বড় তারকার সন্তান হয়েও বলিউড থেকে হারিয়ে যেতে হয়, এমন নজির কম নয়। সেই তালিকায় অন্যতম শাদাব খান। তাঁর কেরিয়ার শুরু হয়েছিল রানি মুখোপাধ্যায়ের নায়ক হয়ে। আজ ইন্ডাস্ট্রি থেকে বিস্মৃত আমজাদ খানের ছেলে, শাদাব।
শাদাবের জন্ম ১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। তিনি আমজাদ এবং শেহলা খানের বড় ছেলে। তাঁর জন্মদিন আরও একটি কারণে আমজাদের কাছে স্মরণীয়। সে দিনই তিনি ‘শোলে’ ছবিতে সই করেছিলেন। শাদাবের ভাইয়ের নাম সীমাব এবং বোনের নাম অহলাম।
মুম্বইয়ের মানেকজি কুপার স্কুলে পড়াশোনা শাদাবের। এই স্কুলে ফিল্মদুনিয়ার অনেক তারকার সন্তানই পড়তেন। টুইঙ্কল খন্না, রিঙ্কি খন্না, তেজস্বিনী কোলাপুরে, জোয়া আখতার, ফরহান আখতার, সাজিদ খান এবং মেঘনা গুলজার— সকলে ছিলেন শাদাবের স্কুলের বন্ধু।
ফিল্মি পরিবেশে বড় হওয়া শাদাবের ছোট থেকেই ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে অভিনেতা হওয়ার। ১৮ বছর বয়সে শাদাব চেষ্টা করছিলেন বলিউডে পা রাখার। ঠিক সে সময়েই হৃদরোগে আচমকা তাঁর বাবা আমজাদ খানের মৃত্যু, সবকিছু ওলটপালট করে দেয়।
‘হিমালয় পুত্র’ ছবিতে শাদাবের অভিনয় করার কথা ছিল। কিন্তু পরে এই ছবিতে সুযোগ পান অক্ষয় খন্না। তিনি এই ছবিতে আত্মপ্রকাশ করেন বলিউডে। শাদাবের প্রথম ছবি ‘রাজা কি আয়েগি বরাত’ মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে। বিপরীতে নায়িকা ছিলেন রানি মুখোপাধ্যায়। রানিরও প্রথম সিনেমা ছিল এটা।
এর পর রানির কেরিয়ারগ্রাফ ক্রমশ উপর দিকে উঠতে থাকে, শাদাব ক্রমশই পিছিয়ে পড়তে থাকেন। ‘রিফিউজি’ এবং ‘হে রাম’ ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে তিনি অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু ৩ বছরের মধ্যে টিনসেল টাউন থেকে কার্যত হারিয়েই যান। শাদাব হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, অভিনয় তাঁর জন্য নয়।
ছোট থেকেই তাঁর লেখালেখির শখ ছিল। এ বার তিনি চিত্রনাট্য লেখার কাজে হাত দিলেন। ‘লকীড়’ এবং ‘সন্ধ্যা’ ছবির চিত্রনাট্য তিনি লিখেছিলেন। শাদাবের কথায়, তিনি লেখালেখির শখ পেয়েছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। প্রসঙ্গত হিন্দি সিনেমায় আসার আগে আমজাদও নাটক লিখতেন। ইচ্ছে ছিল সাংবাদিক হওয়ার। কিন্তু ঘটনাচক্রে তাঁর জীবনের মোড় পাল্টে যায়।
শাদাব কিন্তু চিত্রনাট্য লেখার কাজেও ব্যর্থ হলেন। এর পর তিনি ছবির জগৎ থেকে দূরে থ্রিলার লিখতে শুরু করলেন। ২০০৫ সালে বিয়ে করলেন রুমানাকে। তত দিনে বলিউড থেকে অনেক দূরে। অভিনয় তো দূর অস্ত্। কোনও অনু্ষ্ঠানেও তাঁকে দেখা যেত না। মাঝে কখনও কখনও তাঁর ছবি প্রকাশ্যে এলেও সকলে চমকে যেতেন তাঁর ভারী চেহারা দেখে।
