বিমানে বসে সবথেকে কাছের বন্ধুকে মেসেজে ১৪ বছরের কিশোরী লিখেছিল, “যদি প্লেনটা ক্র্যাশ করে তখন কী হবে?’’ কথোপকথনের শেষে বান্ধবীর জন্য বার্তা ছিল, ‘আই লভ ইউ’। মোবাইলের মেসেজ-বার্তার শেষে যেমন সাধারণত বলা হয়, সে রকমই শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছিল।
শিল্পপতি হরেশ এবং গৃহবধূ গীতার একমাত্র মেয়ে তরুণীর জন্ম ১৯৯৮ সালের ১৪ মে। ছোট থেকেই তার স্বপ্ন ছিল, অভিনেত্রী হওয়ার। মেয়ের ইচ্ছেয় বাধা দেননি বাবা-মা। ২০০৪ সালে তরুণীর অভিনেত্রীজীবন শুরু। অভিনয় করে মালয়ালম ছবি ‘ভেল্লিনাক্ষত্রম’-এ।
সে বছরই অ্যাকশন থ্রিলার ‘সত্যম’-এ অভিনয় করে শিশুশিল্পী তরুণী। তবে ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ এসেছিল মডেলিংয়ের হাত ধরে। বেশ কিছু পণ্যের বিজ্ঞাপনে অন্যতম মুখ ছিল তরুণী। তার করা মডেলিংগুলির মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় হয়েছিল ঠান্ডা পানীয় রসনার বিজ্ঞাপন।
সেখানে তরুণী কাজ করেছিল করিশ্মা কপূরের সঙ্গে। বিজ্ঞাপনের শেষে আদি অকৃত্রিম জনপ্রিয় ক্যাচলাইন ‘আই লভ ইউ রসনা’ বলে সেও হয়ে উঠেছিল ‘রসনা গার্ল’।
একটি বিজ্ঞাপনে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে তরুণীর অভিনয় দেখে ভাল লেগেছিল পরিচালক বিনায়নের। তিনি এর পর তরুণীকে সুযোগ দেন ছবিতে। ৫ বছর বয়সি তরুণীর সপ্রতিভ অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে যান পরিচালক-সহ ইউনিটের বাকি সদস্যরা।
বার দু’য়েক শুনেই অনায়াসে মালয়ালম সংলাপ মনে রাখতে পারত তরুণী। মাতৃভাষার বাইরে অন্য ভাষার সংলাপ এত দ্রুত আয়ত্ত করার দক্ষতা প্রশংসিত হয়েছিল অভিনয় মহলে।
২০০৯ সালে তরুণী অভিনয় করে আর বাল্কির কমেডি ড্রামা ‘পা’-এ। ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের সহপাঠী সোমির ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল তাঁকে। এই ছবির পর থেকেই ইন্ডাস্ট্রির নজরে পড়ে তরুণী।
ইন্ডাস্ট্রি এবং দর্শকমহলে জনপ্রিয়তার শিখরে থাকার সময়ে তরুণী অংশ নেয় টেলিভিশন শো ‘ক্যায়া আপ পাঁচভি পাস সে তেজ হ্যায়’-এ।
তরুণীর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন, সকলে স্বীকৃতি দিয়েছে তার প্রতিভাকে। পাশাপাশি, স্বভাব এবং আচরণেও সকলের মন জয় করেছিল তরুণী। শ্যুটিংয়ে তার শৃঙ্খলাপরায়ণ আচরণ ভাল লেগেছিল ইউনিটের সদস্যদের।
২০১২ সালের মে মাসে গরমের ছুটি কাটাতে নেপাল গিয়েছিল তরুণী। সঙ্গে ছিলেন তাঁর মা। নেপাল থেকে তাদের যাওয়ার কথা ছিল বেঙ্গালুরু। কিন্তু সে গন্তব্য অধরাই থেকে যায় তাঁদের কাছে।
১৪ মে তাঁরা নেপালের পোখরা বিমানবন্দর থেকে রওনা দেন জমসমের দিকে। নেপালের গন্ডকী প্রদেশের মুস্তাং জেলায় জমসম হল ডোমেস্টিক এয়ারপোর্ট। কাগবেনি, তাংবে, লো মানথাং জেলা এবং মুক্তিনাথ মন্দিরে যাওয়ার জন্য এই বিমানবন্দর ব্যবহার করেন পর্যটক ও পুণ্যার্থীরা।
জমসম বিমানবন্দরে ল্যান্ড করার আগেই দুর্ঘটনার মুখে পড়ে ‘ডোর্নিয়ের ডো ২২৮’। পাহাড়ে ধাক্কা লাগে বিমানের একটি ডানার। এর পর পাইলটদের বিমানবন্দরে অবতরণের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ২ পাইলট-সহ ১৫ জনের।
বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ছিল তরুণী এবং তার মা। বিমানে থাকা বাকি ৬ জন আহত হন। তরুণীর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে বিনোদন দুনিয়া। সোশ্যাল মিডিয়ায় শোকপ্রকাশ করেন অমিতাভ, অভিষেক, করিশ্মা কপূররা।
মৃত্যুর ২ বছর পরে মুক্তি পায় তরুণীর শেষ ছবি ‘ভেলত্রি সেলভান’। তামিল ভাষার এই ছবিতে তরুণীর সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন আজমল আমির এবং রাধিকা আপ্টে।
২০১২ সালের গরমের ছুটি কাটাতে যাওয়ার আগে তরুণী তার কাছের বন্ধুদের মেসেজ করেছিল। বলেছিল, ‘তোমাদের সকলের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিলাম।’ তার পর নিজেই জানায়, এটা ছিল তার রসিকতা। অথচ তার আগে কোনও বার ছুটিতে যাওয়ার আগে এ রকম ভাবে সে তার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলেনি।
হাল্কা মেজাজে করা সেই রসিকতাই সত্যি হয় শেষ অবধি। গরমের ছুটির শেষে স্কুল খোলার পরে বন্ধুদের মাঝে আর ফিরে আসেনি মুম্বইয়ের বাঈ আভাবাঈ ফ্রামজি পেতিত গার্লস হাই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রীটি।