১৯ মে ২৫ বছর পূর্ণ হল ঋদ্ধি সেনের। জন্মদিন পালনের বাড়াবাড়ি কি তিনি পছন্দ করেন? ছবি: সংগৃহীত।
শুটিংয়ে শুটিংয়ে ক্লান্ত। তবু শুটিংই তাঁর সর্বাধিক ভাললাগা। আপাতত ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবির কাজে ব্যস্ত ঋদ্ধি সেন শান্তিনিকেতন থেকে সদ্য ফিরেছেন কলকাতায়। শহরেও কাজের বিরাম নেই। আঁটসাঁট ব্যস্ততা। তার ফাঁকেই সময় পাওয়া গেল। লোকে বলে, বয়সে তরুণ হলেও গুরুগম্ভীর ভাবনায় তিনি এগিয়ে বছর বিশেক। পঁচিশ বছর বয়সে তাই ফিরে দেখা আটপৌরে ঋদ্ধিকে। তিনি আদতে বাবা-মায়ের ‘ভাল ছেলে’ না ‘দুষ্টু’?
প্রশ্ন: পঁচিশ বছরে এসে আলাদা কোনও অনুভূতি হচ্ছে? কী ভাবে উদ্যাপনের পরিকল্পনা?
ঋদ্ধি: মানুষ হিসাবে আমি যে বদলালাম বা বড় হলাম, সেই অনুভূতিটা আমার দু’মাস বা ছ’মাস অন্তরও আসতে পারে। কারও ক্ষেত্রে একটা বছর পেরোনোর পরেও মনে হতে পারে, কিছুই হয়নি। কেউ হয়তো এক দিনেই মনে করতে পারে, বয়স বাড়ল বা কমল। জন্মদিনের সঙ্গে তার যোগ নেই। অনেকে দিনটার বিশেষ উদ্যাপন পছন্দ করেন। আমার ক্ষেত্রে একটু বড় হয়ে যাওয়ার পরে সেটা আর তত জরুরি মনে হয় না। তবে দিনটা তো বিশেষ বটেই। কেউ শুভেচ্ছা জানালে কার না ভাল লাগে?
প্রশ্ন: ‘বড় হয়ে ওঠা’ আপনার কাছে কী?
ঋদ্ধি: কঠিন প্রশ্ন! আসলে ছোটবেলায় তো আমরা সবই সাদা-কালো দেখি। মানুষ প্রকৃতপক্ষে যত বড় হয়, তত সে তার চারপাশকে, আশপাশের মানুষজনকে এবং নিজেকে আর সাদা-কালোয় আবদ্ধ রাখতে পারে না। কারণ, তখন সে নিজের সঙ্গে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিটাও বুঝতে শেখে। সে বোঝে, একটা মানুষের ভিতরে আসলে অনেকগুলো মানুষ থাকে। মনে হয়, ভয়ের জায়গাটাও কমে আসা উচিত তার।
প্রশ্ন: কী নিয়ে ভয় হয় আপনার?
ঋদ্ধি: আসলে জীবন এমনই একটা ঘটনা, যেটা যে কোনও মুহূর্তে শেষ হয়ে যেতে পারে। সেই ভয়টা তো তাড়িত করেই। মৃত্যু বিষয়টা যখন বুঝতে শিখেছি, তখন এই শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়টা কাজ করেছে। তবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই বোধটা হয় যে, সব কিছু এক দিন শেষ যাবে বলেই হয়তো এই মুহূর্তটা এত সুন্দর। ভয়টা চলে যায় না। কিন্তু সেটার সঙ্গে আর একটু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি, এই ভয়টার সঙ্গে একটা ঘরের ভিতরেই ঘর-সংসার করতে হবে। সেটা নিশ্চয়ই বড় হয়ে উঠতে সাহায্য করে।
ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: মাত্র ২৫ বছর বয়সেই আপনার যে গম্ভীর, বিজ্ঞ একটা ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, এটার জন্য কথা শুনতে হয়েছে কোথাও?
ঋদ্ধি: হ্যাঁ। আমি ছোটবেলা থেকেই এটা শুনে আসছি। অনেকে আমাকে পাকা বলে। প্রথমে খারাপ লাগত। এখন লাগে না। আর সত্যিই, কোন বয়সে কে কী কথা বলবে, এ তো কোনও অভিধানে লেখা নেই। সংবিধানেও এমন কোনও নিয়ম নেই। বাঙালি বা ভারতীয় সমাজে এই বয়স অনুযায়ী আচরণ নির্দিষ্ট করার প্রবণতা দেখি। ১৬ বা ১৭ বছর বয়সে দু’জন ছেলেমেয়ে প্রেম করলে বলা হবে এটা প্রেম করার বয়স নয়। আবার ৩৫ বছর বয়সে গিয়ে যদি সেই বাড়ির ছেলের বা মেয়ের বিয়ে না হয়, তখন বলা হবে, এ কী! বিয়ে হচ্ছে না কেন?
অনেকে এখানে অভিজ্ঞতার কথা তুলবেন। আমি যদি আমার ১৫ বছর বয়সের অভিজ্ঞতা দিয়েই নিজের কথাগুলো ব্যক্ত করতে পারি, সেটা কেন আটকানো হবে? আসলে সমাজ বোধহয় চায়, আমরা কাঁচা হয়েই থেকে যাব। আমার চেনা দেখা, চেনা পরিবেশের, চেনা ভাবনাচিন্তার বাইরে কেউ কিছু বলতে গেলেই তাকে ‘পাকা’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়।
প্রশ্ন: আপনি তো প্রথাগত লেখাপড়া খুব বেশি করেননি। এটা নিয়ে আপনার মধ্যে কোনও হীনম্মন্যতা আছে?
ঋদ্ধি: না, নেই। প্রথাগত পড়াশোনা মানুষকে যে সব ক্ষেত্রেই বেশি শিক্ষিত করে এমন উদাহরণ পাইনি। আমি স্কুলে দশম শ্রেণি অবধি পড়ার পর প্রাইভেটে পড়েছি। মা উচ্চশিক্ষিত, ফিলোজফি এবং সাইকোলজিতে মাস্টার্স করেছিলেন। বাবাকে সংসারের দায়িত্ব নিয়ে কলেজের মাঝপথেই লেখাপড়া ছাড়তে হয়। তবে বাবার যা জ্ঞান, পড়াশোনা দেখেছি, অনেক তথাকথিত শিক্ষিত লোকজনের মধ্যেও সেটা দেখিনি। আর আমি প্রথাগত ওই পদ্ধতিতে বিশ্বাস করি না বলেই আমার মধ্যে এটা নিয়ে কোনও হীনম্মন্যতা নেই। আমার পরিবার আমাকে সেই ভাবেই বড় করেছে।
প্রশ্ন: স্কুলে কখনও চিটিং করেছেন? ধরা পড়েছেন?
ঋদ্ধি: করেছি, কিন্তু ধরা পড়িনি। একটা পরীক্ষাতেই করেছি। সেটা অঙ্ক। অঙ্কে আমি খুব খারাপ ছিলাম। তবে চিটিং করে লাভ হয়নি। অঙ্ক পরীক্ষায় চিট করে দেখেছি নিজেই ঠকেছি! ক্লাস সিক্সে একশোয় ১৩ পাওয়ার পর মা-বাবা আমায় খাইয়েছিলেন। ওঁরা নিজেরাও অঙ্কে খুব খারাপ ছিলেন। অঙ্কে সবচেয়ে বেশি পেয়েছিলাম ৪৫। ওটাই ছিল পাশ নম্বর।
প্রশ্ন: নিজেকে পলিটিক্যালি কারেক্ট বলে মনে করেন?
ঋদ্ধি: না! পলিটিক্যালি কারেক্ট হওয়ার কোনও সংজ্ঞা এখনও অবধি খুঁজে পাইনি। এটা ব্যক্তিবিশেষে আলাদা আলাদা হয়।
প্রশ্ন: আর আদর্শ?
ঋদ্ধি: আদর্শ ব্যাপারটাও বদলাতে বদলাতে যায়। এক জন মানুষ একই আদর্শ নিয়ে বাঁচতে পারে না। এখন এই বয়সে আমার কিছু আদর্শ নিশ্চয়ই তৈরি হয়েছে। আমার নিজের কাজ যেমন, একটা মিউজ়িক ভিডিয়ো বানানো বা একটা ছোট ছবি বানানো, যা আমি করেছি, তার মধ্যে আমার আদর্শের বা বক্তব্যের একটা প্রতিফলন আছে। তবে এখন আমার বদলানোর সময়। এই ২৫ বছর বয়সে আমি বলতে পারব না যে, হ্যাঁ, আমি এই আদর্শেই বিশ্বাস করি।
প্রশ্ন: পাড়ার দোকানে বসে বন্ধুদের সঙ্গে গুলতানি করেছেন কখনও?
ঋদ্ধি: নাহ্, আসলে পাড়ার বন্ধু আমার কখনও হয়নি। হরিশ মুখার্জি স্ট্রিটে প্রথম বারো বছর, তার পরে কালিকাপুর পূর্বালোকে। দুটো পাড়াই খুব মিষ্টি, কিন্তু আমার বন্ধু হয়নি। আসলে আমার মেশার পরিধিটা বরাবর আলাদা ছিল। স্কুলের বাইরে আমার মেশার জায়গা ছিল ‘স্বপ্নসন্ধানী’। সেখানে সবাই আমার দ্বিগুণ বয়সি। আর ১৫ বছর বয়স থেকে আমি যখন সিনেমা করতে শুরু করি, তখন ফিল্ম ইউনিটের লোকজনের সঙ্গেই বেশি বন্ধুত্ব হয়েছে।
প্রশ্ন: আর ওই বয়ঃসন্ধিতে মেয়ে দেখা, একটু টিপ্পনী— এই সব?
ঋদ্ধি: মেয়ে দেখা তো ছিলই। সেটা তো ওই সময়ের খুব স্বাভাবিক ঘটনা। একদল মেয়ে এবং ছেলে পরস্পরকে দেখবে। নারী আর পুরুষ একে অপরের প্রতি একটা আকৃষ্ট হওয়ার জায়গা তো থাকেই। কতগুলো মিষ্টি ব্যাপার হয়। যাকে ভাল লাগে, তাকে দেখে লুকিয়ে পড়া বা বেশি স্বাভাবিক ব্যবহার করা— এই রকম। তার মধ্যে মিসোজিনিস্ট কিছু ছিল না। আলাদা করে লিঙ্গপরিচয় দিয়ে চিহ্নিত করার ব্যাপার ছিল না। সেটাতে আমার চেয়ে আমার বন্ধুবান্ধবের কৃতিত্ব বেশি। তারা কখনও এমন আলোচনা করেনি। বাড়িতেও কখনও ওই বিভাজন বা অসম্মানজনক ভাবে দেখার ব্যাপার ছিল না।
প্রশ্ন: নিজেকে কি ভাল ছেলে বলবেন তা হলে?
ঋদ্ধি: আমি কোনও লেবেলিংয়ে বিশ্বাস করি না। কাউকে কেন ‘দুষ্টু’ বলা হবে, কেন ‘ভাল’ বলা হবে আমি জানি না। আমার পড়াশোনা থেকেই এই বোধটা এসেছে। নবারুণ ভট্টাচার্যের লেখা থেকে বলব, আমি কোনও ইনস্টিটিউশনে বিশ্বাস করি না।
প্রশ্ন: দুষ্টুমির জন্য বকুনি খেয়েছেন?
ঋদ্ধি: হ্যাঁ, ছোটবেলায় বাড়িতে খুবই বকুনি খেয়েছি। মারধরও খেয়েছি। যদিও সাংঘাতিক কোনও দুষ্টুমি করিনি। তবে বাবার কাছে বকুনিটা ছিল কোভিশিল্ড বা কোভ্যাকসিনের মতো। বছরে এক বার ওটা পড়লে আর সারা বছর দুষ্টুমির ভাইরাসটা ছোঁবে না। আর মায়ের ব্যাপারটা ছিল সর্দিকাশির অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার মতো! ওই চুলের মুঠি নেড়ে দেওয়া, কানমলা। প্রায় রোজই হত। তবে ক্লাস এইট-নাইনের পর আর সেটা হয়নি। স্কুলেও বদমায়েশি করতাম। কিন্তু শিক্ষকরা আমায় খুব ভালবাসতেন। বকুনি খাইনি তেমন।
প্রশ্ন: সুরঙ্গনার সঙ্গে সম্পর্কে আছেন প্রায় ৮ বছর। এর মধ্যে অন্য মেয়ের দিকে তাকিয়েছেন?
ঋদ্ধি: হ্যাঁ, অবশ্যই।
প্রশ্ন: প্রেম হয়েছে?
ঋদ্ধি: প্রেম খুব ভারী শব্দ বলে আমার মনে হয়। আজকাল খুব হালকা ভাবে আমরা কথাটা ব্যবহার করি যে, ‘আমি প্রেমে পড়ে গিয়েছি’। কিন্তু ‘লভিং’ আর ‘লাইকিং’— দুটো তো আলাদা বিশেষণ। ইনফ্যাচুয়েশন নিশ্চয়ই হয়েছে। প্রেমটা তো শুধুমাত্র একটা অনুভূতি নয়। কিন্তু এই অনুভূতিটাই একটা সম্পর্ককে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। প্রেমটা সূচনা। তার পর যে বন্ধুত্বটা, সেটার জন্য হার্ড ওয়ার্ক চাই। একটা সম্পর্ক এমনি এমনি প্রেমের দিকে এগোয় না। আমার বরাবরই মনে হয়, সেটার জন্য পরিশ্রম জরুরি। একটা সম্পর্ক এগোয় অনেকটাই স্বচ্ছতার জন্য।
প্রশ্ন: ইনফ্যাচুয়েশনটা কী ভাবে সামলেছেন?
ঋদ্ধি: সেটা বেড়েছে। সুরঙ্গনাও সেগুলো জানে। ওরও কারও ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে, ও বলেছে। কখনও আমরা দু’জন দু’জনকে বলার জন্য অপেক্ষা করে থেকেছি। সেটা নিয়ে একে অপরের পিছনে লেগেছি। আমাদের বন্ধুবান্ধবরাও সেগুলো জানে। আমাদের সম্পর্কের স্বচ্ছতার কারণেই এগুলো নিয়ে আমরা খোলাখুলি আলোচনা করেছি। একটা আদর্শ বন্ধুত্বে এটাই হওয়া উচিত। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আর আমার গার্লফ্রেন্ড আমার কাছে একই।
ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: সম্পর্কে থাকাকালীন কখনও পর্নোগ্রাফি দেখেছেন?
ঋদ্ধি: আমি আর সুরঙ্গনা দু’জন একসঙ্গেও পর্নোগ্রাফি দেখেছি। কোনও সামাজিক নিষেধাজ্ঞা এ ব্যাপারেও মানি না। অনেক সময় সুরঙ্গনা ভাল পর্ন দেখে থাকলে আমাকে বলেছে, এটা দেখিস পারলে।
প্রশ্ন: অভিনয়ে বাবাকে ছাপিয়ে যাওয়ার কথা কখনও মনে হয়েছে?
ঋদ্ধি: কোনও দিন না। এই ভাবনাটা আমার মাথায় আসেইনি জীবনে। আমি মনে করি, কেউ কাউকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। প্রত্যেকের একটা নিজস্বতা আছে। আর আমি কৌশিক সেনের গুণমুগ্ধ ভক্ত। খুব পছন্দ করি বাবাকে।
প্রশ্ন: আপনার সঙ্গে তা হলে কারও প্রতিযোগিতা নেই?
ঋদ্ধি: আপাতত তো নেই। আর প্রতিযোগিতা তো পারফরম্যান্সের সময়। সে ক্ষেত্রে মা, বাবা, ঠাকুরমা বা আমার বান্ধবী— যে কারও সঙ্গেই হতে পারে।
প্রশ্ন: বাড়িতে যখন বাবা-মা-আপনি কথা বলেন, তখন কি শুধুই তাত্ত্বিক আলোচনা হয়?
ঋদ্ধি: (হেসে) না না! আমরা সব রকম আলোচনা করি। প্রচণ্ড হাসি, মজা, যাকে খিল্লি বলা হয়, সে সব চলে। মা-বাবার সামনে গালাগালি দেওয়া যায় না বা যৌনতা নিয়ে কোনও কথা বলা যায় না— এমনও কখনও মনে হয়নি। বাবা-মার সামনে ননভেজ জোকও বলি। আমার বন্ধুবান্ধবরাও এর অংশ এখন। আমার বাবা-মার সামনে কিছু বলতে ওরাও দু’বার ভাবে না। আমাদের পরিচারিকা মায়া’দিও আমাদের আড্ডায় যোগ দেন। পরনিন্দা-পরচর্চাও পুরোদমে চলে।
প্রশ্ন: রেগে গেলে কী করেন?
ঋদ্ধি: সাইকেল চালাতে খুব ভালবাসি। রাগ হলে সাইকেল চালাই আর গান শুনি।