‘আয়নায় নিজেকে দেখেছ কখনও? এই চেহারা নিয়ে নায়িকা হতে চাও?’ এক প্রযোজকের কথাগুলো জীবনভর মনে রেখেছিলেন তিনি। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে তাঁকে ভুল প্রমাণ করে ছেড়েছিলেন।
তার আগে শৈশবে পাল্টে ফেলেছিলেন নিজের নাম। স্কুলে বন্ধুরা ‘ডালডা’ বলে মজা করত। তাই শিশুশিল্পী হিসেবে জন্মগত নাম ‘আলডা’ থেকে ‘বেবি নাজমা’ হয়ে গিয়েছিলেন নেপাল থেকে আসা বালিকা। পরে আবার নাম পরিবর্তন। এ বার তিনি ‘নাজমা’ থেকে ‘মালা’।
মালার বাবা অ্যালবার্ট সিনহা ছিলেন নেপালের বাসিন্দা। তবে মেয়ের জন্মের আগেই তিনি নেপাল থেকে কলকাতা চলে এসেছিলেন। কলকাতার স্কুলেই ‘আলডা’ নাম নিয়ে বিপত্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন তাঁর কন্যা।
ছোট থেকেই মালা নাচ-গান-অভিনয়ে পারদর্শী ছিলেন। নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন আকাশবাণীতে। শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছিলেন বেশ কিছু পৌরাণিক বাংলা ছবিতে। ‘জয় বৈষ্ণো দেবী’, ‘শ্রীকৃষ্ণলীলা’, ‘যোগবিয়োগ’, ‘ঢুলি’ ছবিতে মালা ছিলেন বেবি নাজমা নামে।
স্কুলের একটি নাটকে তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে যান পরিচালক অর্ধেন্দু বসু। তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তাঁকে ১৯৫২ সালে ‘রোশেনারা’ ছবির নায়িকা নির্বাচন করেন। এ বার নাজমা থেকে মালা হলেন ষোড়শী সুন্দরী।
বাংলা ছবিতে বেশিদিন অভিনয় করেননি মালা। কেরিয়ারের শুরুতেই পাড়ি দেন সেকালের বম্বে, আজকের মুম্বই। প্রথম হিন্দি ছবি ‘বাদশা’ ছিল প্রদীপকুমারের বিপরীতে। এই ছবি এবং এরপর মালার আরও কিছু ছবি ব্যর্থ হয়।
১৯৫৬ সালে মুক্তি পায় গুরু দত্তের ‘প্যায়াসা’। ইন্ডাস্ট্রিতে মাইলফলক এই ছবি ছিল মালার কেরিয়ারেরও টার্নিং পয়েন্ট। মধুবালার কথা ভেবে তৈরি এই চরিত্রে অভিনয়ের সুয়োগ তিনি যথাযথভাব কাজে লাগিয়েছিলেন।
রমেশ সায়গলের পরিচালনায় ‘ফির সুবহ হোগি’ ছিল দস্তয়ভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এর অনুসরণে। এই ছবিতে অভিনয়ের জেরে ইন্ডাস্ট্রিতে মালা পরিচিত হন বহুমুখী নায়িকা হিসেবে।
পাঁচ ও ছয়ের দশকে বলিউডে একের পর এক সুপারহিট ছবি উপহার দিয়েছেন মালা। সমালোচকদের মতে তাঁর অভিনীত সেরা ছবিগুলির মধ্যে ‘বহুরানি’, ‘গুমরাহ’, ‘গেহরা দাগ’, ‘আপনে হুয়ে প্যায়ারে’, ‘জাহান আরা’ অন্যতম। কেরিয়ারের প্রথম থেকেই ছকভাঙা ভূমিকায় অভিনয় করতে ভালবাসতেন মালা। ‘ধুল কা ফুল’, ‘অনপড়’, ‘হরিয়ালি অউর রাস্তা’, ‘আঁখেঁ, ‘বাহারেঁ ফির ভি আয়েঙ্গি’, ‘মেরে হুজুর’এর মতো নারীকেন্দ্রিক ছবিতে মালা সিংহর অভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে।
মুম্বই যাওয়ার পরে কলকাতাকে ভুলে যাননি মালা। ‘লুকোচুরি’, ‘সাথীহারা’, ‘খেলাঘর’, ‘শহরের ইতিকথা’-র মতো ছবিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে মালার অভিনয়। ১৯৭৭ সালে মুক্তি পায় তাঁর শেষ বাংলা ছবি, ‘কবিতা’। রঞ্জিত মল্লিক-কমল হাসন-মালা সিংহ অভিনীত এই ছবি বক্সঅফিসে সুপারহিট হয়।
প্রবীণ এবং নবীন, দুই প্রজন্মের নায়কদের সঙ্গেই দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। রাজ কপূর, দেব আনন্দ, কিশোর কুমার, প্রদীপ কুমার, গুরু দত্তের মতো সিনিয়র অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। আবার শাম্মি কপূর, রাজেন্দ্র কুমার, রাজকুমারের মতো সমসাময়িকদের বিপরীতে সমান উজ্জ্বল মালা।
নবাগত নায়কদেরও সমান গুরুত্ব দিতেন তিনি। মনোজ কুমার, ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খন্না, সুনীল দত্ত, সঞ্জয় খান, জিতেন্দ্র,অমিতাভ বচ্চন যখন ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন, তাঁদের নায়িকা হতে দ্বিধা করেননি মালা।
মালা সিনহার একমাত্র নেপালি ছবি ‘মাইতিঘর’ মু্ক্তি পায় ১৯৬৬ সালে। এই ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে মালার আলাপ হয় নেপালি নায়ক চিদম্বরম প্রসাদ লোহানির সঙ্গে। তাঁকেই পরে বিয়ে করেন মালা।
বিয়ের পরে দীর্ঘদিন কাজের সূত্রে মালা-চিদম্বরম দু’জনে থাকতেন দুই শহরে। মালা থাকতেন মুম্বইয়ে। চিদম্বরম কাঠমান্ডুতে। নয়ের দশকে মুম্বই চলে আসেন চিদম্বরম। বান্দ্রায় একটি বাংলোয় থাকেন তাঁরা।
সাতের দশক থেকে ধীরে ধীরে অভিনয় কমিয়ে দেন মালা। তাঁর শেষ ছবি ‘জিদ’ মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। ইদানীং খুব বেশি প্রকাশ্যেও আসেন না বিগত দিনের এই নায়িকা।
মালা সিনহার একমাত্র মেয়ে প্রতিভাও অভিনয় করেছেন কিছু ছবিতে। কিন্তু তিনি মায়ের সাফল্যের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেননি। আপাতত ইন্ডাস্ট্রি থেকে অনেক দূরে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত পশপ্রেমী প্রতিভা।
মালা গানও গাইতেন খুব সুন্দর। কিন্তু কোনওদিন প্লেব্যাকের সুযোগ পাননি। নিজের ছবিতেও মাত্র একবারই গান করেছেন। ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ললকর’ ছবিতে মালার লিপে তাঁর নিজের গান আছে।
মুম্বইয়ে যখন অভিনয় করতে এসেছিলেন, এক বর্ণও হিন্দি জানতেন না মালা সিনহা । পরে হিন্দি শিখে তিনি নিজেকে প্রথমসারির নায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।