৩৫-এর দীপিকা পাড়ুকোন কেমন? অভিনয়ে বাঁচেন? প্রতিহিংসাপরায়ণ? অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন? যে কোনও সময় মানসিক বিপর্যয়ে তলিয়ে যান? অনেকেই জানেন না, যে অভিনয় তাঁকে অর্থ-নাম-যশ-খ্যাতি-প্রতিপত্তি দিয়েছে সেই অভিনয়ই তাঁর রাতের ঘুমও কেড়েছে! ১৫ বছর ধরে চরাই-উৎরাই পেরিয়ে তিনি সাফল্য দেখেছেন। তার পরেও তাঁর আতঙ্ক, যদি আর ভাল চরিত্র না পান! এই ভয় আজও তাঁকে মাঝ রাতে ঘুম থেকে তুলে দেয়।
পারিবারিক পরিচয় বলছে, সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্মেছেন দীপিকা পাড়ুকোন। জাতীয় স্তরের ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় প্রকাশ পাড়ুকোন তাঁর বাবা। প্রকাশ নিজেও চূড়ান্ত রমণীমোহন ছিলেন! তাঁর দুই মেয়ে দীপিকা আর অনীশা। দুই মেয়েই খেলায় তুখোড়। হাতে তুলে নিলেই ব্যাডমিন্টন র্যাকেট যেন তাঁদের কথা শুনত। দশম শ্রেণিতে উঠেই স্বপ্ন বদলে গেল প্রকাশের বড় মেয়ের। ঠিক করলেন, সবুজ কোর্ট নয় রুপোলি পর্দায় দাপিয়ে বেড়াবেন।
দীপিকার এই চাওয়ায় কখনও বাধা হয়ে দাঁড়াননি প্রকাশ এবং তাঁর স্ত্রী উজ্জ্বলা পাড়ুকোন। দীপিকাও ক্রমশ নিজেকে তৈরি করতে থাকেন অভিনয়ের জন্য। শুরু করেন মডেলিং। প্রথম সারির বিজ্ঞাপনের প্রচার মুখ ছিলেন তিনি। তবে অভিনয় দুনিয়ার নজর কাড়েন ক্লোজ আপের বিজ্ঞাপন দিয়ে। স্রেফ পাজামা-টপ পরা দীপিকার মুখের সারল্য, ঝলমলে হাসি ভাল লেগেছিল বলিউডের।
দীপিকা এর পরেই সুযোগ পান হিমেশ রেশমিয়ার মিউজিক ভিডিয়ো ‘নাম হ্যায় তেরা’-য় (২০০৬)। সেই তাঁর প্রথম সাফল্য। যেখান থেকে তিনি এক লাফে শাহরুখ খানের বিপরীতে। ফারহা খানের ছবি ‘ওম শান্তি ওম’-এ। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করেছিলেন নায়িকা। আর পরিচালকের কালঘাম ছুটিয়েছিলেন! দীপিকা তখনও অভিনয়ের ‘অ’ জানতেন না। ফলে, প্রতি দৃশ্যে তিনি ফারহার কাছে বকুনি খেতেন। তার শোধ তুলতেন সারা ক্ষণ দুষ্টুমি করে। একেক সময় এতটাই জ্বালাতেন যে ফারহার মনে হত, ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন দীপিকাকে! পরে তাঁরাই খুব ভাল বন্ধু।
রাতারাতি জনপ্রিয়। পরের বছরে সেই জনপ্রিয়তায় ভাটা। ‘বচনা অ্যায় হাসিনো’য় রণবীর কপূরের বিপরীতে তিনি। ছবি সুপার ফ্লপ। দীপিকার অভিনয়ের নিন্দেও হয়। এ দিকে ‘দীপবীর’ জুটি সুপার হিট! ওই সময় থেকেই রণবীরের সঙ্গে প্রেম অভিনেত্রীর। শ্যুটের অবসরে নায়কের বক্ষলগ্না! জুটির জৌলুসে আর গুঞ্জনের ধাক্কায় বলিউডও বেসামাল!
ওই সময়েই প্রেমের পাশাপাশি অভিনয়েও মন দিয়েছেন ‘মস্তানি’। অনুপম খেরের অভিনয় শেখানোর স্কুলে ভর্তি হয়েছেন। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ধীরে ধীরে তাঁর অভিনয় ধারালো হয়েছে। তিনি রণবীরের প্রেমে ভেসেছেন। দীপিকার পেলব, মসৃণ গ্রীবায় জ্বলজ্বল করত ভালবাসার স্বাক্ষর! টুকটুকে ফর্সা ত্বকে কালো আখরে লেখা আর কে! এই নামের মালিক রণবীর কপূর ছাড়া আবার কে?
