Silk Smitha

Silk Smitha: জন্মদিনে ফিরে দেখা: পর্দায় সিল্ক স্মিতার উন্মুক্ত পিঠ! তার ঠিক পরেই নেমে আসত অন্ধকার

খোলা ঊরুৎ, স্পষ্ট নাভি আর ঈষৎ স্ফিত কোমরের কাছে বাঙালি কৈশোরের কত জাহাজ যে ডুবে গিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই!

Advertisement

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২১ ০৯:১৭
Share:

গ্রাফিক : শৌভিক দেবনাথ

“অ্যাই, সিল্ক স্মিতা সমাস বল তো!” ক্লাস ইলেভেনের ওস্তাদ দাদা ভ্যাবলা প্যাটার্নের ছেলেটির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিতেই সে সন্ত্রস্ত। তার তখন ক্লাস এইট। আশির দশকের সেই সময়ে ‘সিল্ক স্মিতা’ সমাসবদ্ধ পদ নাকি সমাস-বিচ্ছিন্ন, তা ভেবে দেখার আগেই কেমন এক শিহরণ পেয়ে বসে। ক্লাস এইট (তখনও হাফ প্যান্ট) মানে অবচেতনের কীসব কীসব যেন উঠে আসা স্বপনে-জাগরণে। অপরাজিতা-নীল স্কার্ট পরিহিতা সমবয়স্কার প্রতি বাঁধভাঙা উন্মন। আর তাদের নিস্পৃহ চাহনির, প্রকট অহমিকা আর ইচ্ছাকৃত অবজ্ঞার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সেই সব সিনেমার পোস্টার অবলোকন, যেখানে সিল্ক স্মিতা দেখা দিচ্ছেন। খোলা ঊরুৎ, স্পষ্ট নাভি আর ঈষৎ স্ফিত কোমরের কাছে বাঙালি কৈশোরের কত জাহাজ যে ডুবে গিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই! সেই সিল্ক স্মিতার সমাস!মাথায় উড়ন চাঁটি মেরে উঁচু ক্লাসের দাদা বলেছিল, “পারলি না তো! জেনে রাখ। কাজে দেবে। স্মিতা সিল্কের ন্যায়।”

Advertisement

কাজে এসেছিল কি নাবলা কঠিন। কিন্তু ‘সিল্ক’ এবং ‘স্মিতা’ দুই শব্দ পাশাপাশি বসে যে আবেশটি তৈরি করত, তা অন্য যে কোনও অনুভবের চেয়ে আলাদা। আশির দশকে যে সব পুরুষেরা কৈশোর পেরিয়েছেন, এই নাম তাঁদের কাছে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞান। পশ্চিমবঙ্গ নামের ভূগোলে সেই সময় মাথার উপর এক ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’-মার্কা সরকার আর পায়ের নীচে বিবিধ সংশয়ে দীর্ণ টলটলায়মান এক জমি। ন্যায়-অন্যায়ের সংশয়, শ্লীলতা-অশ্লীলতার সংশয়। পুজোর সময়ে লাল শালু মোড়া সিপিএমের বইবিপণির পাশেই শোভা পাচ্ছে শহরের ‘বিধুশ্রী’ বা শহরতলির ‘আনন্দম’ হলের পোস্টার।

গোটা দেশ এবং তৎসহ বাঙালির নব্যতর প্রজন্ম সিল্ক স্মিতাকে দেখার চেষ্টা করেছে বিদ্যা বালন অভিনীত ‘ডার্টি পিকচার’ ছবিতে। কিন্তু তারও আগের এবং আগের প্রজন্ম সিল্ক স্মিতার জন্মদিন খেয়াল করলে নাও ভাসায় অন্য উজানে।

Advertisement

খোলা ঊরুৎ, স্পষ্ট নাভি আর ঈষৎ স্ফিত কোমরের কাছে বাঙালি কৈশোরের কত জাহাজ যে ডুবে গিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই!

মালয়ালাম ভাষার ছবি, কিন্তু মালয়ালি নামের নীচেই থাকত একটা ইংরেজি নাম। মালয়ালি জানা ছিল না। কিন্তু ইংরেজি নামগুলি অনেক সময়েই এই রকম হত— ‘সেক্সি নাইটস’, ‘হার নাইটস’ বা ‘প্যাশন অব দ্য প্যাশন’ ইত্যাদি। এবং সেই সব পোস্টারের মোমজোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে ‘লাস্য’ নামক শব্দটিকে মূর্ত করে দাঁড়িয়ে অথবা বসে (অথবা এমন কিছু বিভঙ্গে, যার নাম তখন কেউ জানত না, আজও কেউ জানে বলে মনে হয় না) থাকতেন সিল্ক স্মিতা। পোস্টারের এক কোণে থাকত একটি বৃত্তের মধ্যে ইংরেজি বর্ণমালার প্রথম অক্ষরটি। যার মর্মার্থ ইশারা দিত কিশোরকালকে কোনও গূঢ় স্বর্ণরসায়নে যৌবনে বদলে দেওয়ার।

