Basanta Choudhury

রোদনভরা বসন্তে স্বাভিমানী এক অভিনেতা

জীবন ও সিনেমার সম্পূর্ণ দু’টি ভিন্ন সরণিতে হেঁটে গিয়েছেন দু’টি ভিন্ন সাফল্যের লক্ষ্যে। তাঁর দৈহিক সৌন্দর্য, কণ্ঠমাধুর্য আর পৌরুষ নিয়ে এক অনন্য অভিনেতার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছিলেন আজীবন। অভিনেতা, সংগ্রাহক, প্রাচীন ইতিহাসপ্রেমী বসন্ত চৌধুরী।মৃত্যুর কিছু দিন আগে বসন্ত চৌধুরী তাঁর বহুমূল্য শ’খানেক গণেশমূর্তির সংগ্রহ ভারতীয় জাদুঘরে দান করে যান, যা বিক্রি করলে তিনি কোটি কোটি টাকা পেতে পারতেন

Advertisement

সুদেষ্ণা বসু

শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ ০২:০৮
Share:

সময়টা ১৯৫০। বসন্ত চৌধুরীর বয়স তখন ২২। নাগপুরের দীননাথ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে আগের বছরই বিএসসি (মতান্তরে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র) করেছেন সেখানকার মরিস কলেজ থেকে। তার পর কিছুটা ইচ্ছের উপর ভর করে চড়ে বসেছেন বম্বে মেল-এর থার্ড ক্লাসের একটা কামরায়। গন্তব্য কলকাতা। বাসনা, সিনেমায় অভিনয় করা। স্কুলে খেলাধুলোয় বেশ নাম ছিল তাঁর। ভাল ক্রিকেট খেলতেন। নাটকও করেছেন বেশ কয়েক বার। তখন থেকেই মনের মধ্যে অভিনয়ের প্রতি তীব্র টান অনুভব করতে শুরু করেছিলেন। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর মুক্ত মনের বাসনাকে আগল দিতে চাননি।

Advertisement

তেরো বছর বয়সে বাবা সিদ্ধিশচন্দ্র চৌধুরীকে হারিয়েছেন তিনি। মা কমলা ও ভাই প্রশান্তকে নিয়ে পিতৃবিয়োগের পর নিজের ভবিষ্যৎ জীবন কেমন হবে, তা নিয়ে ভাসা ভাসা কিছু স্বাধীন ভাবনা ভিড় করত মনে। তাই বেরিয়ে পড়েছিলেন নিজের স্বপ্নকে সত্যি করা যায় কি না বাজিয়ে দেখতে। কলকাতা শহরের কাউকেই তিনি তেমন চিনতেন না। যদিও কলকাতার অদূরে আন্দুল গ্রামশহরে ছিল তাঁদের ‘দত্তচৌধুরী জমিদার বংশে’র ভিটেবাড়ি। একডাকে সেই পরিবারকে চেনে সারা বাংলা।

রামশরণ দত্তর বংশধর ঈশানচন্দ্রের পুত্র অপূর্বকৃষ্ণ দত্তচৌধুরী ‘দত্ত’ পদবি ব্যবহার করতেন না। তিনি আন্দুলের পৈতৃক ভিটে ছেড়ে নাগপুরে বসবাস করতে শুরু করেন ১৮৮৬ সাল থেকে। সেখানে তিনি আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাঁর পুত্র ফণিভূষণ। এই ফণিভূষণেরই ছেলে সিদ্ধিশচন্দ্র, জন্ম ৫ মে ১৯২৮, নাগপুরে।

Advertisement

‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ ছবির চিত্রনাট্য পড়া চলছে। রয়েছেন রামানন্দ সেনগুপ্ত, দেবকী বসু, সুচিত্রা সেন ও বসন্ত চৌধুরী