দীপিকা তখনও জানতেন না, জীবন তাঁকে কী দিতে চলেছে? একের পর এক ছবিতে কাজ আর প্রেম। ভেবেছিলেন এমনি করেই বুঝি দিন কাটবে। হঠাৎই তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন বলিউডের ‘ক্যাসানোভা’! দীপিকার চোখে সেই প্রথম অন্ধকার নেমেছিল। ছবির খারাপ ব্যবসা, অভিনয় নিয়ে কটূক্তি শুনেও যে মেয়ে ভেঙে পড়েননি সেই মেয়ে খানখান।
টানা তিন মাস দীপিকা রোজ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। রোজ গুঁড়িয়ে গিয়েছেন। বলিউড বলে, মানসিক দিক থেকে এতটাই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন যে তাঁকে নাকি খাটের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতেন প্রকাশ-উজ্জ্বলা। যাতে না পালিয়ে যেতে পারেন, আত্হত্যা করেন দীপিকা। এ ভাবে দিনের পর দিন রাতের পর রাত একা ঘরে কাটাতেন। সারা ক্ষণ কান্নাকাটি। খাওয়া-ঘুম ভুলেছেন। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতেন মা-বাবা। আর আড়ালে চোখের জল ফেলতেন তাঁরা। দীপিকা পরে নিজেই জানিয়েছেন, ওই তিন মাস তিনি যেন অন্ধকার গুহায় বন্দি ছিলেন। যত চেষ্টা করেছেন আলোর মুখোমুখি হওয়ার, অন্ধকার যেন বেশি করে গ্রাস করত তাঁকে।
\ বলিউড ভেবেছিল, দীপিকা আর ফিরবেন না। মায়ানগরী ভুলে গিয়েছিল, তিনি খেলোয়াড়ের মেয়ে। জীবন তাঁর কাছে ব্যাডমিন্টন কোর্টের মতোই। তাই প্রতি দিন নিজের ভেঙে যাওয়া টুকরোগুলোকে জড়ো করেছেন। মনের জোরে তাদের জোড়া লাগিয়েছেন। শেষে এক দিন উঠে দাঁড়িয়েছেন। সেই দীপিকার চোখের তলায় গাঢ় কালি! খাওয়া-ঘুম বন্ধের জেরে চেহারার জৌলুস উধাও। আবারও জোর করে হেসেছেন। ভাল ভেবেছেন। ভাল থাকার চেষ্টা করেছেন।
তার পরেই ২০১৩-য় ফিরেছেন প্রবল ভাবে। এক বছরে দুটো জনপ্রিয় ছবির নায়িকা তিনি। ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’ আর ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’। প্রথম ছবির নায়ক সেই ‘আর কে’! দীপিকা পরে জেনেছিলেন, ক্যাটরিনা কইফ তাঁর থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন রণবীরকে।
সাল ২০১৫। সঞ্জয় লীলা ভন্সালির ‘গোলিও কা রাসলীলা: রাম লীলা’য় তিনি লীলা। রণবীর সিংহ রাম। এই ছবিতে দীপিকার অভিনয়ের জোশে থমকে গিয়েছিল তামাম ভারত। বাস্তবের ‘লীলা’ পেয়েছিলেন তাঁর জীবনের ‘রাম’কে। এই ভালবাসায় মন বসাতে অনেক গুলো বছর সময় লেগেছিল দীপিকার। তিনি ভালবাসায় বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। বিশ্বাস হারিয়েছিলেন মানুষের উপর থেকেও। এত অবিশ্বাস নিয়েও ভুলতে পারতেন না কপূর পরিবারের ‘লাভার বয়’কে।
সম্ভবত সেই জায়গা থেকেই একই নামের মালিকের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন এক সময়। কপূর না হয় সিংহ হল। রণবীর তো তাঁরই থাকল! এই টানে বিয়ের অনেক বছর পরেও তাঁর মসৃণ গ্রীবা থেকে চুলের আড়াল সরলেই জ্বলতে দেখা যেত আর কে উল্কি!
দীপিকা জ্বলে-পুড়ে নিঃশেষিত হতে হতে প্রথম সারিতে জায়গা করে নিয়েছেন। শাহরুখ খানের সমান পারিশ্রমিক দাবি করতে পেরেছেন। পরিচালক সঞ্জয়ের একের পর এক ছবির জনপ্রিয় নায়িকা হয়েছেন। নিজে ছবি প্রযোজনাও করেছেন।
আর সবার আড়ালে প্রতিশোধের ছুরি শানিয়েছেন। রণবীরের সঙ্গে এক সময় প্রেম ভেঙেছে ক্যাটরিনারও। ক্যাটরিনা আশ্রয় খুঁজেছেন তাঁর থেকে পাঁচ বছরের ছোট ভিকি কৌশলের কাছে। সম্প্রতি জমকালো বিয়েও সেরেছেন তাঁরা। বিয়ের সন্ধেয় যখন সাত পাক ঘোরা সম্পূর্ণ ভিক্যাটের, দীপিকা ইনস্টাগ্রামে ভাগ করে নিয়েছেন নিজের বিয়ের ছবি! যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন তাঁর পেশা এবং প্রেম জীবনের প্রতিদ্বন্দ্বীকে, ‘‘আমার গ্রাস কেড়েছিলে। তুমিও ভোগ করতে পারলে না!’’
অতীতের সেই ভয়, নিরাপত্তাহীনতা আজও তাড়া করে ফেরে দীপিকাকে। ঘরে-বরে থিতু হয়েও নায়িকা মাঝ রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেন, তাঁর হাতে আর ভাল চরিত্র নেই! তাঁকে আর কেউ নিত্য নতুন চরিত্রের জন্য ডাকছে না। অভিনয় ছেড়ে গেলে কী নিয়ে বাঁচবেন তিনি? তাঁর যে এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি। অনেক কিছু দেওয়া বাকি ভারতীয় চলচ্চিত্রকে।