নয়ের দশকের হাতেগোনা যে ক’জন নায়িকাকে হট অ্যান্ড হ্যাপেনিং বলা হত, শিল্পা শিরোদকর ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তবে কেরিয়ারে সাফল্য এলেও কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন তিনি। তাঁর ফিল্মে বৃষ্টিভেজা গানের দৃশ্য থাকবে না, এক সময় এটা যেন কল্পনাই করতে পারতেন না শিল্পার ফ্যানেরা। কেন হারিয়ে গেলেন শিল্পা? কেরিয়ারের শুরুতেই পরিচালকের সঙ্গে অশান্তি, নাকি বলিউডে মাটি কামড়ে পড়ে না থাকার অনীহা?
অভিনয় যেন শিল্পা শিরোদকরের রক্তে বইছে। ঠাকুরমা মীনাক্ষী শিরোদকর নিজে ছিলেন তাঁর সময়কার বিখ্যাত মরাঠি অভিনেত্রী। ১৯৩৮-এ মুক্তি পাওয়া মীনাক্ষীর ফিল্ম ‘ব্রহ্মচারী’ সে সময় তুমুল সাড়া ফেলেছিল। তথাকথিত রক্ষণশীল সমাজের চোখরাঙানিকে অগ্রাহ্য করে তিনি সে ফিল্মে সুইম স্যুটে ধরা দিয়েছিলেন বড়পর্দায়। শিল্পার মা-ও চেয়েছিলেন, মীনাক্ষীর মতো অভিনয় করুক তাঁর মেয়ে।
কলেজের পড়াশোনা শেষ করতে না করতেই বলিউডে ঢোকার চেষ্টায় অ্যাক্টিং এবং ডান্সিং ক্লাশ শুরু করে দেন শিল্পা শিরোদকর। সে সময় রোশন তানেজার অ্যাক্টিং ক্লাশে ভর্তি হয় তিনি।
রোশন তানেজার অ্যাক্টিং ক্লাশে বলিউডের বহু মানুষের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছিল শিল্পার। সেখানেই তাঁর দেখা হয়েছিল প্রযোজক-পরিচালক শাওন কুমার টাকের সঙ্গে। এবং সেই সাক্ষাৎই যেন শিল্পার কেরিয়ারে অনুঘটকের কাজ করেছিল।
গত শতকের আটের দশকের হিট ছবির পরিচালক শাওন কুমার টাক সে সময় ‘সওতন কি বেটি’ ফিল্মের জন্য নতুন মুখ খুঁজছিলেন। শিল্পাকে দেখামাত্রই তাঁকে সে ছবির জন্য বেছে নেন তিনি। তবে সঙ্গে শর্তও দেন একটি। চার বছরের জন্য শাওন কুমার ছাড়া অন্য কোনও পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন না শিল্পা।
শর্ত কঠিন হলেও কেরিয়ারে প্রথম ব্রেক পাওয়ার আশাতেই বোধহয় তাতে শাওন কুমার টাকের ফিল্মে অভিনয়ে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন শিল্পা শিরোদকর। তবে ওই ফিল্মের অভিনয়ের কথাবার্তা হলেও চুক্তি স্বাক্ষরের তিন বছর বসে কাটাতে হয়েছিল শিল্পাকে। তিন বছরেরও সে ফিল্মের কাজ শুরু হয়নি।
চূড়ান্ত হতাশ হয়েই শিল্পা এর পর রিকু রাকেশকে নিজের ম্যানেজার হিসাবে নিয়োগ করেন। তত দিনে শিল্পা শিরোদকরের উপর ‘আনলাকি’ তকমাও বসে গিয়েছিল। ফিল্ম স্বাক্ষর করলেও তার কাজ শুরু হয়নি তিন বছর, সে নায়িকা ‘আনলাকি’ নয়? খানিকটা এমন মনোভাবই যেন দেখা দিয়েছিল সে সময়কার বলিউডে।
শিল্পা শিরোদকরের নতুন ম্যানেজার রিকু রাকেশের সঙ্গে দেখা হওয়াটাও তাঁর জীবনের একটা মোড় ঘোরানো দিক। সে সময় মাধুরী দীক্ষিতের ম্যানেজার ছিলেন রিকু। তিনিই শিল্পাকে প্রথম ফিল্মের খবরটা এনে দেন। ছোট্ট রোল হলেও তাতে রাজি হয়ে যান শিল্পা। শাওন কুমার টাকের সঙ্গে শর্তভঙ্গ করেই বলিউডের জীবন শুরু করেন শিল্পা।
১৯৮৯-এ বলিউডে অভিষেক হয় শিল্পা শিরোদকরের। প্রথম ফিল্ম রমেশ সিপ্পির ফিল্ম ‘ভ্রষ্টাচার’। রেখা এবং মিঠুন চক্রবর্তীর লিড রোল এবং এক দৃষ্টিহীনের চরিত্রে শিল্পা। রোল ছোট হলেও তাতে রাজি হয়ে যান তিনি। সেখান থেকেই মিঠুনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের শুরু। এর পর তাঁর কেরিয়ারে মিঠুনের সঙ্গেই বেশির ভাগ ফিল্ম করেছিলেন শিল্পা।
কেরিয়ারের প্রথম ফিল্ম বক্স অফিসে তেমন চলেনি। তা সত্ত্বেও এর পর থেকে শিল্পা যে সব ফিল্মে মুখ দেখিয়েছেন, তাতে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল, বলিউডের পরবর্তী হট নায়িকা তিনিই!
’৮৯-এ শিল্পার পরের ফিল্ম ছিল রাকেশ রোশনের পরিচালনায় ‘কিষান কানহাইয়া’। অনিল কপূর, মাধুরী দীক্ষিতের পাশে লিড রোলে রীতিমতো নজর কেড়েছিলেন শিল্পা শিরোদকর। ওই ফিল্মের একটি গান ‘রাধা বিনা’ তো সে সময় তুমুল হিট। অনিল কপূরের সঙ্গে ভেজা শাড়িতে শিল্পার সে গানের দৃশ্যও দেখে অনেক দর্শকও বলাবলি শুরু করেছিলেন, বলিউডের পরবর্তী বোল্ড বিউটি শিল্পাই!
‘কিষান কানহাইয়া’-র পর থেকে শিল্পা শিরোদকরের কাছে একের পর এক বোল্ড সিনের দৃশ্যে অভিনয়ের অফার আসতে শুরু করে। আর প্রায় প্রতিটি ফিল্মে একটি করে বৃষ্টিভেজা গানের দৃশ্য থাকাটা যেন রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে শিল্পা শিরোদকরের তখন একটা বোল্ড ইমেজ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সে সময়ই তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও চর্চা শুরু হয় গসিপ ম্যাগাজিনগুলোতে। ম্যানেজার রিকু রাকেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে শুরু হয়েছিল জোর জল্পনা।
বিবাহিত রিকু রাকেশের সঙ্গে বহু জায়গায় দেখা যেতে থাকে শিল্পা শিরোদকরকে। তা নিয়ে এক সময় কম জলঘোলা হয়নি। একটা সময় রিকুর স্ত্রী দেখা করেন শিল্পার সঙ্গে। তবে রিকুর সঙ্গে তথাকথিত সম্পর্ক অস্বীকার করেন শিল্পা।
ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এই জল্পনার মাঝেই শিল্পার জীবনে আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়। কেরিয়ারের শুরুতে শাওন কুমার টাকের যে চুক্তি ভেঙে ফিল্মে অভিনয় করেছিলেন শিল্পা, তার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে আইনি পথে যাওয়ার হুমকি দেন প্রযোজক-পরিচালক। সেই সঙ্গে শাওন এ-ও বলেন, শিল্পার সমস্ত গোপন কথা মিডিয়াতে ফাঁস করে দেবেন।
কী গোপন কথা? আসলে রিকু রাকেশের সঙ্গে শিল্পার সম্পর্কের দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন শাওন কুমার টাক। তবে রিকুই সে সময় শিল্পাকে বোঝান, শাওন কুমারের সঙ্গে ফিল্মে অভিনয় করতে রাজি হতে যেতে। যদিও শেষমেশ শিল্পা রাজি হলেও শাওন কুমার তাঁকে নিজের ফিল্মে কাজ করাননি। সেখানেই সে অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।
এর পর একের পর এক হিট ফিল্মে দেখা গিয়েছিল শিল্পা শিরোদকরকে। তবে ‘পাপ কি কামাই’, ‘যোদ্ধা’, ‘হম’, ‘গোপী কিষান’-এর মতো হিট ফিল্মে দেখা গেলেও কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন শিল্পা। এক সময় রিকুকে বাদ দিয়ে মুকুল আগরওয়ালকে ম্যানেজার হিসাবে নিয়োগ করলেও তাঁর সঙ্গেও শিল্পার সম্পর্ক নিয়ে বলিউডে জল্পনা শুরু হয়। সে সময় রিকুই সে জল্পনার অবসান করেন। যদিও শিল্পার থেকে তত দিনে দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করে দিয়েছিলেন রিকু।
নিজের বোল্ড ইমেজ ছেড়ে এক সময় প্রকাশ ঝা-র ‘মৃত্যুদণ্ড’ বা এম এফ হুসেনের ‘গজগামিনী’-র মতো ফিল্মও করেছিলেন শিল্পা। তবে সে সব ফিল্মে তেমন সাফল্যের মুখ দেখেননি তিনি। এর পর ২০০০ সালে হঠাৎই ইন্ডাস্ট্রি থেকে যেন গায়েব হয়ে যান শিল্পা। সে বছরই ব্যাঙ্কার অপরেশ রঞ্জিৎকে বিয়ে করেন তিনি। এর তাঁর সঙ্গে নিউজিল্যান্ডে বসবাস শুরু। একটি মেয়েও রয়েছে তাঁদের। এর পরেও অভিনয়ে দেখা গিয়েছিল শিল্পাকে। প্রায় ১৩ বছর পর। ‘এক মুট্ঠি আসমান’, বা ‘সিলসিলা প্যায়ার কা’-র মতো টেলি-সিরিয়ালে। মরাঠি ফিল্মেও প্রযোজনা করেছিলেন তিনি। তবে কোনও জায়গাতেই যেন বেশি দিন টিকে থাকেননি শিল্পা।
এক সময়কার বোল্ড নায়িকা শিল্পা বলিউডে ফের পা রাখার চেষ্টা করলেও তাতে সফল হননি। বেশ কিছু হিট ফিল্মের নায়িকা শিল্পাকে অনেকে এক সময়কার মিস ইন্ডিয়া নম্রতা শিরোদকরেও দিদি হিসাবেও পরিচয় দেন। বলিউডে নিজের বোল্ড ইমেজ তৈরি করলেও তা বেশি দিন ধরে রাখতে পারেননি। কেরিয়ারের বাইরের ঝামেলা, ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপড়েনেই যেন বলিউড থেকে হারিয়ে গেলেন শিল্পা শিরোদকর।