বসন্ত চৌধুরী অবশ্য কাউকে জানতেও দেননি তাঁর বংশ পরিচয়। তাঁর তখন একটাই পরিচয়, অভিনেতা। কলকাতার বৌবাজারে বন্ধু রবি দে চাকরি করতেন একটি ল্যাবরেটরিতে। তিনি সেই ল্যাবরেটরির অফিস ঘরের একটি টেবিলে রাতে বসন্তের শোয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সারা দিন কলকাতার বিভিন্ন স্টুডিয়ো পাড়ায় ঘুরে পরিচালক প্রযোজকদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, রাস্তার কোনও পাইস হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে, রাতে সেই টেবিলেই শুয়ে পড়তেন। তবে সিনেমার নায়ক হওয়ার মতো চেহারা ছিল বলে প্রযোজক পরিচালকদের চোখে পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি। বাংলা সিনেমায় তখন বিমল রায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, নীতিন বোস, কার্তিক চট্টোপাধ্যায়, অমর মল্লিক, সুবোধ মিত্রর মতো বাঘা পরিচালকরা কাজ করলেও বি এন সরকারের নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োর দীর্ঘ গৌরবময় ইতিহাসের শেষ অধ্যায় শুরু হয়ে গিয়েছে। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে তাদের ছবি ফ্লপ হতে শুরু করেছে। কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। যদিও সে সবের কিছুই তখন বসন্ত জানতেন না। তিনি কলকাতায় এসে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োতেই প্রথম হানা দিয়েছিলেন। কয়েক মাস ঘোরাঘুরির পর সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্টুডিয়ো ‘রাধা ফিল্মস’-এর মাধব ঘোষাল তাঁদের নতুন ছবি ‘মন্দির’-এর নায়কের চরিত্রে নির্বাচন করলেন বসন্তকে। ছবির পরিচালক ছিলেন দেবকী বসুর ভাইপো তথা সহকারী চন্দ্রশেখর বসু। তিন হাজার টাকার পিকচার কনট্র্যাক্ট হল। অগ্রিম হিসেবে বসন্ত পেলেন তিনশো টাকা। সেটাই তাঁর কলকাতায় এসে প্রথম রোজগার। টাকা হাতে পেয়ে তাঁর মনে হয়েছিল “আমিই বা কে আর লর্ড লিনলিথগোই বা কে!” শুটিং শুরু হল।

‘নয়া সফর’ ছবির একটি দৃশ্যে অন্য অভিনেতাদের সঙ্গে বসন্ত চৌধুরী

এমনই এক সময়ে শিল্প নির্দেশক সৌরেন সেনের সুপারিশে নিউ থিয়েটার্স থেকে ডাক এল বসন্তের। শুনলেন, নিউ থিয়েটার্সের নতুন ছবি ‘মহাপ্রস্থানের পথে’র নায়কের ভূমিকায় নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। নায়িকা নবাগতা অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়। পরিচালক কার্তিক চট্টোপাধ্যায়। আকাশ ভেঙে পড়ল তাঁর মাথায়। তিনি সৌরেনবাবুকে ‘মন্দির’ ছবির সঙ্গেই ‘মহাপ্রস্থানের পথে’র শুটিং করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। কিন্তু সৌরেনবাবু জানালেন, নিউ থিয়েটার্সের ছবিতে কাজ করলে আর কোনও ছবিতে কাজ করা যায় না। সেটাই শর্ত। বিভ্রান্ত, দ্বিধাগ্রস্ত বসন্ত ছুটে গেলেন রাধা স্টুডিয়োর মাধববাবুর কাছে। নিউ থিয়েটার্সের ছবির প্রস্তাবের কারণে ‘মন্দির’ ছবিতে কাজ করতে পারবেন না বলে জানাতেই, মাধববাবুর দাদা কেশববাবু তিন দিনের হয়ে যাওয়া শুটিংয়ের যাবতীয় খরচ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দাবি করে বসলেন।

অনেক চেষ্টায় ও দেবকী বসুর মধ্যস্থতায় ছাড়া পেয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী। শুটিংয়ের খরচ দিতে হয়নি বটে, তবে অগ্রিম হিসেবে পাওয়া তিনশো টাকা তিনি ফেরত দিয়েছিলেন। ৯ জুন ১৯৫২ মুক্তি পেয়েছিল বসন্ত চৌধুরী ও অরুন্ধতী দেবী অভিনীত কার্তিক চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিভাষিক সুপারহিট ছবি ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ (হিন্দি নাম ‘যাত্রিক’)। ছবিটিকে বাংলা সিনেমার প্রথম ‘ট্রাভেল ফিল্ম’ হিসেবে দেখা যেতে পারে। সেই সময়ের বাংলা ছবির নিরিখে এই ছবিকে অনেকেই অন্য ধারার ছবি বলে চিহ্নিত করেন।