তবে শাদাবের কথায়, অভিনয়ের শখ বা ইচ্ছে তাঁকে ছেড়ে যায়নি। নায়কের চরিত্রে না হলেও ‘বদলাপুর’ এবং রানি মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘মর্দানি’-তে তিনি অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু উপন্যাস লিখতে ব্যস্ত ছিলেন বলে সেই সুযোগ নিতে পারেননি।
চিত্রনাট্যের পাশাপাশি থ্রিলারও লিখেছেন শাদাব। ২০১৫ সালে মুক্তি পায় তাঁর লেখা থ্রিলার, ‘মার্ডার ইন বলিউড’। গব্বর সিংহের ছেলের লেখা এই থ্রিলার প্রকাশ করেন স্বয়ং জয়, অর্থাৎ অমিতাভ বচ্চন। আমজাদের মৃত্যুর পরেও তাঁর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে অমিতাভের। তাঁকে পিতৃপ্রতিম বলে মনে করেন শাদাব।
আমজাদ খান অভিনয় করেছেন শতাধিক ছবিতে। কিন্তু তাঁর ছেলে শাদাবের ছবি গুনতে বসলে হাতের দু’ আঙুলের করও পার হয় না। কেরিয়ার নিয়ে আক্ষেপ তো আছেই। তার থেকেও শাদাবের বেশি দুঃখ এই ভেবে যে বলিউডে আমজাদের মূল্যায়ন ঠিকমতো হয়নি। জন্মদিন বা মৃত্যুবার্ষিকীতে ইন্ডাস্ট্রির কেউ মনেও রাখেন না অভিনেতাকে, দুঃখ তাঁর ছেলের।
বর্তমানে বিভিন্ন কারণে ইন্ডাস্ট্রি থেকে নিজেকে দূরে রাখেন আমজাদপুত্র। সপরিবার থাকেন মুম্বইয়ের এমন জায়গায়, যার নামকরণ হয়েছে তাঁর বাবার নামেই। বান্দ্রার সেই আমজাদ চকে শাদাব এবং তাঁর স্ত্রী রুমানার সঙ্গে থাকেন প্রয়াত আমজাদের স্ত্রী শেহলাও। শাদাবের ভাই সীমাব একজন ক্রিকেটার। পাশাপাশি, তিনি নাটকও প্রযোজনা করেন। তাঁদের বোন অহলামও যুক্ত নাটকের সঙ্গে। অহলম বিয়ে করেছেন অভিনেতা জাফর করাচিওয়ালাকে।
শাদাব অভিনীত বাকি ছবিগুলি হল ‘বেতাবি’, ‘রোমিয়ো আকবর ওয়াল্টার’, ‘ভারত ভাগ্য বিধাতা’ এবং ‘মিনি ব্যানার্জি ঘর মেঁ হ্যায়’। সম্প্রতি অভিনয় করেছেন ওয়েব সিরিজেও। হনসল মেহতার ‘স্ক্যাম ১৯৯২: দ্য হর্ষদ মেহতা স্টোরি’-তে তিনি অভিনয় করেছেন অজয় কেডিয়া চরিত্রে।
ইন্ডাস্ট্রিতে বার বার ফিরে আসার চেষ্টা করেছেন শাদাব। অভিনেতা হিসেবে ব্যর্থ হলেও তিনি চেষ্টা করেছেন লেখক এবং পরিচালক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। ২০০৭ সালে ‘হাইওয়ে ২০৩’ এবং ২০১৯-এ ‘মিনি ব্যানার্জি ঘর মেঁ হ্যায়’ পরিচালনা করেন তিনি। কিন্তু দু’বারই সাফল্য অধরা থেকে যায় তাঁর কাছে। ছবি দু’টির কাহিনিকারও ছিলেন তিনি।
ছোটবেলার স্মৃতি প্রসঙ্গে শাদাব জানিয়েছেন, তাঁর বাবার সঙ্গে শনি-রবিবার করে শ্যুটিং দেখতে যেতেন তিনি। তারকাদের গ্ল্যামারের বাইরে তাঁদের তিন ভাইবোনকেই আমজাদ খান বড় করেছিলেন সাধারণ ভাবে। সময় পেলেই সন্তানদের হোমওয়ার্কে সাহায্য করা থেকে স্কুলে পেরেন্টস টিচার্স মিটিং— সব কিছুতেই থাকতেন পর্দার গব্বর সিংহ।
স্কুলের বন্ধুরা খুব ভয় পেত শাদাবের বাবাকে। এখনও সে কথা মনে পড়ে শাদাবের। কিন্তু একবার আলাপ হওয়ার পরই আমজাদের ভক্ত হয়ে যেতেন শাদাবের বন্ধুরা। কারণ আমজাদ ছোটদের সঙ্গে খুব অন্তরঙ্গ হয়ে মিশতে পারতেন। ছোটবেলায় রাতে শাদাব ঘুমোতে বায়না করলে ছেলের কানে কানে আদ্যন্ত সুরসিক আমজাদ বলতেন, ‘‘ঘুমিয়ে পড়ো। নয়তো এখনই গব্বর চলে আসবে!’’