উস্তাদ রাশিদ খানের পুত্র আরমান খান। ছবি: সায়নদেব চৌধুরী
প্রশ্ন: পনিটেল। হাতে গিটার। স্টেজে বসে ঠুংরি গাইছেন। সঙ্গে অবশ্য রয়েছে সারেঙ্গি, হারমোনিয়ম এবং তবলা। সম্প্রতি ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলনও অনুষ্ঠান করেছেন। উস্তাদ রাশিদ খান এই ব্যাপারটাকে কী ভাবে দেখেন?
আরমান: বাবাই তো বলেছেন! উনি বলেছেন, ‘‘আমি যে ভাবে সুরমণ্ডল ব্যবহার করি, তুমি সেই ভাবে গিটারটা ব্যবহার করতে পারো। কারণ এখনও কোনও অনুষ্ঠানে কেউ গিটার হাতে পুরোদস্তুর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গাননি।’’ বাবা বিষয়টাকে প্রশ্রয়ই দেন। মা প্রথম বলেছিলেন গিটার নিয়ে স্টেজে বসতে।
ক’দিন আগে গান্ডা বেঁধে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘরানায় দীক্ষিত হয়েছেন। কিন্তু ঔপচারিকতা বাদ দিলে বাবার কাছে শেখা তো জন্ম থেকেই। নতুন করে তা হলে এই আনুষ্ঠানিকতার দরকার হল কেন?
আসলে এই অনুষ্ঠানটা খুব প্রয়োজনীয়। বাবার কাছে ছোট থেকে শিখছি। এখনও শিখছি। কিন্তু গান্ডা বেঁধে শেখার অর্থ হচ্ছে, আমাদের রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার নিয়মকানুন মেনে আমি শিখব, সেই প্রতিশ্রুতি দেওয়া। একই সঙ্গে বাবাও আমাকে ছাত্র হিসাবে যোগ্য মনে করছেন এবং ঘরানার রীতিনীতি শেখাবেন, তারও অঙ্গীকার করছেন। তবে শেখা তো শুরু হয়েছে জন্ম থেকে। আর স্টেজে উঠেছি দু’বছর বয়সে। মা-বাবার কাছে সেই গল্প শুনেছি। তখন আমি একটা কি দুটো শব্দ বলতে পারতাম। গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনে বাবার অনুষ্ঠান ছিল। আমি নীচে ছিলাম। বাবাকে স্টেজে দেখে ঝোঁক উঠে যায়, আমিও স্টেজে বসব। শেষ পর্যন্ত আমাকে স্টেজে তুলে দেওয়া হয়। শুনেছি, বাবার সুরমণ্ডলের মাইক হাতে টেনে ‘সা’ বলতে শুরু করি! এতে সকলে খুব মজা পান। হাততালি দেন। তখন প্রসন্ন মহারাজ বলেন, ‘‘ওকেও একটা মাইক দেওয়া হোক।’’ যাই হোক, এর পর বাবা গান শুরু করেন। খানিক বাদে বাবা দেখেন, আমি নেই। আমি তখন বাবার পিছনে। বাবার পিঠে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছি।
পিতা ও পুত্র। রাশিদের সঙ্গে মঞ্চে আরমান। নিজস্ব চিত্র
উস্তাদ রাশিদ খানের দাদু তো উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ-সাহিব…। মামা গ্বালিয়র ঘরানার উস্তাদ গুলাম মুস্তাফা খাঁ-সাহিব...
হ্যাঁ। বাবার দাদু বিখ্যাত উস্তাদ ছিলেন। আমার কাছে তিনি ঈশ্বরের মতো। এক দিকে এটা আমার দুর্ভাগ্য যে, ওঁর লাইভ কোনও অনুষ্ঠান আমি দেখতে পাইনি। যেটা বাবা দেখেছেন। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে বলতে হবে, এটা এই প্রজন্মের দুর্ভাগ্য যে ওঁদের গান আমরা সরাসরি শুনতে পাইনি। আমি এই ঘরানার ২৭তম বংশধর। দাদুর মেলা গল্প বাবার কাছে শুনেছি। গান বাদে ওঁর অনেক বিষয়ে শখ ছিল। উনি পোষ্য ভালবাসতেন। ঘোড়ায় চড়তে পছন্দ করতেন। সেই সঙ্গে বাইক চালাতেও ভালবাসতেন। ওঁর একটা অ্যালশেসিয়ান কুকুর ছিল। তার নাম ছিল পিটার। ওর একটা ছানা হয়েছিল। বাবা তার নাম রেখেছিলেন বিজলি। বাবা বিজলিকে খুবই ভালবাসতেন। বাবাকে যা খেতে দেওয়া হত, বাবা বিজলিকে খাইয়ে দিতেন। এত দ্রুত বাবার প্রতি দিন খাওয়া হয়ে যাচ্ছে দেখে সন্দেহ হয় বাবার দাদুর। এক দিন বাবাকে দুধ দেওয়া হয়েছে। নিসার হুসেন খাঁ-সাহিব বাবার উপর লুকিয়ে নজর রাখছেন। তিনি দেখলেন, বাবা দুধের গ্লাসটা নিয়ে বিজলির বাটিতে ঢেলে দিলেন। নিমেষের মধ্যে বিজলি তা শেষ করল। তখন বাবার দাদু কান ধরে বাবাকে এনে আবার দুধ খাওয়ালেন।
দাদুর কাছে বাবার শেখা কোনও রাগ বা স্টাইল কি শিখছেন?
অনেক বন্দিশ শিখেছি। যেমন ইমন রাগের একটা তারানা শিখেছি বাবার কাছে, যা নিসার হুসেন খাঁ-সাহিব গাইতেন। এনায়েৎ হুসেন খাঁ-সাহিবের কিছু বন্দিশ শিখেছি, যা বড় একটা শোনা যায় না। রাগ তৈরি করার শখ ছিল বাবার দাদুর। এটা বাবাও করেন। যেমন সোহিনী-বাহার রাগটা। এটা বাবার কাছেই শিখেছি। এক দিন বাবা মধুবন্তী শেখাচ্ছিলেন। রিয়াজ করতে করতে কিছু অন্য রাগের সুর লেগেছে। বাবা বললেন, “এক মিনিট দাঁড়া তো, এটা কী হতে পারে?” ওই সুরগুলো নিয়ে বানানো হল প্রিয় মধুরঞ্জিনী রাগটি। বন্দিশ ‘যব সে পিয়া গয়ে পরদেশ’। এটাও বাবার তৈরি। এনায়েৎ হুসেন খাঁ-সাহিবের রাগ মেহগনি, সাগর শুনেছি। তবে খুবই জটিল রাগ। এখনও শেখার মতো তৈরি হইনি। গুলাম মুস্তাফা খাঁ-সাহিবের পুরিয়া কল্যাণ খুবই শুনি। ওঁর একটা বন্দিশ শিখেছি ‘বহোত দিন বিতে’। এটা ওঁর তৈরি বন্দিশ। ওঁর ঠুংরি এবং গজল শুনি। এ ছাড়া শুনি ভীমসেন যোশী... নুসরৎ ফতে আলি খাঁ-সাহেবের গানও খুব শুনি।
মঞ্চে অনুষ্ঠান পরিবেশন করছেন আরমান। ছবি: সায়নদেব চৌধুরী
গিটার শেখা কার কাছে?
সেই ভাবে বলতে গেলে গিটার শিখিনি কারও কাছে। ছোটবেলার একটা গিটার ছিল, সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম। এর পর জিৎ আঙ্কল আমাকে একটা গিটার দেন। সেই গিটারটা নিয়েই টুংটাং করতে থাকি। এক দিন গিটারে ‘এক দো তিন’ গানের সুর বাজাচ্ছিলাম। সহজ সুর। ওইটুকুই তুলে বারবার বাজিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় মা বললেন, ‘‘তুই এক কাজ কর। গিটারটা নিয়ে যে কোনও একটা লোকাল ট্রেনে গিয়ে বসে পড়। ওখান থেকে যে দু’দশ টাকা পাবি, তাতেই তোর চলে যাবে!” আসলে গান গাওয়ার সঙ্গে বিভিন্ন যন্ত্র শিখতে ইচ্ছা করে। যেমন সম্প্রতি দুবাইয়ে গিয়েছিলাম একটা ‘উদ্’ কিনতে। কিন্তু আওয়াজ পছন্দ হল না। পাশের দোকানে একটা ব্যাঞ্জো রাখা ছিল। সেটা বাজিয়ে দেখলাম, দুর্দান্ত আওয়াজ। সেটা আনা হয়েছে। শেখার চেষ্টা করছি। বাড়িতে একটা রবাব রয়েছে। তবলাও শিখছি। গান গাইতে গেলে তো তবলা শিখতেই হবে। বাবাও খুব ভাল তবলা বাজাতে পারেন। দিদিরাও পারে।
ভবিষ্যতে কি শুধু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গাইতে চান, না ফিউশন বা বলিউডে গাওয়ারও ইচ্ছা আছে?
আমার মূল লক্ষ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, অন্য কিছু গাইব না।
গানের পাশাপাশি স্টাইল সচেতনও। নিজস্ব চিত্র
আপনার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে বাবার কণ্ঠস্বরের সাদৃশ্য রয়েছে। এতে সমস্যা হয়, না সুবিধা হয়?
বাবার ছেলে হিসাবে বাড়তি সুবিধা তো পাই-ই। আমি খুবই ভাগ্যবান যে, বাবার কণ্ঠের শূন্য দশমিক এক শতাংশ আমি পেয়েছি। আমি ভাগ্যবান। কিন্তু একই সঙ্গে মনে হয়, আমার নিজস্ব কিছু করা উচিত, যাতে আত্মপরিচয় তৈরি হয়। অন্তত যাতে লোকের মনে হয়, ‘বাপ কা বেটা!’ তবে আমি চাই বাবার ঘরানা অনুসরণ করতে। কোনও অনুষ্ঠানে কেউ যখন বলেন, যে বাবার মতো গলা, তখন খুব আনন্দ হয়। উপরওয়ালাকে ধন্যবাদ যে, বাবার কণ্ঠের কিছুটা পেয়েছি। সব চেয়ে বড় কথা, আমি খুবই ভাগ্যবান এমন বাবা, মা এবং দিদিদের পেয়েছি বলে। তবে আমি নিতান্তই শিক্ষার্থী। অনেক রিয়াজ করতে হবে। চেষ্টা করছি। আমার প্রচুর ভুল হয়। আমি এখনও পেশাদার হইনি। আমার ভুলত্রুটির কথা কেউ যদি আমাকে সরাসরি বলেন, ভাল হয়।
প্রেম করেন?
এখনও তেমন সিরিয়াস কোনও সম্পর্কে জড়াইনি। ক্রাশ আছে অনেক। বলিউডেও আছে। বলিউডের যাঁর ছবি যখন দেখি, তাঁর উপর তখন ক্রাশ হয়। কিয়ারা আডবাণীর ছবি দেখলে ওঁকে ভাল লাগে। কৃতি শ্যাননের ছবি দেখলে ওঁকে ভাল লাগে। এই রকম। তখন মনে হয়, বিয়ে করলে এ রকমই কাউকে করব। কিন্তু এখনও গার্লফ্রেন্ড নেই।
পড়াশোনা, গানের বাইরে কী ভাবে সময় কাটান?
ব্যাডমিন্টন খেলি। ফুটবল খেলতে ভাল লাগে। গাড়ি চালাতে ভাল লাগে। গাড়ির শখ রয়েছে। নিজের গাড়ি মডিফাই করি। আমি গাড়ির জন্য পাগল।
ইদের দিন কী ভাবে কাটছে?
সকালে মা তুলে দিয়েছেন। আমি আর বাবা নমাজ পড়ে এসেছি। এর পর বাড়িতে এখন অনেক আত্মীয় এসেছেন। বাবা বিরিয়ানি আর কবাব রাঁধছেন। এটা বাবার থেকে ভাল পৃথিবীতে আর কেউ পারে বলে মনে হয় না।