বিয়ের ছ'বছর পর প্রেম এ ভাবেও হানা দেয়! জানালেন তথাগত
কী আশ্চর্য, মেঘ যে এভাবে মেঘ সরাতে পারে সত্যিই জানা ছিল না।করোনার পৃথিবীতে অনেকটা জমে থাকা মন খারাপ,কষ্ট আর বিষাদ কাটাতে প্রায় আট মাস বাদে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া। ২০২০-এর সবক'টা ছুটি এতদিন বন্ধ ছিল,অগত্যা পৃথিবী দেখাও।তাই এতদিন পর যখন লকডাউন একটু একটু করে শিথিল হচ্ছে আর আমরা ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠছি করোনার সঙ্গে সহবাস করতে, ঠিক সেই সময়টাতেই ঘাড়ের কাছে পূজোর গন্ধ।
ছোটবেলার পূজোটা আর এ শহরের অলিতে গলিতে খুঁজে পাই না। তাই প্রতিটা পূজোই যেন অজুহাত হয়ে ধরা দেয় দেশ দেখার,মানুষ দেখার, সভ্যতা চেনার। এ বার অধিকাংশ দেশের কাঁটাতারে মস্ত লোহার তালা ঝুলছে,তাই অগত্যা সেই চেনা পরিচিত উত্তরবঙ্গ। অ্যাডভেঞ্চার আর নতুনত্বের নেশায় এবার রোড ট্রিপ। ফ্লাইটে পিপিই কিট পরে বসার ভয়ের চেয়েও গাড়ি নিয়ে পাহাড় ডিঙোনোর স্বপ্ন বোধ হয় বেশি পেয়ে বসেছিল।
গন্তব্য মিরিকের পাশের একটা ছোট্ট গ্রাম,নাম না জানা, তাতে পাহাড়ের ঢালে একটা বাড়ি, যার বারন্দার দোলনায় বসে আবার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। তুচ্ছ মানুষ আঁক কষে, আর ভূল করে প্রতিনিয়ত, তাই এ রাজ্যে উনিশ ঘণ্টার দূরন্ত খারাপ রাস্তা দিয়ে লং ড্রাইভ যে সত্যি কোমরের লং টার্ম যন্ত্রণার ব্যবস্থা করবেই, তা জানা ছিল না।
প্রকৃতির কাছে দেবলীনা।
পঞ্চমীর ভোর তিনটেতে বেরিয়ে শিলিগুড়ি পৌঁছলাম যখন, তখন প্রায় রাত ১০টা। ভাগ্যিস বন্ধুর উপদেশে বাকি রাতটা শিলিগুড়ির হোটেলে কাটানোর ব্যবস্থা করাই ছিল! পরদিন সকাল সকাল পাহাড়ে ওঠা শুরু। গাড়ির জানলা দিয়ে নরম সূর্য, একটু একটু ঠান্ডা,ইউক্যালিপটাসের বনের ছায়া পেরনো, আর হাতের কাছে বিভূতিভূষণের আরণ্যকে জড়িয়ে থাকা মায়া।
আরও পড়ুন:বাস্কেটবল, নেটবলে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন! ভাইরাল এই বলি অভিনেত্রীর লিপলকের ছবি
অজানা বাঁকগুলোর নিস্তব্ধতা ভাঙছে এতদিনের জমে থাকা প্রতিটা চমকে। চেনা রাস্তাও যে এতটা অভিভূত করতে পারে নতুনত্বে,এ এক অলৌকিক আবিষ্কার। মিরিক পেরিয়ে, খাড়া সরু রাস্তার বিপজ্জনক বাঁক, মাঝরাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা বেপরোয়া পাহাড়ি গাড়ি,অনেকটা পাইন বন পেরিয়ে যখন বাড়িটায় এসে পৌঁছলাম তখন বেলা হয়ে গেছে বেশ। মাঝে মাঝে কখনও চা বাগানে, কখনও পাইন বনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আষ্টেপৃষ্টে গন্ধ নিয়েছি,ক্যামেরাতে তুলে নিয়েছি ততটা যতটা স্মৃতি ধরে রাখা যায়।
অজানা পাহাড়ি মানুষের যত্নের রান্না যে এতটা মনকে আপ্লুত করতে পারে আগে সেভাবে কখনো খেয়াল করে উঠিনি, প্রথম দিন খিদের মুখের ওই স্বাদ বহূ দিন থেকে যাবে স্মৃতিতে। আমাদের কাঠের দোতলা ঘরের লাগোয়া বারান্দা আর তার সঙ্গে একা আমরা দু'জন। বিপন্ন বিস্ময়ে চুপ। উল্টো দিকের পাহাড়ে রাতের বেলা জ্বলে ওঠা আস্ত কার্শিয়াং শহর,আর হিল কার্ট রোড।
আরও পড়ুন:সম্পর্কে ননদ-ভ্রাতৃবধূ, তবু তিক্ততা কমেনি সোনম এবং দীপিকার
পাহাড়ি রাস্তায় পাইন বনের ধারে কোথাও যেন আদিম পশুদের গন্ধ।
বিয়ের ছ'বছর পর প্রেম এভাবেও হানা দেয়! নিস্তব্ধতা এভাবেও চুমু খায়! জমে থাকা প্রত্যেকটা অভিমান, অভিযোগ ঘরে ঢুকে আসা মেঘেদের সঙ্গে এক এক করে উড়ে যাচ্ছে। আমি, আমরা হালকা হচ্ছি ক্রমশ, মুক্ত হচ্ছি,রাগ থেকে, ক্ষোভ থেকে,মানুষ থেকে ।
আমার সহযোগী,বন্ধু, ভাই সত্রাবিত নিচের শহর জলপাইগুড়িতে থাকে,আমরা এসেছি তাই এক দিনের জন্য দেখা করতে। আসা প্রায় ৯ মাস পর,করোনার পর। তিনজনে মিলে রওয়ানা হলাম লেপচাজগতের দিকে। উদ্দেশ্য গহীন পাইন বনে হারিয়ে যাওয়া। আর একটা কেজো লোভ,সিনেমার লোকেশন দেখা।
অনেকগুলো পাইনবন দেখেও শেষে যে বনটাতে হারালাম, সেখানে মানুষ নেই,সভ্যতা নেই,শুধু লম্বা লম্বা গাছ আর গাছ,মাঝে মাঝেই নেমে আসা কুয়াশা,কখনও রোদ পাইনের ধূসর গায়ে, কোথাও কোথাও আদিম পশুদের গন্ধ আর পায়ের ছাপ। দেবলীনা একবার হারিয়েও গেল ছবি তুলতে গিয়ে,বেশ অনেকক্ষণ,সিনেমার মতো চিৎকার করে ডেকে যখন খুঁজে পেলাম তখন টের পেলাম, হারিয়ে যাওয়া পথ নতুন করে পথ চিনতে শেখায়। শিখলাম,ভালবাসলাম।
আরও পড়ুন:পারিশ্রমিক কমাতে রাজি?
পাহাড়ি ঢালে যে সমস্ত কুয়াশা জট বেঁধে থাকে সেসবের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া লেপচাজগত, তাদেখ-- এই সব গ্রাম এক অবিস্মরণীয় যাপন। কোনও এক অনামী ছোট্ট দোকানের মোমোতে যে এতটা জীবনীশক্তি, এত স্বাদ! মায়া কাটানোর শক্তি না থাকলে এ যাত্রা থেকে যেতাম,ফিরতাম না হয়তো আমরা। পাহাড়ের কোনও ঢালে ছোট্ট কাঠের বাড়িতে স্বপ্ন বুনতাম রোজ, তারপর চাষবাস, রান্না, কাঠ আনা,জীবনের প্রয়োজনটুকু। কিন্তু বাঁচাটা এই পাহাড়ে, পাইন ইউক্যলিপ্টাসের বনে,কুয়াশার মাঝে,লেপের তলায় ।
ছোট্ট কাঠের বাড়িতে স্বপ্ন বুনলেন যুগলে। তথাগতর ক্যামেরায় দেবলীনা।
মানুষ ভাবে, বলে প্রথম কিছুর স্বাদ ফিরে পাওয়া যায় না আবার, আমরা পেয়েছি,আমি আর দেবলীনা। পেয়েছি,কাঠের বাড়ির প্রথম প্রেম,কুয়াশায় ভেজা চুমু,হারিয়ে ফেলার ভয়-- সবটা। বাড়ির বারন্দার দোলনায় বসে হাতে ছুঁয়ে সামনের বিরাট উপত্যকাকে সাক্ষী রেখে আবার সব ফিরে পাওয়া যেন প্রথম পাওয়ার মতোই সত্যি। গ্লানি নেই, ক্লান্তি নেই। ঘাড়ে নিশ্চিন্তে মাথা রাখার মতো নিরাপদ আশ্রয় এই পাহাড়, যা আমাদের লুকিয়ে রেখেছিল এই ছ'টা দিন।
অন্য দেশ প্রয়োজন হল না, অন্য সভ্যতা প্রয়োজন হল না, বাড়ির সামনের একটা ছোট্ট শিশির বিন্দু আড়াল করে ফেলল আমাদের, যাবতীয় সময়ের ক্ষত মুছে দিল অস্তিত্বের ক্ষতগুলো। নিজেদের আবিষ্কার করার এই দিনগুলোতে মনে হচ্ছিল, আর সমতলে ফিরব না, শহরে ফিরব না। সত্রাবিতের কথা ধার করে বলতে ইচ্ছে করছিল,পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে- 'অসভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ।'