বাঁ দিক থেকে দেবযানী, গৌরব এবং আর্যা
স্বজনপোষণ নিয়ে বলিউড এখনও সরগরম। রোজই কর্ণ জোহর, সলমন খান-সহ একাধিক অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালককে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে স্বজনপোষণকে কেন্দ্র করে। চর্চা থেকে বাদ নেই টলিপাড়াও। একাধিক ফেসবুক লাইভে শ্রীলেখা মিত্র আঙুল তুলেছেন টলিপাড়ার প্রথম সারির প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রীদের দিকে। তাঁর দাবি, টালিগঞ্জের বিশেষ রসায়ন তাঁর কাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
টলিপাড়ার যদি এই হাল হয় টেলিপাড়া বা ছোটপর্দার দুনিয়ার ছবিটা কেমন?
দীর্ঘদিন অভিনয়ের সুবাদে টেলিপাড়ার অনেক কিছুর সাক্ষ্মী দেবযানী চট্টোপাধ্যায়। তিনি ‘স্বজনপোষণ’ শব্দটাতেই ভয়ানক আপত্তি জানিয়েছেন।
কারণ? অভিনেত্রীর জোরালো দাবি, ‘‘বলিউডে নেপোটিজম বা স্বজনপোষণের সুযোগ রয়েছে। টলিউড এবং টেলিপাড়ায় সেই সুযোগটাই নেই। একে পক্ষপাতিত্ব বলা উচিত। স্টারের ছেলে স্টার হলে তাকেই আক্ষরিক অর্থে স্বজনপোষণ বলে। টালিগঞ্জে কোনও স্টারের ছেলে স্টার নয়। ফলে, স্বজনপোষণও নেই!’’
এখানেই থামলেন না দেবযানী। বললেন, ‘‘এটা তো নতুন ঘটনা কিছু নয়। শুধু অভিনয় কেন, সব ইন্ডাস্ট্রিতেই আছে ফেভারিটিজম বা গ্রুপিজিম।কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করেই তাই বলছি, পছন্দের লোককে কাজ পাইয়ে দেওয়ায় আমাদের ইন্ডাস্ট্রির কোনও উন্নতি হয়নি সে ভাবে। এখানে যদি সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকত, তাহলে উন্নতি অবধারিত ছিল।’’
যেমন? অভিনেত্রীর প্রাঞ্জল উত্তর, একজন পরিচালক একজন নায়ক বা নায়িকাকে নিয়ে কাজ করতেই পারেন। কিন্তু তাতে যদি অন্যেরা বঞ্চিত হন, সেটা ইন্ডাস্ট্রির উন্নতির পক্ষে ক্ষতিকর। এবং বাঞ্ছনীয়ও নয়। দেবযানী প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক, ‘‘কেন এখনও বাংলা ছবির দুনিয়ায় হাতেগোনা কিছু পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা-অভিনেত্রী রয়েছেন? তাঁরাই কেন ঘুরেফিরে কাজ করে যাবেন? কেন মানাক না মানাক, জোর করে একই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে চলবে টলিউড? কেন নতুন প্রোডাকশন হাউজ তৈরি হচ্ছে না?’’
দেবযানী কি তাহলে আগে বলা টলিউডের সেই বিশেষ রসায়নকেই ঘুরিয়ে মান্যতা দিলেন? সেটি অবশ্য জানা যায়নি।
টলিপাড়ায় স্টারের ছেলে স্টার হিসেবে কাজ না করলেও স্টারের দুই নাতি টেলিপাড়ায় রয়েছেন। মহানায়ক উত্তমকুমারের নাতি গৌরব চট্টোপাধ্যায়। সুপ্রিয়া দেবীর নাতি শন বন্দ্যোপাধ্যায়। শনের ঝুলিতে আপাতত একটি মেগা, ‘এখানে আকাশ নীল’। যার দৌলতে দর্শক মহলে তিনি যথেষ্ট পরিচিত। অন্যদিকে, গৌরবের ঝুলিতে একাধিক ছবি এবং জনপ্রিয় ধারাবাহিক।
প্রথম যেদিন অভিনয়ে এলেন, ‘মহানায়কের নাতি’ এই পরিচয় তাঁকে কতটা সাহায্য করেছিল? গৌরবের কথা শুনে বোঝা গেল, এই তকমা তাঁকে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারে তেমন সাহায্য করেনি। গৌরবের যুক্তি, ‘‘আমার বাবা যেহেতু অভিনয় দুনিয়ার মানুষ ছিলেন না, তাই কাজের ক্ষেত্রে তাঁর কোনও প্রভাবই খাটেনি। আর মহানায়কের নাতি হওয়ার জন্য সুবিধে পাওয়ার বদলে সমালোচিতই হতে হয়েছে বেশি।’’
কেমন সেই সমালোচনা? ‘করুণাময়ী রাণী রাসমণি’র ‘মথুরবাবু’র কথা অনুযায়ী, প্রথমেই চেহারার তুলনা টেনেছে সবাই।
‘‘ওই দাদুর এই নাতি!’’ এমন বিস্মিত প্রশ্নও শুনতে হয়েছে তাঁকে। তুলনা এসেছে অভিনয় ক্ষমতা নিয়েও। মহানায়কের মতো কি গৌরব আদৌ হতে পারবেন?
কী উত্তর দিয়েছেন গৌরব তখন? সহজ করে জানালেন, ‘‘আমি অবশ্যই চলচ্চিত্রের পরিবারের। কিন্তু অনেক বড় বয়স পর্যন্ত অভিনয়, সিনেমা থেকে দূরেই ছিলাম। পাশাপাশি, দাদুর সঙ্গে আমার তুলনা টানাই বাতুলতা। দাদু যে উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেটা আমিও পারব, এই ধরনের আলোচনা প্রথম প্রথম সামান্য মনখারাপ করে দিত। পরে সবাইকে বলেছি, আমি আমার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করছি। পরে কী হবে সেটা সময় বলবে।’’
নেপোটিজম না হয় হয়নি। পক্ষপাতিত্বও কি কাজ করেনি? গৌরব এ বারেও এই যুক্তি নস্যাৎ করলেন, ছবি বা সিনেমা সমস্ত জায়গাতেই তিনি পরীক্ষায় পাশ করে তবে সুযোগ পেয়েছেন। ফলে, কোনও কিছুই তাঁর ‘হয়ে গিয়েছে’ এমনটা হয়নি।
‘ফিরকি’ ধারাবাহিকের বৃহন্নলা ‘লক্ষ্মী’ আর্যা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু এ বিষয়ে সবাক। প্রশ্ন রাখতেই সপাট জবাব,‘‘হ্যাঁ, আমি স্বজনপোষণের স্বীকার। টেলি, টলি দুই পাড়াতেই।’’
কী হয়েছিল আর্যার সঙ্গে? অভিনেত্রীর স্বীকারোক্তি, ‘‘রূপসী বাংলার দেবী চৌধুরাণী মেগায় প্রথমে আমায় নির্বাচন করা হয়েছিল মুখ্য চরিত্রে। তিন মাসের প্রশিক্ষণও নিয়েছিলাম ঘোড়ায় চড়া, তলোয়ার চালানোর। তারপর হঠাৎ একদিন দেখি, ওই চরিত্রে অভিনয় করতে এলেন পরিচালক-অভিনেত্রী শতরূপা সানাল্যের মেয়ে চিত্রাঙ্গদা চক্রবর্তী।’’
আর্যার আরও দাবি, দেবী চৌধুরাণীর সঙ্গে তাঁর চেহারা, চলনবলন মানানসই বলেই তাঁকে ভেবেছিল প্রযোজক সংস্থা। কিন্তু তাঁর খুঁটির জোর ছিল না। ফলে, বাদ পড়ে যান।
টলিপাড়াতেও কি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল? এ বারে আর্যা আরও স্পষ্ট করে বললেন,‘‘একটি বাংলাছবিতে একটি বিশেষ চরিত্রের জন্য আমায় বেছেছিলেন পরিচালক। কিন্তু সারাক্ষণ তিনি আমায় ভয় দেখাতেন,বাদ দিয়ে দেবেন বলে। তাই দৃশ্যের শুটের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমার বিকল্প খুঁজেছেন তিনি।’’
এটুকুই যথেষ্ট নয়, দাবি আর্যার, ‘‘ওই পরিচালক সব সময় বলতেন, সিনে যেটা হবে দরকারে সেটা তাঁর সামনে করে দেখাতে হবে। সাংবাদিকদের একটা সাক্ষাৎকারও নিতে দেননি আমার। কোনও সংলাপ ছিল না। অথচ ১০ মিনিটের ওই নীরব অভিনয় আমায় মুম্বইয়ের ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ডের দুটো নমিনেশন এনে দিয়েছিল।’’
কিন্তু আপনার তো প্রথম ছবি ‘উড়নচণ্ডী’, গুগল তাই বলে! অভিনেত্রীর গলায় ক্ষোভ ঝরল আবার, যত বার তিনি এটা বদলাতে গিয়েছেন, তত বার নাকি এই তথ্য মুছে দেওয়া হয়েছে।
আর্যার মতে,মডেলিং, শহুরে ঝাঁ-চকচকে, পুতুল পুতুল চেহারা হলে সবাই পাত্তা দেন। শহরতলির গ্রাম্য চেহারায় যতই অভিনয়ের আগুন লুকিয়ে থাক, তাকে প্রকাশ্যে আনতে আজও আগ্রহ নেই কারও।