ইন্দিরা গাঁধীর হাত থেকে বিএফজেএ পুরস্কার গ্রহণ করছেন বসন্ত চৌধুরী

চেহারার কারণেই দেবকী বসু চৈতন্যদেবের চরিত্রে বসন্ত চৌধুরীকে নির্বাচিত করেছিলেন। সেটা ছিল বসন্তবাবুর দ্বিতীয় ছবি। দেবকীবাবুর পুত্র পরিচালক দেবকুমার বসু জানাচ্ছেন, “শ্রীচৈতন্যদেবের চরিত্রে ওঁকে খুব মানিয়েওছিল। ঠিক যেমন পরবর্তী কালে রাজা রামমোহনের চরিত্রে তাঁর মধ্য দিয়েই বাঙালি সাক্ষাৎ রামমোহনকে দর্শন করেছিল। ১৯৫২ সালে ‘মহাপ্রস্থানের পথে’র বিপুল সাফল্যের পরে ’৫৩ সালে দ্বিতীয় ছবি ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ও বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। শ্রীচৈতন্যর চরিত্রে বসন্ত চৌধুরী ও বিষ্ণুপ্রিয়ার চরিত্রে সুচিত্রা সেনের অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ছবিটি ভক্ত দর্শকের কাছে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।” তাঁর স্মৃতিতে আছে, “বসন্তবাবু অভিনয় করার সময়ে একটু দুলতেন, ক্যামেরা জ়োনের পজ়িশন থেকে সরে যেতেন। বাবা ওঁকে সে ব্যাপারে সাবধান করে ফ্লোরে একটা গণ্ডি কেটে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এর বাইরে তুমি যেয়ো না’। ছবিটা করতে উনি খুব খেটেছিলেন। প্রবল অধ্যবসায় ছিল তাঁর।”

কিন্তু দুর্ভাগ্য! এর পরও বসন্ত-সুচিত্রাকে প্রমথেশ বড়ুয়া পরবর্তী ও প্রাক-উত্তম পর্বে বাংলা ছবির এক সম্ভাবনাময় বাণিজ্যসফল জুটি হিসেবে ভাবতে পারেননি প্রযোজক পরিচালকেরা। তথ্যের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ১৯৫৩ সালে বসন্ত অভিনীত, সুবোধ মিত্র পরিচালিত ‘নবীন যাত্রা’ (বাংলা) বা ‘নয়া সফর’ (হিন্দি) ছবিটি মুক্তি পায়, যেখানে প্রথম বসন্ত ও উত্তমকুমার অভিনয় করেন। ছবিটির বাংলা সংস্করণের নায়ক উত্তম আর হিন্দিতে বসন্ত চৌধুরী (নায়িকা মায়া মুখোপাধ্যায়)।

১৯৫৪-তে নীরেন লাহিড়ীর ‘যদুভট্ট’-তে বসন্ত পার্শ্বচরিত্র। কিন্তু ১৯৫৫ সালে তাঁর চারটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল— ‘দুজনায়’, ‘ভালোবাসা’, ‘দেবীমালিনী’, ‘অপরাধী’। এর মধ্যে কেবল দেবকী বসুর ‘ভালোবাসা’ ছবিতে সুচিত্রা সেন আছেন নায়িকা হিসেবে। বেশ বোঝা যায়, বসন্ত চৌধুরীকে ঘিরে সাময়িক একটা আগ্রহ পরিচালকদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল বটে, তবে এই পর্বটি ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী। অদ্ভুত কিছু ঘটনাক্রমের কারণে বসন্ত চৌধুরী বাংলা সিনেমায় ‘স্টার’ নয়, আভিজাত্যে ভরা এক অভিনেতা হিসেবে মান্যতা পেয়েছিলেন।

১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ থেকে শুরু করে আরও সাতটি ছবির ব্যর্থতা পার হয়ে ১৯৫৪ সালে মুক্তি পায় অগ্রদূত গোষ্ঠীর ‘অগ্নিপরীক্ষা’। এতে উত্তম-সুচিত্রার বাণিজ্যসফল জুটি বড়ুয়া-পরবর্তী বাংলা ছবির দর্শকের সামনে যেমন হাজির হয়, তেমনই ১৯৫৫ সালে নিউ থিয়েটার্স যুগেরও অবসান ঘটে। এই অবসান বাংলা সিনেমার গতি ও প্রকৃতিকে বদলে দিয়েছিল। সেই সঙ্গে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলার সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশও প্রভাব ফেলেছিল বাংলা সিনেমায়। তাই চলচ্চিত্র ব্যবসার যুক্তিহীন ও উদ্ভট ঘটনাবলির কারণে বাংলা ছবির দর্শকের কাছে বসন্ত-সুচিত্রার বদলে উত্তম-সুচিত্রা জুটি জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। এমন অবস্থার সামনে দাঁড়িয়ে বসন্তর অসহায় লেগেছিল। তিনি নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “খুব চাপে পড়ে গিয়েছিলাম।”

