বলিউডের মাইলফলক বলে যে ছবিগুলিকে ধরা হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম ‘গাইড’। অথচ এই ছবিকেই মুক্তি পেতে হয়েছিল অজস্র সমস্যার বাধা অতিক্রম করে।
আর কে নারায়ণের সাহিত্য অ্যাকাডেমি প্রাপ্ত উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৫ সালে। প্রথমে দেব আনন্দ ঠিক করেছিলেন তিনি হিন্দি ও ইংরেজি, দু’টি ভাষায় ছবিটি তৈরি করবেন। দ্বিভাষিক ছবির শুটিং হবে একইসঙ্গে।
ইংরেজি সংস্করণের জন্য দেব আনন্দ চিত্রনাট্যকার হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক পার্ল এস বাক-কে। পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ট্যাড ড্যানিয়েলয়েস্কি।
প্রথমে গাইড-এর একই দৃশ্য দু’বার করে শুটিং হতে থাকে। প্রথমে ইংরেজিতে, তার পরে হিন্দিতে শুট করা হত প্রতিটি দৃশ্য। কিন্তু বিরোধ বাধে দুই পরিচালকের মধ্যে। হিন্দি সংস্করণের পরিচালক বিজয় আনন্দ ভাবছিলেন এক রকম করে। ইংরেজি সংস্করণের পরিচালক ড্যানিয়েলয়েস্কি এগোচ্ছিলেন অন্য পথে।
এর পর ঠিক হল, হিন্দি ছবির শুটিং পরে হবে। প্রথমে ‘গাইড’-এর ইংরেজি সংস্করণ মুক্তি পেল। কিন্তু ভারতীয় অভিনেতাদের মুখে ইংরেজি সংলাপের ওই সিনেমা বক্স অফিসে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়।
সাহিত্যিক আর কে নারায়ণও ইংরেজিতে ‘গাইড’ দেখে খুব ক্ষুব্ধ হন। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর লেখা উপন্যাস থেকে অনেকটাই বিচ্যুত হয়েছে ছবি।
১৯৬৫ সালে মুক্তি পায় ‘গাইড’-এর হিন্দি সংস্করণ। এই ছবি সবথেকে বেশি প্রশংসিত হয় এর গানের জন্য।
ছবির ‘দিন ঢল যায়’ গানটি প্রথমে লিখেছিলেন হসরত জয়পুরী। কিন্তু গানটি তাঁর নিজের এবং পরিচালকের মনের মতো হচ্ছিল না। এর পর বিজয় আনন্দ গানটি লেখার দায়িত্ব দেন শৈলেন্দ্রকে।
কিন্তু শৈলেন্দ্র সে সময় মূলত রাজ কপূরের ছবির জন্য গান লিখতেন। শোনা যায়, তিনি নিজের সে সময়কার পারিশ্রমিকের থেকে অনেক বেশি দাবি করেছিলেন। যাতে তাঁকে গান না লিখতে হয়।
কিন্তু বিজয় আনন্দ এবং সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেব বর্মন তাঁকে বহু গুণ বেশি পারিশ্রমিক দিয়েই গান লেখান। ‘দিন ঢল যায়’ গানটির প্রথম লাইন হসরত জয়পুরীর লেখা। তার পরের অংশ লেখা শৈলেন্দ্রর।
তবে মুক্তি পেতেও সমস্যা হয় এর বিষয়বস্তুর কারণে। গল্পের বিষয় হল বিবাহিত রোজির সঙ্গে গাইড রাজুর প্রণয়। তৎকালীন ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক থেকে আপত্তি তোলা হয়। বলা হয়, এক জন ভারতীয় বিবাহিতার সঙ্গে এ রকম পরকীয়া সম্পর্ক দেখানো কতটা সঙ্গত? অথচ তার কয়েক বছর আগেই পুরস্কৃত হয়েছে উপন্যাসটি।
ছবির শুটিংয়ের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন শচীন দেব বর্মন। তাই আর ডি বর্মনের উপস্থিতিতে রেকর্ডিং হয় ‘গাতা রহে মেরা দিল’ গানটি। বাকি সব গানের রেকর্ডিং করিয়েছিলেন শচীন দেব বর্মন নিজেই। ফলে অন্য গানগুলির সঙ্গে এই গানটির গায়কি ও অন্যান্য বিষয়ে কিছুটা হলেও পার্থক্য আছে।
গানটির দৃশ্যায়নেও বিশেষত্ব আছে। বেশির ভাগ অংশের শুটিং করেছিলেন ওয়াহিদা রহমানের বডি ডাবল আশারানি সিংহ। ওয়াহিদা নিজে খুবই ভাল নৃত্যশিল্পী। কিন্তু তাঁর বদলে ট্রাকের উপরে বা খোলা রাস্তার উপরে শট দিয়েছিলেন আশারানি। ক্লোজআপ শট নেওয়া হয়েছিল ওয়াহিদার।
একমাত্র এই ছবিতেই ‘সাঁইয়া বেইমান’ গানের সঙ্গে পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা তবলা বাজিয়েছেন। সন্তুরের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী প্রথম জীবনে শুরুতে তবলা বাজাতেন। তবে শুধুমাত্র এই ছবিতেই তিনি তবলায় বোল তুলেছেন।
এটাই ছিল দেব আনন্দের প্রথম রঙিন ছবি। ছবির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছিল বৃষ্টি। এবং ‘গাইড’ যে দিন মুক্তি পেল, সে দিন মুম্বইয়ে ভারী বৃষ্টি হয়েছিল।
ছবির ইংরেজি সংস্করণ এতটাই ফ্লপ হয়েছিল যে এর কোনও ডিভিডি বা ক্যাসেট কিছুই আজকাল পাওয়া যায় না। শুধু ইউটিউবে কিছু দৃশ্যের ক্লিপিংস আছে।