ভেন্টিলেটরে টলিউড

বেশির ভাগ বাংলা ছবিই চলছে না। গত দু’বছরে শুধুমাত্র দুটি ছবিই প্রযোজকের ঘরে টাকা ফেরত আনতে পেরেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে স্যাটেলাইট রাইটস-এর বাজারে এ বিরাট ধস্‌। সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে বড় সঙ্কটের মুখে টলিউড। হঠাত্‌ কী হল? লিখছেন ইন্দ্রনীল রায়।প্রসেনজিত্‌ চট্টোপাধ্যায় মনে করেন টলিউড বড্ড বেশি দিন স্বপ্নের দেশে বাস করছিল। দেব-এর কাছে এটা অবশ্যই ঘোর সংকট।রাজ চক্রবর্তীর ভয় লাগছে।আর মৈনাক ভৌমিক বলছেন এ রকম তো হওয়ারই ছিল।তার আগে একটু কলকাতা শহরের দিকে তাকানো যাক।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share:

প্রসেনজিত্‌ চট্টোপাধ্যায় মনে করেন টলিউড বড্ড বেশি দিন স্বপ্নের দেশে বাস করছিল।

Advertisement

দেব-এর কাছে এটা অবশ্যই ঘোর সংকট।

রাজ চক্রবর্তীর ভয় লাগছে।

Advertisement

আর মৈনাক ভৌমিক বলছেন এ রকম তো হওয়ারই ছিল।

তার আগে একটু কলকাতা শহরের দিকে তাকানো যাক।

শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় হোক বা টালিগঞ্জের মেট্রো স্টেশন, দৃশ্যের কোনও রদবদল দেখতে পাবেন না কোথাও। দু’জায়গাতেই বাংলা ছবির হোর্ডিং, পোস্টারের ছড়াছড়ি। কেউ বলছে জমজমাট দ্বিতীয় সপ্তাহ, কেউ লিখছে ‘গ্লোরিয়াস ফিফ্টি ডেজ’, কেউ শুধু ‘সুপারহিট সুপারহিট সুপারহিট’।

বাংলা ছবির এমন ঢল যে ক্যালেন্ডারে ২০১৫-র জানুয়ারি মাস অবধি প্রত্যেক শুক্রবার দু’টো কী তার বেশি বাংলা ছবি রিলিজ করবে।

আর্টিস্টদের হাতে তাই কোনও ডেট নেই। স্টুডিয়োর ফ্লোর নিয়ে মারামারি মন্ত্রীমশাই সুরাহা করে দিচ্ছেন, এ সব তো আছেই। পরিচালকরাও প্রযোজকের অফিসে রোজ ‘ক্রিয়েটিভ মিটিং’ করছেন তাঁদের টিমের সঙ্গে। সিঙ্গাপুর, আমেরিকাতে ছবির প্রিমিয়ার আর স্ক্রিনিং তো লেগেই আছে।

দু’বছর আগেও যে আর্টিস্ট একটা ছবির জন্য ২ লক্ষ টাকা পেত, সে-ও আজ চাইছে ১০ লক্ষ টাকা। একজন পরিচালক (এঁর প্রথম ছবি বাংলাকে হাসিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিয়েছিল) তো আবার অনায়াসে ৪০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত রেমুনারেশন চেয়েছেন শুধু তাঁর নিজের জন্য।

আপাত দৃষ্টিতে মনে হতেই পারে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির এ যেন হানিমুন পিরিয়ড। কিন্তু সত্যি কি তাই? একেবারেই না। ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন মানুষজন বলছেন সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে বড় সঙ্কটের সামনে দাঁড়িয়ে টলিউড। অনেকে আবার খুশিও যে ফাইনালি বাংলা ছবির ‘বাবল’টা বার্স্ট করল।

এ রকম চললে অফিস বন্ধ করে দিতে বাধ্য হব

তাঁদের অনেকের মতেই গত এক বছরে ‘মিশর রহস্য’ এবং ‘চাঁদের পাহাড়’ ছাড়া কোনও ছবি প্রোডিউসরের ঘরে টাকা ফেরায়নি।

বড় প্রোডিউসররা তো এটাও মনে করছেন যে সামগ্রিক ভাবে বাংলা ছবির থেকে মুখ ফেরাচ্ছে দর্শক।