সেই সব সিনেমা প্রদর্শিত হত শহরতলির প্রেক্ষাগৃহগুলিতে বেলা সাড়ে ১১টায়। সেই বিশেষ প্রদর্শনের নাম ছিল ‘নুন শো’। সেই আভাতিবেলায় লবণাম্বু-সিক্ত শরীরে ইংরেজি ‘এ’ অক্ষর বা তার চারপাশে স্থিত বৃত্তকে কাঁচকলা দেখিয়ে ইস্কুল-পালানো ছোকরার দল হাজির হত হলের আনাচে কানাচে। হলের সামনে ম্যাটিনি বা ইভনিং শো যেমন জটলা বানাতে পারত, নুন শো তেমনটি পারত না। কারণ, ওই সিল্ক স্মিতা নামক রহস্য, যা সামাজিকতার বাইরে এক ‘অন্য’ বলয়, যেখানে ‘জটলা’ হয় না। হতে পারে না।

হলের গায়ে সাঁটা পোস্টারে সেই মর্মনারীর শরীরের খোলা অঙ্গগুলিতে কে বা কারা সুচারু ভাবে রং করে তাকে তথাকথিত ভব্য সমাজের উপযোগী চেহারা দান করতেন। কিন্তু তাতে ফল ফলত উল্টো। সিল্ক স্মিতার শরীরের ঠিক কোন কোন স্থান ওই চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত হয়েছে, তা জানিয়ে দিত ওই সব রঙের কারুকাজ। বন্ধুমহলে অনেক বারই এমন আলোচনা হত যে, যিনি সিল্ক স্মিতার দেহরঞ্জনের শিল্পকর্মটি সম্পাদন করেন, তিনি তো অর্থের বিনিময়েই সেই শ্রম দান করে থাকেন! তা হলে সেই চাকরিটি কেন পাওয়া যাবে না? সদ্য গোঁফ-ওঠা কিশোরের দল ধর্ম নয়, অর্থ নয়, এমনকি মোক্ষ পর্যন্ত তাচ্ছিল্য করে শুধুমাত্র ‘কাম’-এর কাছে নতজানু হত। বা বলা ভাল, ধর্ম-অর্থ-মোক্ষ ইত্যাদির আগেই সে টের পেত চতুর্বর্গের অন্যতম চালিকাশক্তিকে। এর জন্য বাৎসায়ন ঘাঁটার দরকার পড়ত না।সিল্ক স্মিতা এবং তাঁর প্রাথমিক পর্বের পরিচালক আইভি শশীই সেই কাজটি করে দিতেন।

কী প্রদর্শিত হত সেই সব ছবিতে? কতখানি উন্মুক্ত হতেন সিল্ক স্মিতা? এ সব প্রশ্ন অবান্তর। মালয়ালম ভাষার সেই সব ছবিতে সাবটাইটেল থাকত না, ১৯৯০-এর দশকের আগে সেগুলির হিন্দি ডাবিংও হত না। ফলত অচেনা ভাষায়, অচেনা পরিমণ্ডলের সেই সব ছবিতে কখন ঘটবে সেই সব ছমছমে দৃশ্যের অবতারণা, সেই অপেক্ষার শ্বাসরুদ্ধ প্রহরগুলিই ছিল আসল বিষয়। বেশির ভাগ ছবিতেই নায়িকা তাঁর টসটসে ঠোঁট কামড়ে ধরে বেজায় গুঁফো কোনও জগদ্দল মার্কা নায়কের বাহুবন্ধনে পিষ্ট হতে হতে ‘উঃ’, ‘আঃ’ আর ‘উউম’-জাতীয় শব্দ করতে করতে বড় জোর খোলা পিঠটুকু দেখাতেন।তার পরেই পর্দায় নেমে আসত অন্ধকার।

মাত্র ৩৫ বছর ধরাধামে ছিলেন সিল্ক স্মিতা। পুর্ণ যৌবনেই তিনি বিদায় নেন নুন শো-র আলোছায়া থেকে।

বুদ্ধদেব বসুর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বলা যায়, সেই আঁধার ছিল আলোর অধিক। সেই অন্ধকারই কিশোরের কল্পনাবিলাসকে নিয়ে যেত সপ্তডিঙা-মধুকরে চাপিয়ে মনপবনের দাঁড়ে ভর করে। ‘ফ্যান্টাসি’ শব্দটি তখন সেই সব অর্বাচীনের কাছে অপরিচিতই ছিল। কিন্তু পরে বুজুর্গ হয়ে তারা স্মৃতিরেখা ধরে পিছিয়ে গিয়ে সিল্ক স্মিতা নাম্নী ছায়াটির সঙ্গে মিলিয়ে বুঝেছে, কাকে বলে ‘ফ্যান্টাসি’। প্রেক্ষাগৃহের পর্দায় নেমে আসা অন্ধকার প্রলম্বিত হয়েছে যে সব রঙের আলোয়, তাদের কোনও দিনই ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। গোল একটি বৃত্তের মাঝে ইংরেজি বর্ণমালার প্রথম অক্ষরটি ঝলসে উঠত সেই সব বর্ণ। বুকের ভিতর দারুণ দামামা বেজে উঠত। কিশোর নিজের অজান্তেই ‘পুরুষ’ হয়ে উঠত।

মাত্র ৩৫ বছর ধরাধামে ছিলেন সিল্ক স্মিতা। পুর্ণ যৌবনেই তিনি বিদায় নেন নুন শো-র আলোছায়া থেকে। তাঁর আত্মহত্যা কি খুব বেশি শোরগোল ফেলেছিল সেই সময়ের মিডিয়া জগতে? ১৯৯৬ সালে সিল্ক স্মিতা যখন মারা যান, তখন ‘বিশ্বায়ন’ নামের খেলাটির প্রারম্ভিক পর্ব। বাজার ছাইছে নম্রনীল থেকে গাঢ় নীল ভিডিয়ো ক্যাসেটে। সিনেমা হলগুলির নুন শো মাছি তাড়াতে আরম্ভ করেছে। বন্ধুর বাড়ি ফাঁকা হলেই বা হস্টেলে মওকা পেলেই ‘বাস্‌কো’ এনে ‘ফিলিম ফেস্টিভ্যাল’। সেই নীলদর্পণের শরৎশশী অবশ্যই সিল্ক স্মিতা ছিলেন না। ভিনদেশি অবয়বের উন্মোচন তত দিনে প্রবেশ করেছে ভিন্নতর নন্দনে। সিল্ক স্মিতা বা তাঁর পরিচালক আইভি শশীর সেখানে স্থান নেই।

১৯৮০ এবং ’৯০ দশকের প্রথমার্ধের সেই সব কিশোরের কাছে সিল্ক স্মিতার প্রয়াণ ছিল বিপুল বেদনার। কিন্তু সেই সব কৈশোর আজ যখন প্রৌঢ়ত্ব পেরচ্ছে, তখন সেই প্রয়াণ যেন প্রতীকী হয়ে দেখা দেয়। মনে হতে থাকে, ভিডিও ক্যাসেটের উত্থানের কালে নীলছবির খোলা দরবারে সিল্ক স্মিতা নামক ‘ধারণা’টিই যেন বেমানান। সিল্ক স্মিতা যে কালের পুত্তলিকা, সেই কালের নন্দনে উন্মুক্ত নগ্নতার কোনও স্থান ছিল না। ছিল ইঙ্গিতের আর ইশারার। পর্দা থেকে সেই ইশারা আর ইঙ্গিত পাড়ি দিত অনন্ত কল্পনার গর্ভে। এর পরেই ঘটবে বিশ্বায়ন। আর দুই দশক পরেই মানুষের মুঠোবন্দি হয়ে যাবে যাবতীয় ‘মোহ’। তাই কি সরে যেতে হল সিল্ক স্মিতার মতো মোহময়ীকে? যৌবনেই স্থির হয়ে থাকলেন মূর্তিমতী মোহ।

আস্তে আস্তে ঝাঁপ বন্ধ হল ‘বিধুশ্রী’-র, ‘আনন্দম’-এর। দুপুর সাড়ে ১১টায় কিন্তু আটকে রইল বেশ কিছু বাঙালি পুরুষের ঘড়ির কাঁটা। নিরালা সময়ে জানান দেয় সেই থেমে থাকা সময়। খোলা পিঠ বেয়ে ক্যামেরা আর তার পরের অন্ধকার ঘনিয়ে তোলে স্মৃতিকাতরতা নামক এক অ-সুখকে। সেই কাতরতার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছেন সেই নারী, যিনি সমাসবদ্ধ কিনা আজও জানা হয়নি। আসলে জানা হয়নি, তাঁকে কোনও বিশেষ ব্যাকরণেই বেঁধে ফেলা যায় কিনা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement