গিরিশ কারনাড।
পাগলা রাজা লোকে বলে তাঁকে। হিন্দু বিষ্ণুপ্রসাদের সম্পত্তি কিন্তু ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন মহম্মদ বিন তুঘলকই। কারণ তাঁর রাজত্বে হিন্দু-মুসলমান দ্বৈরথ তিনি চান না।
জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর গিরিশ কারনাডের লেখা ‘তুঘলক’ নাটকের শুরুটা এ রকমই। সেখানে মৃত্যুর কুড়ি বছরের মধ্যে লোকে তুঘলককে ভুলে যায়, অত্যাচারী বলে চিহ্নিত করে। আদর্শবাদ এবং জনজীবনে ফারাক বহু দূর!
সেই নাট্যকার, পরিচালক ও অভিনেতা গিরিশ কারনাড ৮১ বছর বয়সে আজ বেঙ্গালুরুর বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ফুসফুসের অসুখে গত কয়েক বছর ধরে ভুগছিলেন। রেখে গেলেন স্ত্রী সরস্বতী, এক পুত্র ও কন্যাকে।
প্রতিবাদী গিরিশ কারনাড।
গিরিশ কারনাডের মুখ ছিল, মুখোশ ছিল না। যা বিশ্বাস করতেন, সেটিই লিখতেন। কালবুর্গী, গৌরী লঙ্কেশ হত্যার পরে নাকে পোর্টেবল অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। ‘নট ইন মাই নেম’, ‘আমিও শহুরে নকশাল’ বলে গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়েছিলেন। লোকসভা ভোটের আগে প্রায় ছ’শো থিয়েটার কর্মীর সঙ্গে একযোগে বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিজেপি জিতলে ভারত নামটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ধারণা এবং দেশের সংবিধান, দুইই বিপন্ন হবে। হিন্দু-মুসলিম সংহতির পক্ষে তিনি দাঁড়িয়েছেন বরাবর। নোবেলজয়ী লেখক ভি এস নয়পলের লেখায় মুসলিম বিদ্বেষের ছোঁয়া দেখে পরিষ্কার বলেছিলেন, ভারতের ইতিহাসে মুসলিম অবদান নিয়ে নয়পলের কোনও ধারণা নেই।
গিরিশের প্রতিবাদ মানে উচ্চকিত স্লোগান ছিল না। নম্র স্বরে প্রশ্ন তুলতেন। ‘রোডস স্কলারশিপ’ নিয়ে অক্সফোর্ডে পড়তে যাচ্ছেন, তার আগেই লিখে ফেললেন জীবনের প্রথম নাটক ‘যযাতি’। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের মেয়ে দেবযানীকে বিয়ে করেছেন যযাতি, তিনটি পুত্রও আছে। কিন্তু এক দিন মুগ্ধ হলেন দৈত্য রাজকন্যা শর্মিষ্ঠাকে দেখে। তাঁকে বিয়ে করলেন, শ্বশুর শুক্রাচার্য এসে অভিশাপ দিলেন। অভিশাপ কাটানোর উপায় একটিই। কোনও পুত্র যদি যযাতির জরা এবং বার্ধক্য গ্রহণ করে তাঁকে নিজের যৌবন দেয়! মহাভারতের এই গল্পটি বহু পরিচিত, বাংলায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্যও আছে। গিরিশ সেই জানা গল্পটাই বলেন, কিন্তু সেখানে পুরুর বউ চিত্ররেখা এসে শ্বশুরকে প্রশ্ন করে, তার দাম্পত্য নষ্টের কী অধিকার যযাতির ছিল?
এই প্রশ্ন হতে পারে নারীবাদের। আবার দেখা যেতে পারে অন্য ভাবেও। ভারতীয় পরিবার মানেই বাবার ব্যর্থ স্বপ্নের ভার বইতে বইতে জরাগ্রস্ত হয়ে ক্ষয়ে যাবে পুত্র। এই যে মহাকাব্য, মিথ ও লোককথাকে ব্যবহার করে, তাকে আধুনিকতার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া, এখানেই গিরিশের বৈশিষ্ট্য। ‘হয়বদন’, ‘রক্তকল্যাণ’, ‘নাগমণ্ডল’— একের পর এক নাটক। নাট্যকার হিসাবেই পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ থেকে জ্ঞানপীঠ!
বাঙালিও তো বারংবার মজেছে তাঁর নাট্যস্বপ্নকল্পে। চিত্তরঞ্জন ঘোষ থেকে শঙ্খ ঘোষ, স্বপন মজুমদাররা অনুবাদে গিরিশের নাটককে নিয়ে এসেছেন বাংলায়। দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, অবন্তী চক্রবর্তীরা তাঁর নাটক করার জন্য অনুমতি চেয়েছেন, বিনা বাক্যব্যয়ে সম্মতি দিয়েছেন। এক পয়সাও নেননি। অবন্তী নিজের অনুবাদে ‘নাগমণ্ডলম’ করেছেন, প্রথম দিনের রিহার্সালেই হাজির তিনি!
সিনেমায় কন্নড় থেকে হিন্দি, অবাধ যাতায়াত তাঁর। ‘সংস্কার’, ‘আনন্দ ভৈরবী’, ‘উমবার্থা’ থেকে ‘নিশান্ত’, ‘মন্থন’, টিভি সিরিজ ‘মালগুড়ি ডেজ’ বা ‘ইন্দ্রধনুষ’ থেকে হাল আমলের ‘এক থা টাইগার’ সর্বত্র তাঁর অনায়াস উপস্থিতি। পরিচালনাতেও উজ্জ্বল ‘গোধূলি’ বা ‘উৎসব’-এর মতো ছবির সুবাদে।
উজ্জ্বল, কিন্তু সেলিব্রিটিসুলভ নয়। বেঙ্গালুরুর শ্মশানে আজই ছাই হয়ে গেল তাঁর মরদেহ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সকলেই শোকবার্তা জানিয়েছেন। কর্নাটক সরকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য করতে চেয়েছিল। কারনাড পরিবার রাজি হয়নি। রাজসম্মান নয়, নাট্যকার হিসেবেই বেঁচে থাকতে চেয়েছেন গিরিশ।