দক্ষিণী ছবির রিমেকও যে এক-এক করে মুখ থুবড়ে পড়ছে, তার সর্বশেষ উদাহরণ ‘অরুন্ধতী’। গেম’ও যতটা ভাল করবে মনে করা হয়েছিল, সেই অনুযায়ী ব্যবসা করতে পারেনি।

এবং সত্যি যদি কোনও ব্রেকিং নিউজ থাকে, তা হল স্যাটেলাইট মার্কেট যা এত দিন বাংলা ছবিকে অক্সিজেন জোগাত, সেটা অবিশ্বাস্য রকম ভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে গত দু’মাসে। শুধু এই শেষ কারণটার জন্যই হঠাত্‌ ভেন্টিলেটরে টলিউড।

অবস্থা এতটাই খারাপ যে, অশোক ধানুকার মতো প্রোডিউসর বলছেন এমন চললে তিন বছর পর তিনি অফিস বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন। একই মত পোষণ করছেন রানা সরকার বা শ্রীকান্ত মোহতাও। কিন্তু হলটা কি হঠাত্‌ ‘টলিউড শাইনিং’য়ের? বাংলা ছবির নবজাগরণ কি তা হলে পুরোটাই মিথ্যে ছিল?

ভেন্টিলেশন থেকে বেরোনোর প্রেসক্রিপশন

• কনটেন্ট বদলাতেই হবে। বিগ বাজেট ছবি মানেই রিমেক নয়

• বাজেট কমাতে হবে

• আর্টিস্টদের রেমুনারেশন ১০ থেকে ২০ শতাংশ কম করতে হবে

• জেলার হলগুলোর পরিস্থিতি ভাল করতে হবে। বন্ধ হলগুলো খুলতে হবে

• বাংলাদেশে বাংলা ছবি রিলিজ করাতে হবে

স্যাটেলাইট মার্কেটের অবস্থা স্পেন-এর ফুটবল টিমের থেকেও খারাপ

এর উত্তর পেতে হলে দু’বছর আগের এক সাক্ষাত্‌কারের দিকে ফিরে তাকাতে হয়।

শনিবারের ‘পত্রিকা’য় সেই সাক্ষাত্‌কারে টালিগঞ্জকে যিনি নিজের হাতের তালুর মতো চেনেন, সেই প্রসেনজিত্‌ চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “আমরা না বড্ড স্যাটেলাইট রাইটসের ওপর ভরসা করছি। কেউ সিনেমা হল থেকে কত টাকা এল, সেটা নিয়ে ভাবছে না। একটা স্বপ্নের জগতে আমরা বাস করছি। এতে এক সময় ঘোর দুর্দিন আসবে। তখন কিন্তু বাঁচতে পারব না আমরা।”

প্রসেনজিতের সেই ‘ওপিনিয়ন পোল’ কিন্তু জুন ২০১৪-তে পুরোপুরি মিলে গিয়েছে।

প্রসঙ্গত, স্যাটেলাইট রাইটস হল সেই মূল্য যা দিয়ে টিভি চ্যানেল প্রযোজকের কাছ থেকে একটি ছবি কেনে টিভিতে দেখানোর জন্য।

একটা সময় ছিল যখন বলে বলে বড় স্টার বা ‘শহুরে বুদ্ধিদীপ্ত ছবি’ টিভিতে দেখানোর জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়েছে স্টার বা জি-র মতো চ্যানেল।

কিন্তু আজ সেই বাজারের অবস্থা স্পেনের জাতীয় ফুটবল টিমের থেকেও খারাপ। একটা ছবির জন্য ১২-১৫ লক্ষ টাকার বেশি কোনও চ্যানেল দিতে চাইছে না প্রযোজককে। অবস্থা এতটাই সঙ্কটজনক যে একজন প্রযোজক কিছু দিন আগে ১৯-টি ছবি একটি চ্যানেলে বিক্রি করেছেন শুধুমাত্র ২ কোটি ১৬ লক্ষ টাকায়। গড় ধরলে এক-একটা ছবির জন্য তিনি পেয়েছেন মাত্র ১১ লক্ষ টাকা। কিন্তু হঠাত্‌ কেন আর বেশি টাকা দিয়ে ছবি কিনছে না চ্যানেলগুলো?