বসন্ত-উত্তমের ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপরে অবশ্য এর কোনও ছাপ পড়েনি। দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব চিরকাল অটুট থেকেছে। উত্তমকুমার স্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর যে সব ছবিতে দু’জনে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই বসন্ত চেষ্টা করেছেন নিজস্ব এক অভিনয়শৈলীকে কাজে লাগাতে। সফলও হয়েছেন ক্রমশ। যেমন, ‘বকুল’ (হিন্দি), ‘হারজিৎ’, ‘শঙ্করনারায়ণ ব্যাঙ্ক’, ‘শঙ্খবেলা’ এবং ‘যদি জানতেম’। বসন্তর কথায় তিনি নির্দিষ্ট কোনও ইমেজ তৈরি করতে চেষ্টা করেননি কখনও। তাই ওই ছবিগুলিতে উত্তমকুমারের পাশে নিজস্ব প্রতিভায় বসন্ত চৌধুরী ভাস্বর হয়ে রয়েছেন আজও। এর একটা বড় উপমা হয়তো ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবিটি। ‘মহাপ্রস্থানের পথে’, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’র দিনগুলি থেকে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছিলেন তত দিনে। চলচ্চিত্রে অভিনয় নিয়ে তাঁর ভাবনা তখন পরিষ্কার। লিখেছেন, “চলচ্চিত্রে পারফরমেন্সের প্রশ্ন ওঠে না। বিহেভিয়ারের কথা আসে। এখানে অভিনয়ের টেকনিক্যালিটিস বড় নয়, আচরণের সুষমাই মুখ্য।”

একজন স্টারের অভিনয়-জীবনের বিপদের দিকটা তিনি আশ্চর্য ক্ষমতায় বুঝতে পেরেছিলেন। বলেছেন, “বার বার ব্যবহারে কোনও অভিনেতা তাঁর নিজস্ব ‘টাইপ’-এ অনেক সময়ে একটি ‘ইমেজ’-এ আবদ্ধ হয়ে যান। তখন তাঁকে ঘিরে তৈরি হয় নিজস্ব ভক্তমণ্ডলী আর তখনই চলচ্চিত্র অভিনয়ে ‘পারফরমেন্স’-এর অনুপ্রবেশ ঘটে।” মাধবী মুখোপাধ্যায়ের ধারণা, “এই উক্তি অভিনেতা বসন্ত চৌধুরীকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। বোঝা যায়, উত্তমকুমারের প্রচণ্ড খ্যাতির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি কেমন করে নিজের জায়গাটিকে আলাদা করে নিয়েছিলেন। এই জন্যই বাংলা সিনেমায় ‘বসন্তদা’ তাঁর যাবতীয় দৈহিক সৌন্দর্য, কণ্ঠমাধুর্য আর পৌরুষ নিয়ে এক অনন্য অভিনেতার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছিলেন আজীবন।”

সারা জীবনে প্রায় শতাধিক ছবিতে অভিনয় করলেও আশ্চর্য এই যে, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র তথ্যভাণ্ডার মাত্র ৭৪টি ছবির সন্ধান দিতে পেরেছে, যার মধ্যে ৭টি হিন্দি। এর মধ্যে ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’, ‘আঁধারে আলো’, ‘রাজা রামমোহন’, ‘যদুভট্ট’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘শুভরাত্রি’, ‘মেঘ কালো’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’, ‘অনুষ্টুপ ছন্দ’, ‘বৈদুর্য্যরহস্য’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘দেবী চৌধুরাণী’, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ ‘হীরের আংটি’, ইত্যাদি ছবির জন্য বসন্ত চৌধুরীকে বাঙালি মনে রেখেছে। তাঁর অভিনীত হিন্দি ছবিগুলি যথাক্রমে ‘যাত্রিক’, ‘নয়া সফর’, ‘বকুল’, ‘পরখ’, ‘গ্রহণ’, ‘ময়ূরী’, ও ‘এক ডক্টর কী মওত’। ‘রাজা রামমোহন’ ছবির জন্য তিনি ‘বিএফজেএ’ পুরস্কার পান। দীর্ঘ মঞ্চ অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে ‘স্টার থিয়েটার অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয়।

কলকাতার পাবলিক থিয়েটারেও বসন্ত চৌধুরী অভিনয় করেছেন পঞ্চাশের দশক থেকেই। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরোগ্য নিকেতন’ নাটকে নবীন চিকিৎসকের প্রধান চরিত্র দিয়ে তাঁর থিয়েটার জীবনের সূচনা হয়। তার পর ‘দেনা পাওনা’, ‘বিপ্রদাস’, ‘অগ্নিকন্যা’-সহ বহু নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। স্টারে ‘কালবৈশাখী’ ও ‘ক্ষুধা’ ৫০০ রজনী চলেছিল। ষাটের দশকে ‘শ্রেয়সী’ দর্শককে মাতিয়ে রাখত। আকাশবাণীতেও তাঁর কণ্ঠে বেতার নাটক শুনতে শুক্রবার রাত পৌনে আটটায় শ্রোতারা রেডিয়ো খুলে বসতেন।

এক সময়ে নট্ট কোম্পানির হয়ে বসন্ত চৌধুরী যাত্রা করেছেন নিয়মিত। সেখানে অভিনয়ের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, “আমার কাছে যাত্রা মানে খোলা চষা মাঠ। ধান কাটার পর খড়ের গোঁজ বেরিয়ে আছে মাঠে। তার ওপর ইউরিয়া সারের পলিবস্তা জুড়ে জুড়ে পাতনি...অমন জায়গায় তিনশো ফুট বাই তিনশো ফুট প্যান্ডেল। কমপক্ষে পঁচিশ হাজার লোক ধরে। অতগুলো লোককে ধরে রাখা সহজ কথা?”

বছর দুয়েক টানা যাত্রা করেছিলেন। এই যাত্রা করতে যাওয়ার পিছনে তাঁর আর একটা উদ্দেশ্য ছিল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক স্যমন্তক দাস জানিয়েছেন, “আসলে উনি যাত্রায় নাম লিখিয়েছিলেন কতকগুলো বিষয় মাথায় রেখে। যার একটা হল, পশ্চিমবঙ্গে বহু জায়গায় তিনি ঘুরেছেন, কিন্তু যাত্রায় অভিনয় করার সুবাদে আরও বহু না-জানা জায়গায় ঘোরা হয়ে যাবে, এটা ওঁর মাথায় থাকত। হয়েছিলও তাই। পুরনো মন্দির, বাড়ি, বহু জিনিসপত্র ওঁর দেখা হয়েছে। বহু গ্রামীণ সংস্কার, গ্রামীণ বিশ্বাস সম্পর্কে জেনেছেন, যা ওঁর জানা ছিল না। এর ফলে এক অন্য বসন্ত চৌধুরীর পরিচয় আমরা পেয়েছি।”

আবার বসন্ত চৌধুরী মানেই বাঙালিয়ানা, যার শুরু তাঁর পোশাকআশাক দিয়ে। কন্দর্পকান্তি চেহারার সঙ্গে আমে দুধের মতো মিশত গলার ভারী আওয়াজ। শান্ত চলন এবং গভীর চাহনি। চওড়া কপাল থেকে পায়ের বিদ্যাসাগরী চটি অবধি এক পূর্ণ বাবুটি যেন! কিন্তু এই বহিরঙ্গের আড়ালে বসন্ত চৌধুরী সাহেবও ছিলেন। থেকে থেকে চমৎকার ইংরেজি মিশিয়ে বাংলা কথা, সেরা ফরাসি কনিয়াকের রুচি, নিবিড় আমেজে হাভানা চুরুটে টান, প্রাচীন মুদ্রা, ডাকটিকিট, গণেশ মূর্তি ও জামেয়ার সংগ্রহ ও তা নিয়ে পড়াশোনা, খাটাখাটনি ও অর্থব্যয়ে অপরূপ ও দুষ্প্রাপ্য সব শাল কেনা আর সর্বোপরি এক বিচিত্র, বিস্তীর্ণ বই পড়ার নেশা। তাঁর বাঙালিয়ানা সম্পর্কে রাধাপ্রসাদ গুপ্তর (শাঁটুল) মন্তব্য, “ও একটা রোবাস্ট ভদ্রলোক। অনেক দিকে মাথা খেলে। কিন্তু পল্লবগ্রাহী নয়। ভীষণ সেন্স অব হিউমার, কিন্তু কোথায় যেন একটা মেলানকলির ছোঁয়া।”

এই বিষাদের রহস্য হয়তো লুকিয়ে আছে তাঁর বিবাহিত জীবনের ব্যর্থতার ইতিবৃত্তে। ১৯৫৭ সালে কবি অজিত চক্রবর্তীর ছোট ছেলে যুধাজিৎ চক্রবর্তীর কন্যা অলকা চক্রবর্তীকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন বসন্ত চৌধুরী। সে বিয়ের রেজিস্ট্রি কাউকে না জানিয়েই হয়েছিল বলে জানিয়েছেন অলকার পিসতুতো দিদি অভিনেত্রী স্মিতা সিংহ। পরে সামাজিক অনুষ্ঠান হয়। স্মিতা জানিয়েছেন, “ওর নামটা রবীন্দ্রনাথের দেওয়া, আষাঢ় মাসে জন্ম তাই, অলকানন্দা। নানা গুণের অধিকারী ছিল। কবিতা লিখত, ভাল ছবি আঁকত, দারুণ নকল করতে পারত। জ্বলজ্বলে চোখে সুন্দর করে তাকাত বলে আমার বাবা ওর নাম দিয়েছিলেন জুলু। এত ফরসা এবং সুন্দর ছিল যে, লোরেটো হাউসে যখন ভর্তি হল (তখন ব্রিটিশ আমল, ইয়োরোপিয়ান ও ইন্ডিয়ানদের আলাদা বিভাগ ছিল), ওর সহপাঠী লিয়াকত আলির (পরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট) ছেলেকে আর ওকে প্রথা ভেঙে ইউরোপিয়ান বিভাগে নিয়েছিলেন মাদার সুপিরিয়র। বসন্তর সঙ্গে জুলুর বয়সের ব্যবধান ছিল প্রায় চোদ্দো বছর।”

অমিতা-অজীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রবধূ কৃষ্ণা জানিয়েছেন, “জুলু শুধু সুন্দরী ছিল না, স্বভাবটিও ছিল মধুর। মিশুকে। ‘অপরাজিত’ ছবিতে লীলার ভূমিকায় ওকে নির্বাচিত করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। সুকুমার রায়ের পরিবারের সঙ্গে ওর মা লাবণ্যলেখা ও বাবা অজিত চক্রবর্তীর পরিবারের সখ্যর কারণে সত্যজিৎ চিনতেন অলকাকে। কিন্তু বসন্ত এতটাই রক্ষণশীল ছিলেন যে, শুটিং ফ্লোর থেকে জুলুকে নিয়ে চলে এসেছিলেন। বসন্ত চাননি, উনি যাকে বিয়ে করবেন সে অভিনেত্রী হবে। ফলে বাধ্য হয়ে সত্যজিৎ রায় ছবি থেকে লীলা চরিত্রটি বাদ দেন।”

শ্বশুরমশাই যুধাজিৎ চক্রবর্তীর বিজ্ঞাপন সংস্থা ‘কল্পনা অ্যাডভার্টাইজ়িং’-এ এক সময়ে বসন্ত কাজ করেছেন। দু’বাড়ির দূরত্ব বলতে ছিল একজন রিজেন্ট গ্রোভ অন্যজন বাঁশদ্রোণী। বিয়ের পরে অলকা ইন্টিরিয়র ডিজ়াইনার হিসেবে কাজ করতেন। দিল্লির ‘বঙ্গভবন’, কলকাতার ‘হোটেল রাতদিন’ সাজিয়েছিলেন। কিন্তু দু’জনের সম্পর্ক এক সময়ে ভেঙে যায়। কারণ হিসেবে বসন্তবাবু কেবল একটাই শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, ‘অসামঞ্জস্য’। কিন্তু স্মিতা সিংহের কথায়, “বসন্ত খুব রিজিড ছিল। সন্দেহবাতিকও ছিল। ‘বাইরে থেকে দেখলে ওকে একদম বোঝা যায় না’—এমন অভিযোগ আমি অলকার কাছ থেকে শুনেছি।” আর কৃষ্ণা ঠাকুরের মতে, “অলকা বয়সে বসন্তর চেয়ে এতটাই ছোট ছিল যে, ওর সংসার করার মতো ম্যাচিয়োরিটি তখন ছিল না। শাশুড়ি-পুত্রবধূর সম্পর্কের সমস্যাও ছিল। তবে বসন্তর ডুয়াল পার্সোনালিটির কথা আমিও শুনেছি।”

জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ প্রবাদপুরুষ সনৎ লাহিড়ী ছিলেন অলকার নিজের মামা। তাঁর পুত্র মনোজিৎ বিয়ে করেছেন চিদানন্দ দাশগুপ্তর দ্বিতীয় কন্যা অনুরাধাকে। অলকা সম্পর্কে অনুরাধা জানিয়েছেন, “ও ছিল খুব আদরের মেয়ে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হতে পারত না বলে ওর জন্য গাড়ি কেনা হয়েছিল। ওর বেড়ে ওঠা ছিল ভীষণই পাশ্চাত্য অনুসারী। সে তুলনায় বসন্ত চৌধুরী ছিলেন একেবারে খাঁটি বাঙালি। আজ আর কেউ বেঁচে নেই। দু’জনেই খুব গুণী এবং ভাল মানুষ ছিলেন। কোনও কারণে ওঁদের সম্পর্ক দানা বাঁধতে পারেনি। পরে খুকুদি (অলকা) আবার বিয়ে করেছিলেন একজন আর্মি অফিসারকে। ওঁদের কৃতী দুই ছেলে সৃঞ্জয় ও সঞ্জিতকে বসন্তবাবুই মানুষ করেছেন।”

সুরা, সিগার, পঞ্চব্যঞ্জন বিলাসী, ড্রয়িংরুম আলো করা গল্পপটু বসন্ত চৌধুরীর কোনও ছায়া নেই ওঁর গম্ভীর, প্রধানত দুঃখী, কখনও রোম্যান্টিক হলেও বেদনার কারণেই স্মরণীয় সিনেমার চরিত্রগুলোয়। তিনি ছিলেন ভরদ্বাজ গোত্র কনৌজিয়া কায়স্থ দত্ত চৌধুরী বংশের সন্তান। কান্যকুব্জ থেকে বাংলায় আসা প্রথম পুরুষ পুরুষোত্তম দত্ত থেকে ধরলে আন্দুল দত্তচৌধুরী বংশের ষোড়শ পুরুষ হলেন বসন্ত চৌধুরী। জীবন ও সিনেমার সম্পূর্ণ দু’টি ভিন্ন সরণিতে হেঁটে গিয়েছেন দু’টি ভিন্ন সাফল্যের লক্ষ্যে।

তাঁর অসমবয়সি বন্ধু তথা দীর্ঘ দিনের কাজের সঙ্গী আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল গৌতম সেনগুপ্ত ধরিয়ে দেন, “বসন্ত চৌধুরী আভিজাত্য, বনেদিয়ানা নিয়ে কেবল মাত্র একজন অভিনেতা ছিলেন না। ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের ব্যাপারে কলকাতার এক কিংবদন্তি চরিত্রও তিনি। ত্রিপুরা, কোচবিহার, আরাকান-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পুরনো রাজতন্ত্র ও প্রত্নতত্ত্বের তিনি বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এ সব বিষয়ে দেশি-বিদেশি গবেষণা পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখেছেন। মুদ্রা ও গণেশমূর্তি সংগ্রাহক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। দুর্লভ ও প্রাচীন গণেশমূর্তি সংগ্রহের জন্য চষে বেড়িয়েছেন সারা ভারত, চট্টগ্রাম, মায়ানমার, নেপাল থেকে নিউ ইয়র্ক। তাঁর প্রাচীন মুদ্রার সংগ্রহ দেখতে ইতিহাসের প্রখ্যাত অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় নিজে এসেছিলেন তাঁর বাড়িতে।”

এই গণেশ সংগ্রহের নেপথ্য কারণ হিসেবে বসন্ত চৌধুরী বলেছেন, “ছেলেবেলায় আমি বড় হয়েছি মহারাষ্ট্রে, যেখানে গণপতি বাপ্পার উপাসনা প্রায় ঘরে ঘরে। এই দেবতার প্রতি আমার আগ্রহ শৈশবে দেখা দশ দিনের গণেশ উৎসব থেকেই।” স্যমন্তক জানিয়েছেন, “মেসোমশাইয়ের সংগ্রহে এমন অনেক গণেশমূর্তি ছিল, বিশ্বে আর কারও কাছেই যা ছিল না। যেমন, ‘পঞ্চদ্বাররোধী যোগগণেশ’ বা ‘ধ্যানী গণেশ’। গণেশ সংগ্রহ করতে গিয়ে নানা মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর। একবার ছোট্ট একটি লোকশিল্পের গণেশ জোগাড় করেছিলেন এক খ্রিস্টান বন্ধুর কাছ থেকে। মূর্তিটির সঙ্গে সেই বন্ধু মেসোমশাইকে একটি পঁচিশ পয়সার কয়েন দেন। এটাই রীতি বলে তিনি জানান। যেহেতু গণেশ সমৃদ্ধি ও সিদ্ধির দেবতা, তাই তার মূর্তি হস্তান্তর করায় অর্থক্ষতির আশঙ্কা থাকে।”

মৃত্যুর কিছু দিন আগে বসন্ত চৌধুরী তাঁর বহুমূল্য শ’খানেক গণেশমূর্তির সংগ্রহ ভারতীয় জাদুঘরে দান করে যান, যা বিক্রি করলে তিনি কোটি কোটি টাকা পেতে পারতেন। চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ নবীনানন্দ সেনকে ভারতীয় জাদুঘরের একটি গ্যালারি ঘুরে দেখিয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী। সে দিন তাঁদের সঙ্গী ছিলেন গৌতম সেনগুপ্তও। সেখানে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্ট পরবর্তী প্রথম শতক পর্যন্ত সময়কালের দুর্লভ সব প্রত্নসামগ্রী সাজানো ছিল। নবীনানন্দ জানাচ্ছেন, “বসন্ত চৌধুরী সেই গ্যালারিতে ঘুরতে ঘুরতে, একটার পর একটা প্রত্নসামগ্রীকে জীবন্ত করে তুলতে লাগলেন। এক দক্ষ জাদুকরের মতো শূন্যে হাত নেড়ে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরছেন ধূসর ইতিহাসের এক-একটা যুগের শিল্প নিদর্শন। এক লহমায়, অবলীলায়! পাশাপাশি দেখছি বসন্ত চৌধুরীকেও। তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। সম্ভ্রমী ব্যক্তিত্ব। যেন স্টুডিয়োর শুটিং ফ্লোরের সেটে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করছেন টুরিস্ট গাইডের ভূমিকায়।”

কলকাতার জাদুঘরের ট্রাস্টি, সেন্সর বোর্ড ও নন্দনের চেয়ারম্যান, ঢাকার এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য, কলকাতার শেরিফ... একাধিক পদে ছিল বসন্ত চৌধুরীর অনায়াস পদচারণা। তিনি জানিয়েছেন, তিন জন মানুষ তাঁর জীবনে প্রভাব ফেলেছিলেন। অভিনেতা ছবি বিশ্বাস, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়। বলেছেন, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্যই কলকাত্তাইয়া বনেদি কৃষ্টির পরিমার্জিত ছাপটি তিনি তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ ও বাচনরীতিতে এনেছিলেন। আর ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের জন্যই তিনি সংগ্রাহক হয়েছিলেন। ছবি বিশ্বাস তাঁর অভিনয়শৈলীকে গড়তে সাহায্য করেছিলেন।

এ সব সত্ত্বেও বসন্ত চৌধুরী ছিলেন মিশুকে মানুষ। তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে পারত যে কেউ। স্টুডিয়োর সামান্য টেকনিশিয়ান থেকে পরিচালক, সাধারণ থেকে ধনী মানুষ কাউকেই তিনি তাঁর আভিজাত্য দিয়ে দূরে ঠেলতেন না। অভিনয়ের জন্য চরিত্রদের ফুটিয়ে তুলতে খুব সাধারণ মধ্যবিত্তের বাড়ি গিয়ে চা খেয়ে আড্ডা দিয়েছেন দিনের পর দিন। বহু দুঃখেও কখনও তিনি জীবনবিমুখ হননি।

বাংলা সাংস্কৃতিক মহলে সকলের প্রিয় বসন্ত চৌধুরী ২০ জুন ২০০০ সালে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে এক বৃষ্টিভেজা ভোরে (সাড়ে পাঁচটায়) তাঁর রানিকুঠির বাড়িতে মারা যান। মৃত্যুর পরে তাঁর দুই ছেলে সকলের অজ্ঞাতসারে তাঁর সৎকার করেন। তেমনই নির্দেশ ছিল বসন্ত চৌধুরীর ইচ্ছাপত্রে। প্রথামাফিক তাঁর পারলৌকিক কাজও করতে তিনি নিষেধ করে গিয়েছিলেন।

বসন্ত চৌধুরীর এমন নিঃশব্দ প্রস্থানের খবর পেয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “বসন্তদা ইদানীং বলতেন, টালিগঞ্জের স্টুডিয়োতে আর যেতে ইচ্ছে করে না। কারণ সেই পরিবেশ তো আর নেই। ... ওঁর এই ভাবে চলে যাওয়ার ব্যাপারটা সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।’’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া ছিল, “ওঁর চলে যাওয়াটা সত্যিই খুব খারাপ লাগার। ভাল শিল্পী, ভাল মানুষ দুটোই একসঙ্গে তো বড় পাওয়া যায় না।” তপন সিংহ জানিয়েছিলেন, “ওঁর এই নিঃশব্দে চলে যাওয়াটা খুব সুন্দর। মৃতদেহ নিয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা ভালবাসার নামে চূড়ান্ত বাঁদরামি, অশ্রদ্ধা এ সব কোনও কিছুর সুযোগ দেননি কাউকে। খুবই ভাল। এ ভাবেই মানুষের যাওয়া উচিত, নিঃশব্দে।” মাধবী মুখোপাধ্যায়ের মনে হয়েছিল, “সুন্দর এক অহঙ্কারী মানুষ নিজের অহঙ্কারকে সযত্ন লালন করে নিঃশব্দে চলে গেলেন।”

ঋণস্বীকার: সাত রং: রবি বসু, অঞ্জন দাস মজুমদার

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement