শটের মাঝে সৃজিত-স্বস্তিকা।
কলকাতা ভিজছে অঝোর শ্রাবণে। মেঘের পাড়ায় বড্ড বাড়াবাড়ি। পথ দিশাহারা। তার মাঝেই কলকাতাময় ছুটে বেড়াচ্ছে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের একশো নব্বই জনের ইউনিট!কড়া নিরাপত্তা, লুকের ছবি তোলা যাবে না!
সারাদিন ধরে বিভিন্ন শটে ভিজে চলেছেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় বা ‘চৌরঙ্গী’র করবী।
‘‘উহু, করবীও নয়। আর চৌরঙ্গী-ও নয়,এটাতো ‘শাহজাহান রিজেন্সি!’’ লাঞ্চ ব্রেকে ফ্রায়েড রাইস আর চিলিচিকেন খেতে খেতে শুধরে দিলেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। পাশে তখন সদ্য স্নান সেরে ভেজা চুলে তোয়ালেতে আপাদমস্তক ঢাকা আর এক অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য।পোশাক আসার অপেক্ষায়।স্বস্তিকার সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন তিনি এই ছবিতে।
তিনি কি তবে বিশ্বজিতের চরিত্রে?
সব কি মিলিয়ে মিলিয়ে বলা যায়? নাকি সৃজিত মুখোপাধ্যায় ‘শাহজাহান রিজেন্সি’ শুটের ষষ্ঠ দিনে সব বলে ফেলবেন! তা হয় না। এ ক্ষেত্রে যদিও বলে রাখা ভাল যে, সেদিনের শুটে তিনি একমাত্র আনন্দবাজার ডিজিটালকেই ডেকেছিলেন। সকালে অঞ্জন দত্ত আর ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর শুট ছিল।
সুইসোটেলের রুম নম্বর ৭০৮। নিজের ঘরে বসে কথা বলছিলেন সৃজিত। “পোস্টারে আমরা নিশ্চয়ই দেব ‘চৌরঙ্গী’ অবলম্বনে এই ছবি। কিন্তু প্রেক্ষাপট থেকে চরিত্রের নাম, সবকিছুরই বদল হয়েছে এখানে। চৌরঙ্গি আগে হোটেল পাড়া ছিল, আজ আর নেই। ২০১৮ হোটেল পাড়া হল বাইপাস, যেখানে ম্যারিয়ট, নভোটেল, সুইসোটেলের মতো হোটেলের সারি। এই ছবি আসলে রিটেলিং অব নভেল।আর সাহেবরা সত্যসুন্দর বলতে পারত না বলে স্যাটা বলতো। তো সাহেবরাই যখন নেই তখন স্যাটা নামের আজ কোনও মানে হয় না। নামও তাই বদল।পাল্টানো সময়ের গল্প,তাই ছবির নাম বদল হয়েছে।’’
আরও পড়ুন, ছোটবেলার প্রেমিকাকেই বিয়ে করেছেন এই বলিউড তারকারা
ভেন্ডর থেকে শুরু করে গাড়ির ব্যবস্থা, এ বার সব তাঁর মাথায়। তাঁর নিজের হাউস ম্যাচকাট প্রোডাকশন আর এসবিএফের যৌথ উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে ‘শাহজাহান রিজেন্সি’।
কিন্তু এরকম একটা উদ্যোগে নেই যিশু সেনগুপ্ত, নেই প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়!
‘‘আরে, যিশুর তো গল ব্লাডার ধরা পড়ল। ২০১৪ থেকে টানা ওর সঙ্গে কাজ করেছি।আর বুম্বাদা নিজের চরিত্র নিয়ে তো খুব খুঁতখুঁতে। বলল, এটা আর একটু কম বয়সের কেউ করলে বেটার হবে।’’ মোবাইলে ‘শাহজাহান রিজেন্সি’-র জন্য তাঁর আর স্বস্তিকাকে নিয়ে খবর দেখতে দেখতে বললেন সৃজিত।
আপনি তো নিজেই চেয়েছিলেন এরকম কিছু চলতেই থাকুক। নয়তো স্বস্তিকার আর আপনার ছবি দিয়ে জন্মজন্মান্তর… ক্যাপসান দিয়ে দু’জনের টুইট কেন করলেন? আপনাদের রসায়নটা এখন কেমন?
‘‘রসায়ন থাকলে সেটা সারাজীবন থেকে যায়। রোজ কথা হলেও থাকবে। পাঁচ বছর কথা না হলেও থাকবে। তবে জীবনে কিছু প্রসেস ইররিভারসিবল্ হয়। একবার কিছু ঘটে গেলে সেটা মুছে দেওয়া যায় না। পরিস্থিতির চাপে যাই ‘চিড়’ থাক সেটা ইররিভারসিবল হয়। আমরা দু’জনেই প্রফেশনাল। যদি ধরেওনি, ওর-আমার দারুণ ঝগড়া তাতেও কিচ্ছু যায় আসে না। আমি ছবির খাতিরে আমার শত্রুদের নিয়েও কাজ করেছি।’’
কিন্তু স্বস্তিকা কী বলছেন এ বিষয়ে?
সেলফি টাইম। পরমব্রত, সৃজিত, অনির্বাণ, আবির।
তাঁকে এখনও দেখা যায়নি। তাই আবার সৃজিতের কাছে ফিরি।
প্রথমে তো চরিত্রটা জয়ার করার কথা ছিল!
‘‘হ্যাঁ, প্রথমে সেরকম কথাই ছিল। কিন্তু আমি যখন চিত্রনাট্য লিখতে বসলাম তখন দেখলাম জয়ার চেয়ে ভেবলি, মানে স্বস্তিকা এই চরিত্রে মানানসই। জয়ার সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে এটা নিয়ে। জয় গোস্বামীর ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’-তে একটা লাইন সম্ভবত এরকম ছিল,‘চরিত্র কি জানে গল্প যাবে কোন খানে...’’
শট রেডি। সৃজিত জানেন তাঁর গল্প কোথায় যাচ্ছে। ট্র্যাক প্যান্ট আর টি শার্ট পরে পরিচালক হাঁটা দিলেন সুইমিং পুলের দিকে।
মেঘ ভরা নীল আকাশ আর নীল জল কোথাও মিলেমিশে আজ একাকার। মেঘের বুক চিরে মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসছে এরোপ্লেন, সামনেই দমদম বিমানবন্দর।
শুটে রোজই কোনও চমক! আজ কী?
‘‘আজকে লক্ষ্মীরতন শুক্ল, রণদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপ দাশগুপ্ত, সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় আসছেন। অবশ্যই ক্রিকেট জড়িত শুট। একেবারে আনন্দবাজার ডিজিটালের জন্য এক্সক্লুসিভ!’’মনিটরে চোখ রেখে বললেন সৃজিত।
কিছুর যেন অপেক্ষা…
খানিক ভিড় জমল জলের এ ধার।ও ধার। কেউ আসছে।
এলেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। পাঁচ বছর পর আবার সৃজিতের ছবিতে। অন্যরকম লুক। পেছনে তাঁর বোন, ডিজাইনার অজপা মুখোপাধ্যায়। ‘‘উফ, এই ব্লাউজের পিঠের ফিটিং নিয়ে যা ঝামেলা…’’
খুব দ্রুত কতগুলো কঠিন শট নেওয়া হল। অভিনেত্রীর মুন্সিয়ানায়পরিচালক যারপরনাই মুগ্ধ! ‘ওহ! লাখ টাকার শট!’ ইউনিট খুশি। শট শেষ হতেই আজানের সুর। সৃজিতের হাসি...‘‘সব আপনা থেকে হয়ে যাচ্ছে...।’’
আরও পড়ুন, মাধুরী দীক্ষিতের বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এই গায়ক
‘‘সারাদিন ভিজে চলেছি। এ বার জ্বর আসবে আমার, তবে পরিচালক ছবির জন্য যা বলবে আমি সেটাই করব। আচ্ছা শুনুন, আমি সব পরিচালকের কথাই বলছি এখানে। দেখবেন, সৃজিত যা বলবে আমি তা-ই করব বলে টাইটেল করে বসবেন না যেন!’’স্বস্তিকা তাঁর রুমে গেলেন।
বদলে গেল ক্যানভাস! চোখের সামনে সন্ধ্যার মেঘ আর নস্ট্যালজিয়ার স্যাটা বোস?
উহু! পেছনে তাকাতে নেই।
সামনে দুই সুপুরুষ ভিন্ন বেশে। আবির চট্টোপাধ্যায় আর পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। দু’জনেই বারমুডা আর টি শার্ট পরে আগে হোটেলে ঢুকেছিলেন। এখন একেবারে অন্য বেশ! না, কেউ ডুয়েল লড়ছেন না। একে অপরকে বাড়িয়ে দিচ্ছেন সাহায্যের হাত। আবির যেমন বললেন, ‘‘পরমের কিন্তু তাড়া। আপনি আগে ওর সঙ্গে কথা বলে নিন।’’
এই দুই চরিত্রের মধ্য দিয়ে একটু একটু করে খুলে যাবে ‘শাহজাহান রিজেন্সি’-র দরজা। মানুষের ভেতরের মুখ। রাতের অন্ধকারে বদলে যাওয়া সম্পর্কের সমীকরণ।
‘বড় একা লাগে’ মানেই ‘চৌরঙ্গী’। উত্তমকুমারের ছবি মানেই চৌরঙ্গী। সেখানে এরকম ছবি করা রিস্ক নেওয়া নয়? ‘‘ওই ভাবে কোনও দিন কিছু ভাবিনি আমি। তাহলে জাতিস্মর করতে পারতাম না’ বলেই প্রডাকশন ডিজাইনারের সঙ্গে বেনারসি টাঙানো, মুঘল পেন্টিং নিয়ে আলোচনায় চলে গেলেন তিনি। সব তাঁর নজরে। খানিক ধমকালেন পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ‘এডি’-দের, ‘‘তোরা শুধু লিস্ট বানিয়ে যা।’’ উনিশ দিনের মধ্যে ছবি শেষ করতে হবে। ডিসেম্বরে রিলিজ। এরকম একটা টাইট শিডিউলে মাঝ রাত থেকে ভোর শুট চলছে। বেশিরভাগ হোটেলে শুট, তাই রাতে বা খুব সকালে শুট করতে হচ্ছে তাঁদের।
ক্রিকেটারদের সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত স্বয়ং পরিচালক।
ইতিমধ্যে শটের জন্য রেডি হচ্ছেন মমতাশংকর, কাঞ্চন। ‘‘মমদি জাতিস্মর-এ আমার মা করেছিলেন, কিন্তু এ বার ওঁর আর আমার অদ্ভুত একটা কেমিস্ট্রি। যা দর্শক আগে দেখেনি।’’ বলছিলেন স্বস্তিকা। সৃজিত এ ছবির গান নিয়ে আপাতত মুখে কুলুপ এঁটেছেন। যদিও স্বস্তিকা গানের বিষয়ে উচ্ছ্বসিত।
‘‘আসলে এরকম একটা ছবি। এত বড় অভিনেতাদের নিয়ে এরকম সাহিত্যনির্ভর গল্প বলতে গেলে যে অভিজ্ঞতা লাগে সেটা সৃজিতের এতগুলো ছবি করতে করতে হয়ে গেছে। আমার চরিত্রটাও খুব ইন্টারেস্টিং। যার মধ্যে দিয়ে ক্রমশ ছবির নানা চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্কের জটিলতা প্রকাশ পাবে। এবং সেইগুলো আবিরদাই দেখাবে আমায়।’’হোয়াটসঅ্যাপের উত্তর সেরে বলছিলেন পরমব্রত।
স্বস্তিকার সঙ্গে তো বহুদিন পরেআবার একসঙ্গে?
মুচকি হাসলেন। ‘‘হ্যাঁ, (চোখ উঁচু করে বললেন) ওই ঘটনার পরে এই ছবির সূত্রে আবার একসঙ্গে। তবে এই ছবিতে কাজ করতে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা হচ্ছে। অঞ্জনদা যেমন। ওঁরপাশে পাশে কাজ করাই একটা অভিজ্ঞতা!’’নিজে পরিচালক হলেও সৃজিতের সেটে তিনি পরিচালকের সত্ত্বা বাদ রেখে কাজ করেন। ‘‘অভিজ্ঞ পরিচালকদের সেটে আমিশুধুই অভিনেতা।তবে এই ছবিটা করতে করতে মনে হচ্ছে, হোটেল নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের যে সব চলচ্চিত্র হয়েছে তার কিছু রেফারেন্স সৃজিতএখানে ব্যবহার করবে। আমার কাছে সেটা ইন্টারেস্টিং।’’ ছুটলেন পরম।
আরও পড়ুন, কী দেখাবেন সে দায় পরিচালকের, বলেছি সবই, দাবি সঞ্জয়ের
আবির দ্রুত বদলে নিলেন ছবির পোশাক। কাল আবার ভোরে শুট। তাঁর চোখ দিয়েই এ ছবির বহু চরিত্রের উন্মোচন। ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর পর তিনি আর পরম একসঙ্গে সৃজিতের ছবিতে। ‘‘অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম সৃজিতের সঙ্গে বড় চরিত্রে কাজ করব।এটা খুব আইকনিক চরিত্র। দর্শকের মনের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে দিতে যাবে। আর একটা কথা মনে হয়, সৃজিত নিজে ছবিটা লেখে, তাই পরিচালনার সময় ও দৃশ্যগুলো দেখতেও পায়। তাই পরিচালক হিসেবে ও খুঁতখুঁতে। এটা ছবির জন্য ভাল।’’
পরম আপনি পাশাপাশি…
‘‘হ্যাঁ, আমরা দু’জনেই কেরিয়ারের এমন জায়গায় এসেছি যে আমাদের মধ্যে স্বভাবতই মানবিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি থাকলেই টেনশন হবে এমন নয়। তাই বলে কি আমরা গসিপ করি না? আমরা গসিপও করি। খেয়াল রাখি কে কী ছবি করছি। দেখি পরমের কোন ছবিটা ভাল হল। কিন্তু এই ছবিতে আমাদের কেমিস্ট্রি লোকে খুব পছন্দ করবে। এটুকু বলা যায়।’’
ততক্ষণে হোটেলের লাউঞ্জে এসে গিয়েছেন সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, লক্ষ্মীরতন শুক্ল, রণদেব বসু, দীপ দাশগুপ্ত।
এ বার জমবে খেলা!
নিজস্ব চিত্র।