“কিনে কী লাভ বলুন। সেই তো সাউথের ছবির রিমেক কমার্শিয়াল ছবিগুলো। হিন্দি চ্যানেলগুলো তো সেই ছবিগুলো ডাব করে দেখিয়েই দিচ্ছে। তাহলে অত টাকা দিয়ে আমরা কিনব কেন। আর দ্বিতীয়ত, আমরা ছবি কিনতাম যাতে আরও বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছতে পারি এটা ভেবে। একটা সময় সিনেমা আমাদের ব্র্যান্ড বিল্ডিংয়ে সাহায্য করত। কিন্তু আজকে সেই কাজটা আমাদের রিয়ালিটি শো করে দিচ্ছে। তা হলে আর ফিল্মের কী দরকার?” বলছেন এক চ্যানেলের বড় কর্তা। বহু অনুরোধ করেছেন বলে তাঁর নামটা লেখা গেল না।

প্রোডিউসর তো আছেই লোকসান করতে

প্রসেনজিত্‌ যেমন বক্স অফিসের লক্ষ্মীর উপর ভরসা করতে বলছেন, সেই একই মত পোষণ করছেন অশোক ধানুকাও।

“বক্স অফিসের দিকে আমাদের আবার মুখ ফেরাতেই হবে। এবং এখানে একটাই অসুবিধে, পশ্চিমবঙ্গে হুহু করে সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

প্রত্যেক বছর জেলাতে গড়ে ৫০-টা হল বন্ধ হচ্ছে। এটা না আটকালে আমরা কিন্তু মরে যাব,” বলছেন অশোক।

তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল আজকের টলিউডে অনেকেই মনে করছেন কেউ যদি এই অবস্থা থেকে টলিউডকে বের করে আনতে পারেন, তিনি দেব।

“কমার্শিয়াল ছবি না চললে মাল্টিপ্লেক্স ছবি বানাবে কী করে প্রোডিউসর? এবং আপনাকে বলছি, বুম্বাদা অন্য লেভেল। বুম্বাদা ছাড়া একমাত্র দেব থাকলেই প্রোডিউসরের ঘরে টাকা আসবে। বাকি কেউ সেটার গ্যারান্টি দিতে পারে না। আর চিট ফান্ড আর কর্পোরেট প্রোডিউসরদের দৌলতে যে যা ইচ্ছে টাকা চাইছে। একজন স্টার তো ১ কোটি টাকা চাইছে। একজন পরিচালক যিনি ১২ লক্ষ টাকা নিতেন তিনি এখন ৩৫ লক্ষ দর হাঁকাচ্ছেন। এদের জন্যই ইন্ডাস্ট্রি মরে যাবে। আর বাকি আর্টিস্টদের কথা বলবেন না। তাঁরা আজকাল মুখের ওপর বলেন, “ছাড়ুন অশোকজি, প্রোডিউসর তো রয়েইছে লোকসান করার জন্য। জাস্ট ভাবুন, আর্টিস্টদের মানসিকতা,” সাফ বলছেন অশোক।

একটা ‘বাবল’য়ের উপর দাঁড়িয়েছিল পুরো ইন্ডাস্ট্রি

অশোকের সঙ্গে একমত প্রযোজক রানা সরকারও। “প্রোডিউসরদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। আজ নিজের ছবির প্রোমোশন করতেও আর্টিস্টরা টাকা চাইছে। এবং সব প্রোডিউসরের একই অবস্থা। কারও ছবি চলছে না। স্যাটেলাইট মার্কেট শেষ। গত এক বছরে শুধু ‘মিশর রহস্য’ আর ‘চাঁদের পাহাড়’ চলেছে। এবং এখানেও আমাদের ভেবে দেখতে হবে কেন চলেছে ছবিগুলো। চলেছে কারণ সেই সময় স্কুল-কলেজে ছুটি ছিল। ফেস্টিভ টাইম ছিল। তাই যদি হয়, তা হলে এত ফ্লপ ছবি কেন বানাবেন প্রোডিউসররা? আর্টিস্টদের দায় নেই, পরিচালকদের দায় নেই, সব লোকসান শুধু প্রোডিউসরদের। এটা হয় নাকি?” প্রশ্ন করছেন রানা।

তবে বাংলা ছবির যে এ রকম একটা সঙ্গিন পরিস্থিতি আসতই সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন ফ্লোরিডা অ্যাটলান্টিক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এবং চিত্র পরিচালক সুমন ঘোষ।

“দেখুন, এটা খুব পরিষ্কার বাংলা ইন্ডাস্ট্রি একটা ‘বাবল’য়ের উপর দাঁড়িয়েছিল। কোনও ইকনমিক মডেলই ছিল না ইন্ডাস্ট্রির। এক এক সময় ভাবতাম, ইন্ডাস্ট্রির মাথারা কি এটা নিয়ে ভাবছে না! আর আজ আমিও যখন ইন্ডাস্ট্রির একজন, তখন এটাও বলছি টিভি চ্যানেলরা যা টাকা দিত, সেটা দেখে আমার মনে হত এত ইনভেস্টমেন্টের রিটার্ন কত হবে সেটা কি তাঁরা ভেবে দেখছেন না? আর ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে বাংলা ছবি কোনও কদর পাচ্ছে না, এখানেও প্রোডিউসরদের তরফ থেকে যে হিসেব দেওয়া হয় সেগুলো নিয়ে ইন্ডাস্ট্রির বহু মানুষেরই সন্দেহ আছে। তাই আই অ্যাম নট সারপ্রাইজড্। বড্ড বেশি দিন ধরে আমরা কার্পেটের নীচে সরিয়ে রেখেছিলাম এই টলিউড শাইনিংয়ের ‘বাবল’টা,” অকপটে বলছেন ‘নোবেল চোর’-এর পরিচালক সুমন।

সুমন ঘোষের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত মৈনাক ভৌমিকও। তিনি অবশ্য এটাও মনে করছেন বড্ড বেশি দিন টলিউড নিজেকে ঠকিয়েছে।

“এই যে বাংলা ছবি রমরমিয়ে চলছে এটা শুধুই একটা পারসেপশন ছিল। গত দু’বছর ধরে এটা আমরা আমাদের মনকে বুঝিয়েছি। হলে গেলে বুঝতে পারবেন একটা ছবিও চলছে না। বড় বড় ছবি মুখ থুবড়ে পড়ছে, আর আমরা বলছি ৪ কোটি কী ৫ কোটি টাকার ব্যবসা করছে। কাকে ঠকাচ্ছি আমরা? তবে এটা ভাল লাগছে দেখে যে, ফাইনালি এই বাংলা ছবি রমরমিয়ে চলার মিথটা ভাঙল। এ বার কিন্তু বাজেটের দিকে মন দিতে হবে আমাদের। এক্সটিক লোকেশন, জলের মতো টাকা খরচ এগুলো এ বার বন্ধ হবে,” বলছেন মৈনাক ভৌমিক।

এই ফেজটা আমাদের কাটাতেই হবে

পরিস্থিতি যে সঙ্গিন সেটা মেনে নিচ্ছেন সুপারস্টার দেব-ও। এবং এর প্রধান কারণ যে বক্স অফিসের মুনাফা কমে যাওয়া তা মানতে দ্বিধা নেই তাঁর।

“আমি এত খারাপ সময় দেখিনি টলিউডের। এ বছর কোনও ছবি চলছে না। স্যাটেলাইটের বাজারটা শেষ। আমাদের থিয়েট্রিকালের কালেকশনের উপর নজর দিতেই হবে আবার।

তবে আমি আশাবাদী এ রকম সময় বেশি দিন থাকবে না । এগুলো এক-একটা ফেজ। এই সময়টা আমাদের সবাইকে দাঁতে দাঁত চেপে কাটাতে হবে,” বলছেন দেব।

এবং দেব এটাও মনে করেন একমাত্র কমার্শিয়াল বিগ বাজেট বাংলা ছবিই পারবে এই খারাপ সময় থেকে ইন্ডাস্ট্রিকে বার করে আনতে।

“কমার্শিয়াল সিনেমা এবং বক্স অফিস কালেকশন যে কোনও ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় দু’টো অস্ত্র। মাঝখানে আমরা সেটা ভুলে যাচ্ছিলাম। এই ধাক্কাটা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কমার্শিয়াল ছবিকে বাঁচতেই হবে। শাহরুখ, সলমন, আমিরের মসালা ছবি না হলে বলিউড কি ‘লাঞ্চবক্স’ বানাতে পারবে! এখানেও তাই,” সাফ বলছেন দেব।

কিন্তু বাংলা ছবিতে বক্স অফিস থেকে টাকা বাড়বে কী করে যখন একটার পর একটা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পশ্চিমবাংলায়?

“হ্যাঁ, আমি জানি সেটা একটা বিরাট সমস্যা। আমি ঘাটালের সাংসদ হওয়ার পর থেকেই মেদিনীপুর অঞ্চলের হলগুলোর অবস্থা ফেরানোর জন্য মিটিং শুরু করে দিয়েছি। কাজও এগোচ্ছে। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির মেরুদণ্ড হচ্ছে জেলার হলগুলো। সেগুলোকে ভাল করতেই হবে। তবেই না দর্শক এসে একটা ছবি সত্যি সত্যি এনজয় করবেন। আমি চেষ্টা করছি সব বন্ধ হলের মালিকদের সঙ্গে বসে একটা উপায় বের করার। এই নিয়ে দিদির সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে,” বলছেন তিনি।

দেবের সঙ্গে একমত নবীনা সিনেমা হলের মালিক নবীন চৌখানি-ও। “জেলার হলগুলো কেউ গিয়ে দেখেছে? ওখানে বাথরুমে যেতে পারবেন না। এসি নেই। হল মালিকদেরও দোষ দেবেন না। তাঁরা তো ব্যবসা করছে। যত দিন না আমরা জেলার হলের পরিকাঠামোর দিকে নজর দেব, তত দিন এই অবস্থা চলবে। খুব নোংরা রেস্তোরাঁয় দারুণ খাবার কে খেতে আসবে বলুন?” বলছেন নবীনা হলের নবীন চৌখানি।

এ ব্যাপারে কী বলছেন টলিউডের আর এক বড় স্টার জিত্‌? তাঁকে অনেক বার ফোন এবং এসএমএস পাঠানো স্বত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি আনন্দplus-এর এই প্রতিনিধির।

কমার্শিয়াল ছবি মানেই রিমেক নয়

হল বন্ধ হয়ে যাওয়া আর স্যাটেলাইট মার্কেট ক্র্যাশ করা ছাড়াও আরও বেশ কিছু কারণ যে রয়েছে বাংলা ছবির এই দুরবস্থার এমনটাই মনে করেন রিলায়্যান্স এন্টারটেনমেন্টের শিবাশিস সরকার।

“আমাদের প্রথমেই মনে রাখতে হবে কমার্শিয়াল বাংলা ছবি মানেই রিমেক ছবি এই ট্রেন্ডটা আর চলছে না। কনটেন্ট আমাদের বদলাতেই হবে। হ্যাঁ, বলিউডেও রিমেক হচ্ছে। কিন্তু তার সঙ্গে অন্য ধরনের কমার্শিয়াল ফিল্মও হচ্ছে। কিন্তু বাংলায় কমার্শিয়াল ছবি মানেই রিমেক, এটা বন্ধ করতেই হবে। দ্বিতীয়ত, আমাদের সাহিত্য নির্ভর ছবি করতে হবে বা গল্পে বাঙালিয়ানার স্বাদ রেখে ছবি বানিয়ে যেতে হবে। আর তৃতীয়ত, বাজেট কমাতেই হবে। না কমালে আমি শ্রীকান্ত বা অশোকজির সঙ্গে একমত যে, সারভাইভ করা যাবে না এই স্যাটেলাইট রেট এই ভাবে ক্র্যাশ করার পরে,” মুম্বই থেকে জানাচ্ছেন শিবাশিস।

আমার কিন্তু ভয় লাগছে

পরিস্থিতি এমনই যে কমার্শিয়াল বাংলা ছবির এক নম্বর পরিচালক রাজ চক্রবর্তী বলছেন পুরো পরিস্থিতি দেখে তাঁর ভয় লাগছে।

“একটা ভয় হচ্ছে। এ রকম চললে ইন্ডাস্ট্রি সারভাইভ করবে কী করে? জেলার হলগুলো আমাদের সারাতেই হবে। ওটা হলে, আমাদের ছবি যেমন ওখানে চলবে, তেমনই কৌশিকদা বা সৃজিত-এর ছবিও চালানো যাবে। মাকের্টটা বাড়াতেই হবে আমাদের,” বলছেন রাজ।

কিন্তু শিবাশিস সরকার বা অন্যরা যে মনে করছেন কমার্শিয়াল ছবি মানেই রিমেক, এই ফর্মুলা থেকে বেরোতে হবে ইন্ডাস্ট্রিকে। সে প্রসঙ্গে তিনি কী বলছেন? তাঁর পরের ছবি ‘যোদ্ধা’ও তো রিমেক?

“রিমেক নিয়ে অসুবিধা নেই। কিন্তু প্রবলেম হচ্ছে যে-ছবির রিমেক আমরা করছি, সে ছবিগুলো হিন্দিতে ডাব করে টিভিতে দেখিয়ে দিচ্ছে। সেটা একটা বিরাট সমস্যা। আমি একটা প্ল্যান বি রেডি রাখছি। লীলা মজুমদার বা শরদিন্দু-র গল্প নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছি। না-হলে সারভাইভ করা ডিফিকাল্ট হবে,” বরাবরের মতো নিজের মনের কথা খোলাখুলি বলছেন রাজ।

কিন্তু এগুলো ছাড়াও আরও কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে টলিউড। এমন বেশ কিছু নতুন প্রোডিউসর এসেছেন, যাঁরা হল-মালিকদের অ্যাডভান্স টাকা দিচ্ছেন ছবি চালানোর জন্য।

“আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। হাত জোড় করে প্রোডিউসরদের বলছি আমাকে হলের ভাড়া দেবেন না, কিন্তু তাঁরা নাছোড়বান্দা। আমাকে একসঙ্গে প্রায় ৫০ দিনের রেন্টাল দিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। তারপর জায়গায় জায়গায় বলছেন, প্রিয়াতে ছবি ৫ সপ্তাহ চলেছে। কিন্তু এতে সেই প্রোডিউসরের ইগো স্যাটিসফ্যাকশন ছাড়া আর তো কিছু হচ্ছে না।

আর কমার্শিয়াল বাংলা ছবি?

দ্যট’স গন। এখন টিভি চ্যানেলগুলো আর খরচ করছে না। ইট’স আ ভেরি ভেরি ব্যাড টাইম,” সাফ বলছেন অরিজিত্‌ দত্ত।

যে কোনও ব্যবসায় ওঠাপড়া থাকেই। সিনেমা আলাদা হবে কেন?

কিন্তু মাল্টিপ্লেক্সের ছবিগুলো তো মানুষ দেখছে। সেই নিয়ে কাগজে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা হচ্ছে। সেই ছবি কি বাঁচাতে পারে না টলিউডকে?

“শহুরে আর্বান ছবির বাজেট যত দিন ৭৫ থেকে ৯০ লাখ টাকা ছিল তত দিন ব্রেক ইভেনের চান্স থাকত। এখন সেই বাজেটটাও বেড়ে দেড় কোটি হয়েছে। ‘জাতিস্মর’য়ের মতো ছবির ক্ষেত্রে তো সেটা সাড়ে তিন কোটিতে পৌঁছেছে। আর বাংলায় মাল্টিপ্লেক্স তো রয়েছে ২৬টা। ওই টাকাটা এত কম হল থেকে রিকভারি সম্ভব নয়,” বলছেন রানা সরকার।

রানার সঙ্গে অবশ্য একমত নন পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। “দেখুন, যে কোনও ব্যবসায় ওঠাপড়া থাকেই। সিনেমা আলাদা হবে কেন? আমি ব্যবসাসচেতন পরিচালক, তাই ঘুড়ি আমি নাগালের বাইরে খেলি না। বরং ঘুড়ি আর মাঞ্জার মান যাতে ভাল তাকে, সেই দিকে লক্ষ রাখার চেষ্টা করি। তাই আমার পাশে প্রোডিউসরও রয়েছেন।

খুব বেড়ে খেললে হঠাত্‌ বৃষ্টি এলে ঘুড়ি-সুতো দুই খোয়াবার ভয় আমার সারাক্ষণ। এই ভয়টা যেন চিরকাল থাকে,” স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন কৌশিক।

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সহ সহমত পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ও। তিনিও মনে করছেন, এটা একটা ফেজমাত্র। “আমার মনে হয়, এটা একটা টেম্পোরারি ফেজ।

এই মুহূর্তেই প্যানিক বাটনের দরকার নেই। সব ইন্ডাস্ট্রিতেই এই রকম ওঠাপড়ার সাইক্ল থাকে।

আর অর্থনীতির ছাত্র বলে বলছি, যে কোনও সিচ্যুয়েশনকে ক্রাইসিস সিচ্যুয়েশন বলার আগে অন্তত দু’বছর দেখা উচিত। আর এখানে তো সবে ছ’মাস হয়েছে। দু’টো বিগ-বাজেট কমার্শিয়াল ছবি হিট করে গেলেই পরিস্থিতি বদলে যাবে,” বলছেন সৃজিত।

একসঙ্গে চিন্তায় পড়েছেন রিলায়্যান্স, অশোক আর ভেঙ্কটেশ

তবে কমার্শিয়াল বাংলা ছবি থেকে যে ভাল জায়গায় রয়েছে শহুরে মাল্টিপেক্স ছবি, সেটা এই মুহূর্তে পরিষ্কার। কিন্তু শুধু তার উপর ভরসা করে যে ভেন্টিলেটর থেকে বার করা যাবে না টলিউডকে, মেনে নিচ্ছেন প্রায় সবাই।

ভেঙ্কটেশ ফিল্মস্‌ কী বলছে এই পুরো প্রসঙ্গে? ইন্ডাস্ট্রির এক নম্বর প্রোডাকশন হাউজ হিসেবে তাদের কী মত?

“নো কমেন্টস্‌। সময় এলে ঠিক এটা নিয়ে কথা বলব আমি,” বলছেন ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের কর্ণধার শ্রীকান্ত মোহতা।

পরিস্থিতি আজ এতটাই গম্ভীর যে, হাসিখুশি টলিউডের বডি ল্যাঙ্গোয়েজটাই গত দু’মাসে বদলে গিয়েছে।

আড্ডায় বসলেই সবাই প্ল্যান করছেন, কী করে এই পরিস্থিতি থেকে বেরোনো যায়। চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে সৃজিত থেকে রাজ থেকে মৈনাককে। এই প্রথম একসঙ্গে চিন্তায় পড়েছেন ভেঙ্কটেশ থেকে রিলায়্যান্স থেকে অশোক ধানুকা।

সবাই সবার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। পুজো দিচ্ছেন তিরুপতি থেকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে।

কথায় আছে না, ‘যব জমিন লাগা ফাটনে, তব প্রসাদ লাগা বাটনে’।

টলিউডের অবস্থাটাও এখন ঠিক তাই।

“বাংলা ইন্ডাস্ট্রি একটা ‘বাবল’য়ের উপর দাঁড়িয়েছিল। কোনও ইকনমিক মডেল ছিল না। এক এক সময় ভাবতাম,
ইন্ডাস্ট্রির মাথারা কি এটা নিয়ে ভাবছে না? বড্ড বেশি দিন ধরে আমরা কার্পেটের নীচে সরিয়ে রেখেছিলাম এই ‘বাবল’টা”

সুমন ঘোষ

“বড় বড় ছবি মুখ থুবড়ে পড়ছে, আর আমরা বলছি ৪-৫ কোটি টাকার ব্যবসা করছে। কাকে ঠকাচ্ছি আমরা?
তবে এটা ভাল লাগছে দেখে যে, ফাইনালি এই বাংলা ছবি রমরমিয়ে চলার মিথটা ভাঙল”

মৈনাক ভৌমিক

“আমি এত খারাপ সময় দেখিনি টলিউডের। এ বছর কোনও ছবি চলছে না। স্যাটেলাইটের বাজারটা শেষ।
আমাদের থিয়েট্রিকাল কালেকশনের দিকে নজর দিতেই হবে। তবে আমি আশাবাদী এ রকম সময় বেশি দিন থাকবে না”

দেব

“কমার্শিয়াল ছবি না চললে মাল্টিপ্লেক্স ছবি বানাবে কী করে প্রোডিউসর? একজন স্টার তো ১ কোটি টাকা চাইছে,
একজন পরিচালক যিনি ১২ লক্ষ টাকা নিতেন তিনি এখন ৩৫ লক্ষ দর হাঁকাচ্ছেন। এদের জন্যই ইন্ডাস্ট্রি মরে যাবে”

অশোক ধানুকা

“দেখুন, যে কোনও ব্যবসায় ওঠাপড়া থাকেই। সিনেমা আলাদা হবে কেন? আমি ব্যবসাসচেতন পরিচালক,
তাই ঘুড়ি আমি নাগালের বাইরে খেলি না। বরং ঘুড়ি আর মাঞ্জার মান যাতে ভাল থাকে, সেই দিকে লক্ষ রাখার চেষ্টা করি।”

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়

“একটা ভয় হচ্ছে। এ রকম চললে ইন্ডাস্ট্রি সারভাইভ করবে কী করে? জেলার হলগুলো আমাদের সারাতেই হবে।
ওটা হলে, আমাদের ছবি যেমন ওখানে চলবে, তেমন কৌশিকদা বা সৃজিতের ছবিও চালানো যাবে”

রাজ চক্রবর্তী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement