেন জনপ্রিয়তার প্রথম সারিতে। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় ‘ইয়াদোঁ কি বরাত’। জীনত আমনের সঙ্গে তাঁর জুটি এবং ‘চুরা লিয়া হ্যায় তুম নে জো দিল কো’ গানটি জায়গা করে নেয় বলিউডের চিরসবুজ রোমান্টিক গানের মধ্যে।
ইন্ডাস্ট্রি এবং তার বাইরে বাড়তে থাকে তাঁর জনপ্রিয়তা। এক সাক্ষাৎকারে রাজেশ খন্না বলেছিলেন তাঁর জায়গা যদি কেউ ইন্ডাস্ট্রিতে নিতে পারেন, তবে বিজয়ই পারবেন। তিনি বিজয় অরোরাকেই পরবর্তী রোমান্টিক সুপারস্টার বলেছিলেন।
প্রথম ছবির আকাশছোঁয়া সাফল্যের পরে বিজয়ের কাছে সুযোগের অভাব হয়নি। ‘ফাগুন’ ছবিতে তিনি অভিনয় করেন জয়া বচ্চন এবং ওয়াহীদা রহমানের সঙ্গে। ‘ইনসাফ’-এ তাঁর নায়িকা ছিলেন তনুজা। পরভীন বাবির সঙ্গে জুটি বেঁধেছিলেন ’৩৬ ঘণ্টে’ ছবিতে। ‘কাদম্বরী’ ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন শাবানা আজমি।
কিন্তু সাতের দশকে বলিউডে ধীরে ধীরে অমিতাভ বচ্চনের উত্থান হতে শুরু করে। ফলে অ্যাংরি ইয়ংম্যানের দাপটে ক্রমশ রোমান্টিক নায়ক বিজয়ের পায়ের নীচে মাটি সরতে থাকে। তা ছাড়া শোনা যায় ইন্ডাস্ট্রির রাজনীতিও তাঁকে বিব্রত করেছিল। বেশ কিছু ছবি থেকে শেষ মুহূর্তে বাদ পড়েছিলেন প্রযোজকের সঙ্গে তাঁর খাতির ছিল না বলে।
রাজেশ খন্না, ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে যাঁর তুলনা হত, সেই বিজয় অরোরা এ বার সুযোগ পেতে শুরু করলেন পার্শ্বচরিত্রে। সাতের দশকের শুরুতে তিনি ছিলেন অমিতাভের প্রতিযোগী। ১০ বছর পরে ‘নসীব’ ছবিতে অমিতাভ নায়ক। বিজয় অরোরা পার্শ্বচরিত্রে।
কয়েক বছর পার্শ্বচিরত্রে কাজ করার পরে তিনি পা রাখেন টেলিভিশনে। রামানন্দ সগরের ‘রামায়ণ’-এ বিজয় অরোরাকে দেখা যায় ‘মেঘনাদ’ চরিত্রে। অর্থাৎ সেখানেও মূল চরিত্রের বদলে তাঁকে দেওয়া হয় সীমিত পরিসরে অভিনয়ের সুযোগ। কিন্তু অভিনয় ছাড়া বাঁচতে পারতেন না। তাই ছোট চরিত্রেও অভিনয় করতে দ্বিধা ছিল না বিজয়ের।
বিজয়ের ফিল্মোগ্রাফিতে উল্লেখযোগ্য হল ‘রাখি অউর হাতকড়ি’, ‘নাটক’, ‘সবসে বড়া সুখ’, ‘মেরে ভাইয়া’, ‘রোটি, ‘জীবনজ্যোতি’, ‘সফেদ হাতি’, ‘সরগম’, ‘মেরি আওয়াজ শুনো’ এবং ‘এক মুঠ্ঠি আসমান’।
আট এবং নয়ের দশকের শুরুতেও বেশ কিছু ছবিতে তাঁকে দেখা গিয়েছে। ‘পুরানি হভেলী’, ‘দোস্ত গরিবোঁ কা’, ‘১০০ ডেজ’, ‘জান তেরে নাম’, ‘বিশ্বাত্মা’, ‘গীতাঞ্জলি’-সহ কিছু ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন। ১০ বছরের বিরতি ভেঙে ২০০৩ সালে অভিনয় করেছিলে ‘ইন্ডিয়ান বাবু’ ছবিতে। এর পর তাঁকে আর কোনও ছবিতে দেখা যায়নি।
টেলিভিশনেও রামায়ণ-এর পরে ‘বিক্রম অউর বেতাল’, ‘ভারত এক খোঁজ’ এবং ‘জি হরর শো’-এ তিনি অভিনয় করেছেন। কিন্তু কোনওটাই রামায়ণের জনপ্রিয়তা স্পর্শ করতে পারেনি।
সম্প্রতি লকডাউনে দূরদর্শনে আবার সম্প্রচারিত হয় ‘রামায়ণ’। দূরদর্শনের তরফে জানানো হয়েছে ২০২০ সালের ১৬ এপ্রিল লক্ষ্মণের হাতে ইন্দ্রজিৎ অর্থাৎ মেঘনাদবধের পর্ব দেখানো হয়েছিল। সেদিন ওই পর্বের দর্শকসংখ্যা ছিল রেকর্ডসংখ্যক, প্রায় ৭ কোটি ৭০ লক্ষ।
শতাধিক ছবিতে অভিনয়ের পরেও বলিউড তাঁর স্ট্রাগলের কোনও মূল্য দেয়নি। সাফল্য ধীরে ধীরে দূরেই চলে গিয়েছে তাঁর থেকে।
ইন্ডাস্ট্রিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে বিজয় শেষে সরে আসেন ব্যবসার দিকে। চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন জিনিস তিনি আমদানি করে বিক্রি করতেন। শোনা যায়, ‘সুপারম্যান’ ছবির জন্য কিছু জিনিস তিনি সরবরাহ করেছেন ওয়ার্নার ব্রাদার্সকেও।
নবাগতদের জন্য অভিনয় শেখার প্রতিষ্ঠানও খুলেছিলেন। কিন্তু সেখানে শিক্ষক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি অতীতের স্বর্ণপদকজয়ী এই ছাত্র।
স্বাস্থ্য সচেতন এবং নিয়মিত যোগাভ্যাস করা বিজয় অরোরা পাকস্থলীর জটিল অসুখে কষ্ট পেতেন। ওই অসুখেই মাত্র ৬২ বছর বয়সে প্রয়াত হন তিনি। ২০০৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি।
প্রাক্তন মিস ইন্ডিয়া তথা মডেল দিলবর দেবারাকে বিয়ে করেছিলেন বিজয়। পার্সি ধর্মাবলম্বী স্ত্রীর বিশ্বাসকে গুরুত্ব দিয়ে একমাত্র ছেলের নামকরণ করেছিলেন ফরহাদ।
বিজয়ের মৃত্যুর পরে মানসিক দিক থেকে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন দিলবর। তাঁর ছেলে জানান, এরকমও হত দিলবর হয়তো রান্নাঘরে গ্যাসের ওভেন জ্বালিয়ে রান্না করতেই ভুলে যেতেন। শুধু শুধু গ্যাস জ্বলে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হত।
জ্যাকি শ্রফ, গোবিন্দ, ড্যানি-সহ বিজয়ের বাকি বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন না দিলবর। এতটাই আঘাত পেয়েছিলেন যে তিনি মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
বিজয়-দিলবরের ছেলে ফরহাদ বিজয় অরোরা অবশ্য অভিনয়ে পা রাখেননি। তিনি তাঁদের পারিবারিক বিলাসবহুল গাড়ির ব্যবসারই দেখভাল করেন। কিছু কিছু বিজ্ঞাপনের ছবি এবং মিউজিক ভিডিয়ো প্রযোজনা করেছেন। কিন্তু সরাসরি অভিনয় করার কোনও ইচ্ছে তাঁর নেই।