ফের বড় অঙ্কের প্রতিরক্ষা চুক্তির পথে ভারত। তবে হাতিয়ার আমদানি নয়, রফতানি করবে নয়াদিল্লি। এ বার আর্মেনিয়াকে প্রলয় ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করতে চলেছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। এই নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে চলা আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি প্রলয় ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণে হাত রয়েছে প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিওর (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন)। এখনও পর্যন্ত এই মারণাস্ত্র কাউকে বিক্রি করেনি ভারত। সে দিক থেকে আর্মেনিয়াই এর প্রথম ক্রেতা হতে চলেছে। চলতি বছরের এপ্রিলেই প্রলয়ের প্রতিরক্ষা চুক্তি চূড়ান্ত রূপ নেবে বলে সূত্রের খবর।
২০২২ সাল থেকে ভারতীয় সেনার অস্ত্রাগারে রয়েছে প্রলয়। ১৫০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার পাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্র নিখুঁত নিশানায় আঘাত হানতে সক্ষম। এর মধ্যে অন্যতম হল শত্রুর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) ও হাতিয়ারের গুদাম। যুদ্ধের সময়ে এর ‘গেম চেঞ্জার’ হয়ে ওঠার ক্ষমতা রয়েছে, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
৩৫০ থেকে ৭০০ এবং ৫০০ থেকে হাজার কেজির উচ্চ শক্তির বিস্ফোরক ব্যবহার করে প্রলয়। ভারতীয় সেনার পাশাপাশি বায়ুসেনাও এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার (মিসাইল টেকনোলজ়ি কন্ট্রোল রিজ়িম বা এসটিসিআর) সদস্যপদ রয়েছে ভারতের। আর তাই ২৯০ কিলোমিটার পাল্লার প্রলয় কাস্পিয়ান সাগরের কোলের দেশটিকে সরবরাহ করা হবে বলে জানা গিয়েছে।
গণবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং তার প্রযুক্তি সরবরাহের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ রাখতে ১৯৮৭ সালে একটি সমঝোতা করে ৩৫টি দেশ। তাতে ঠিক হয়, ৩০০ কিলোমিটারের বেশি পাল্লার এবং ৫০০ কেজির বেশি বিস্ফোরক বহনে সক্ষম কোনও হাতিয়ার অন্য রাষ্ট্রকে সরবরাহ করা হবে না। দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধের উত্তেজনা হ্রাস করতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
উল্লেখ্য, নাগরনো-কারাবাখের দখলকে কেন্দ্র করে গত কয়েক মাসে নতুন করে প্রতিবেশী আজ়ারবাইজানের সঙ্গে সম্পর্কে তিক্ততা এসেছে আর্মেনিয়ার। বিতর্কিত এই এলাকার একটা বড় অংশই ২০২০ সালে দখল করে নেয় বাকু। সেই থেকে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্লেষকদের দাবি, এত দিন পর্যন্ত আজ়ারবাইজানের ভিতরে হামলা চালানোর মতো কোনও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছিল না আর্মেনিয়ার কাছে। প্রলয় হাতে চলে এলে সেই ক্ষমতা পাবে মধ্য এশিয়ার এই দেশ। তখন আর্মেনীয় সেনার কাছে প্রতিবেশী দেশটির রাজধানী বাকুকে নিশানা করা খুব একটা কঠিন হবে না। এক কথায় আজ়ারবাইজানের রাতের ঘুম কেড়ে নিতে পারে ভারতের প্রলয়।
একটা সময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গ ছিল আর্মেনিয়া ও আজ়ারবাইজান। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে রাশিয়া-সহ মোট ১৫টি দেশের জন্ম হলে পৃথক রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে তারা। জন্মের কিছু দিন পর থেকেই নাগরনো-কারাবাখকে কেন্দ্র করে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বাধে বিবাদ। এই নিয়ে বেশ কয়েক বার যুদ্ধে জড়িয়েছে আর্মেনিয়া ও আজ়ারবাইজ়ান।
নাগরনো-কারাবাখের বিবাদে প্রথম দিন থেকে তুরস্কের সমর্থন পেয়ে আসছে আজ়ারবাইজান। অন্য দিকে ‘বন্ধু’ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করেছে আর্মেনিয়া। দক্ষিণ ককেসাস এলাকার দেশটির প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহে বড় ভূমিকা রয়েছে নয়াদিল্লির। ভারতীয় কামান, ছোট অস্ত্র এবং রাডার ব্যবহার করতে ভালবাসে আর্মেনিয়ার ফৌজ।
২০২২ সালে ডিআরডিওর তৈরি পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার হাতে পেতে নয়াদিল্লির সঙ্গে চুক্তি করে আর্মেনিয়ার সরকার। গত বছরের ডিসেম্বরে ওই মারণাস্ত্র মধ্য এশিয়ার দেশটিকে সরবরাহ করে নয়াদিল্লি।
পাল্লা অনুযায়ী ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর ব্যবহৃত এই অস্ত্রের বেশ কয়েকটি প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন, ৪৫ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যে নিখুঁত নিশানায় হামলা করতে পারে পিনাকা মার্ক-১। অন্য দিকে পিনাকা মার্ক-২-এর পাল্লা ৯০ কিলোমিটার। আর্মেনিয়াকে ৯০ কিলোমিটার পাল্লার পিনাকা সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
পিনাকার সবচেয়ে ভাল দিক হল, মাত্র ৪৪ সেকেন্ডে ১২টি রকেট নিক্ষেপ করার ক্ষমতা। এর এক একটি ব্যাটারির ৭২টি রকেট ছোড়ার ক্ষমতা রয়েছে। হাতিয়ারটির প্রতিটা লঞ্চারকে স্বাধীন ভাবে চালানো যায়। রকেটগুলির মাধ্যমে একক ভাবে বা একসঙ্গে বিভিন্ন দিকে হামলা করার সুবিধা রয়েছে।
শিবের ধনুকের নামানুসারে তৈরি অত্যাধুনিক এই অস্ত্রটির মোট চারটি অপারেশন মোড রয়েছে। সেগুলি হল, ম্যানুয়াল, রিমোট, স্ট্যান্ডঅ্যালোন এবং অটোনোমাস। ১৯৮৬ সালে এটি তৈরি করে ডিআরডিও। ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধে বড় ভূমিকা নেয় পিনাকা।
গত কয়েক বছর ধরেই প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানি বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে নয়াদিল্লি। সম্প্রতি এ ব্যাপারে বিশেষ একটি পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাতিয়ার বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে কূটনীতিকদের ময়দানে নামাচ্ছে কেন্দ্র। অন্তত ২০টি দেশে পাঠানো হয়েছে তাঁদের।
সূত্রের খবর, আর্থিক দিক থেকে দুর্বল এবং রাজনৈতিক অস্থিরতায় জেরবার বেশ কয়েকটি দেশকে চিহ্নিত করেছে নয়াদিল্লি। রফতানি-আমদানি ব্যাঙ্কের মাধ্যমে তাদের ঋণ দেবে নয়াদিল্লি। শর্ত একটাই, সেই অর্থে কেবলমাত্র ভারতের থেকে অস্ত্র কিনতে হবে তাদের। এতে এক দিকে যেমন প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণকারী সংস্থাগুলি ক্রমাগত অস্ত্রের বরাত পেতে থাকবে, অন্য দিকে তেমন ঋণের সুদ থেকে মোটা অর্থ রোজগার করবে কেন্দ্র।
এই লক্ষ্যেই ব্রাজ়িল এবং আর্জেন্টিনা-সহ একাধিক দেশে কূটনীতিকদের পাঠিয়েছে মোদী সরকার। সূত্রের খবর, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা এবং আফ্রিকায় রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির ইচ্ছা রয়েছে ভারতের। ইতিমধ্যেই ফিলিপিন্সকে এই মারণাস্ত্র বিক্রি করেছে নয়াদিল্লি।
চিনের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদের কারণে ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনাম ভারতের থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার ব্যাপারে আলোচনা চালাচ্ছে। এই তালিকায় রয়েছে ব্রাজ়িল এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির নাম। প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিওর তৈরি ৪৫ কিলোমিটার পাল্লার আকাশ প্রকৃতপক্ষে ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র। ইতিমধ্যেই আর্মেনিয়াকে এটি সরবরাহ করেছে নয়াদিল্লি।
এ ছাড়া নাইজ়েরিয়া, আর্জেন্টিনা, ফিলিপিন্স এবং অস্ট্রেলিয়া সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি তেজস যুদ্ধবিমানের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। ইউরোপের কিছু দেশ ৫৫ মিলিমিটারের কামানের গোলা ভারতের থেকে সংগ্রহ করতে চায়। এই সুযোগগুলিকে কাজে লাগিয়ে হাতিয়ার ব্যবসায় পা জমাতে চাইছে নয়াদিল্লি।
সূত্রের খবর, প্রলয়ের ব্যাপারে আর্মেনিয়ার সঙ্গে শেষ পর্যায়ের আলোচনায় ক্ষেপণাস্ত্রটির দাম ঠিক করবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। মধ্য এশিয়ার দেশটি এটি কত সংখ্যায় নিতে চাইছে, তা স্পষ্ট নয়। চুক্তি চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত এই বিষয়টি গোপন রেখেছে দুই দেশ।