সন্ত্রাসের আবহে থিয়েটারকেই আঁকড়ে ধরল ঢাকা

হরতাল-অবরোধের জোড়া ফলা বাংলাদেশকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছিল। পেট্রোল বোমার আতঙ্কে সিঁটিয়ে রয়েছে শহর থেকে গ্রাম। একুশের বইমেলার মাঠের সামনে প্রকাশ্যে নৃশংস ভাবে খুন হয়েছেন মুক্তচিন্তার প্রচারক অভিজিৎ রায়। ধর্মান্ধতা-বিরোধী সুর চড়িয়ে অভিজিৎ-হত্যার এক মাসের মাথায় ঢাকার রাজপথে খুন করা হয় ওয়াশিকুর রহমানকে। কাজেই আবার ‘ঢেউ উঠছে’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। শাহবাগ চত্বরে ‘কারা টুটছে’। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটকে পাশে রেখে একুশের স্মারকের সামনে মঞ্চস্থ হচ্ছে মান্নান হিরার লেখা ‘আগুনের জবানবন্দি’।

Advertisement

অংশুমান ভৌমিক

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৫ ০১:৩০
Share:

২য় ঢাকা আন্তর্জাতিক নাট্যোত্সব

হরতাল-অবরোধের জোড়া ফলা বাংলাদেশকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছিল। পেট্রোল বোমার আতঙ্কে সিঁটিয়ে রয়েছে শহর থেকে গ্রাম। একুশের বইমেলার মাঠের সামনে প্রকাশ্যে নৃশংস ভাবে খুন হয়েছেন মুক্তচিন্তার প্রচারক অভিজিৎ রায়। ধর্মান্ধতা-বিরোধী সুর চড়িয়ে অভিজিৎ-হত্যার এক মাসের মাথায় ঢাকার রাজপথে খুন করা হয় ওয়াশিকুর রহমানকে। কাজেই আবার ‘ঢেউ উঠছে’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। শাহবাগ চত্বরে ‘কারা টুটছে’। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটকে পাশে রেখে একুশের স্মারকের সামনে মঞ্চস্থ হচ্ছে মান্নান হিরার লেখা ‘আগুনের জবানবন্দি’।

Advertisement

এরই মধ্যে ‘২য় ঢাকা আন্তর্জাতিক নাট্যোত্সব’-এর আসর বসল ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (আইটিআই)-এর বাংলাদেশ কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমির উদ্যোগে। সহযোগিতায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। শম্ভু মিত্রকে উত্সর্গ করা এই উত্সবের মূল থিম ছিল ‘থিয়েটার এগেইনস্ট ভায়োলেন্স’।

আইটিআই-এর বাংলাদেশ কেন্দ্রটি বেশ করিৎকর্মা। বিদেশের বহু নাট্যদলকে ঢাকায় এনে দেশের নাট্যজনদের সামনে হাজির করায় এদের জুড়ি নেই। গত দু’বছরে বাংলাদেশে মঞ্চস্থ হওয়া সেরা নাটকগুলি তো ছিলই, নাট্যদল এসেছে চিন, ইংল্যান্ড এবং ভারত থেকে। ১০ দিনের উৎসব। ১২ মার্চ সন্ধেয় পুরনো পল্টন এলাকার সেগুনবাগিচা মহল্লায় উৎসবের উদ্বোধন করেন দেশের অর্থমন্ত্রী।

Advertisement

বাংলাদেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর নিজেই এক জন নাট্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর ‘দেওয়ান গাজীর কিস্‌সা’ দেখে কলকাতা তাঁকে চিনেছে। শিল্পকলা অ্যাকাডেমির প্রধান লিয়াকত আলি লাকিও নাটকের লোক। একতলার মূল অডিটোরিয়াম, দোতলার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার, সাততলায় বা চিলেকোঠার স্টুডিও থিয়েটারে হইহই করে শুরু হল আসর। সন্ধে নামতেই অভিনয় শুরু। এ দেশে নাটকের দৈর্ঘ্য কমতে কমতে সওয়া এক থেকে দেড় ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। সাতটায় শুরু হয়ে সাড়ে আটটার মধ্যেই সব প্রেক্ষাগৃহে অভিনয় সারা।

জাতীয় নাট্যশালার লবিতে চার হাজার বছরের বিশ্বনাট্যের রথী-মহারথীদের পোর্ট্রেট এগ্‌জিবিশন চলছিল। সেখানেই রাত পৌনে ন’টায় ‘মিট দ্য ডিরেক্টর’। থিয়েটারওয়ালা, সাংবাদিক থেকে শুরু করে আম আদমি— সবার অবারিত দ্বার। সঞ্চালনায় ছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটক নিয়ে গবেষণা করা আইরিন পারভিন লোপা। লোপার নিজের নাটকও ছিল উৎসবে— নাট্যম রেপার্টরির ‘সাইকেলওয়ালা’, পদাতিকের ‘পোড়ামাটি’। এর মধ্যে বিজয় তেন্ডুলকরের ‘সাইকেলওয়ালা’-র কোনও প্রযোজনা ভারতে সম্ভবত হয়নি।


সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার-এর নাটক ‘ম্যাকাব্রে’

পরিস্থিতি প্রতিকূল বলে কুষ্টিয়া বাদে ঢাকার বাইরের কোনও দল এ বার যোগ দিতে পারেনি। চট্টগ্রাম তো বটেই রাজশাহি, বগুলার দলও আসতে পারেনি। তবে, ঢাকার বড়-মেজ-সেজ-ছোট সব ধরনের দলই ছিল। এদের মধ্যে ছিল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় (নাম-গোত্রহীন মান্টোর মেয়েরা), থিয়েটার (কুহকজাল), আরণ্যক (ভঙ্গবঙ্গ), ঢাকা থিয়েটার (গল্প নিয়ে গল্প এবং ঊষা উৎসব) যেমন ছিল, তেমনই ছিল পদাতিক নাট্য সংসদ (ম্যাকবেথ), সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (ম্যাকাব্রে), নাট্যকেন্দ্র (দুই যে ছিল এক চাকর), থিয়েটার আর্ট ইউনিট (না-মানুষি জমিন), দ্যাশবাংলা থিয়েটার (সারস ডানার পাখি), প্রাচ্যনাট (ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি), মহাকাল নাট্য সম্প্রদায় (প্রমিথিউস), স্বপ্নদল (স্পার্টাকাস), আরশীনগর (সে রাতে পূর্ণিমা ছিল), বটতলা (দ্য ট্রায়াল অফ মাল্লাম ইলিয়া), থিয়েট্রেক্স (দক্ষিণা সুন্দরী), আগন্তুক (অন্ধকারে মিথেন)-এর মতো দল। বর্ষীয়ান মামুনুর রশীদ, কামালউদ্দিন নীলু থেকে মহম্মদ আলী হায়দার, পান্থ শাহরিয়র, ত্রপা মজুমদার, জাহিদ রিপন, ইউসুফ হাসান অর্ক, সুদীপ চক্রবর্তীর মতো তরুণদের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হল সেগুলো। ঢাকা ও জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক পড়ানো হয়, শেখানো হয়। তাদেরও নতুন প্রযোজনা (‘কবি’ ও ‘উল্টোরথ’) মঞ্চস্থ হয়। ডাকসাইটে অধ্যাপক তথা নাট্যকার সৈয়দ জামিল আমেদকে দেখলাম ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে স্টুডিও থিয়েটারে ছুটছেন। ফেস্টিভ্যালের নাটক নিয়ে টার্ম পেপার লিখতে দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের। ১৫ নম্বর উশুল করতে আদাজল খেয়ে লেগেছে জামিলস্যরের ছেলেমেয়েরা।

গত চার দশকে নিজস্ব নাট্যভাষার অনুসন্ধানে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশ। গড়ে তুলেছে লোকায়ত আঙ্গিক। বর্ণনাত্মক নাট্যভাষার পাঠ নিয়েছে নবীন প্রজন্ম। এখনও একাত্তরের প্রেরণায় তৈরি হচ্ছে নাটক। রোমান ইতিহাসের চরিত্র উঠে আসছে সর্বহারার প্রবক্তা হয়ে। ‘ম্যাকাব্রে’-র প্রযুক্তিনির্ভর উপস্থাপনেও স্বদেশ ও সমকাল বর্তমান। আবার জাদু বাস্তবতার হাত পাকাচ্ছে পরীক্ষামূলক নাট্যের প্রণেতারা। ‘অন্ধকারে মিথেন’ অয়দিপাউস মিথের আশ্চর্য পুনর্নির্মাণ করল। সাব-অল্টার্ন স্টাডিজের খেই ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক মানুষের অবস্থান দেখাল ‘চিয়ারী’। বটতলার ‘দ্য ট্রায়াল অফ মাল্লাল ইলিয়া’ সমকালীন আফ্রিকার কথা বলল, ৭১-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস রইল সেখানে।

এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারের নাটমঞ্চটি সরেস। সেটিকে ইচ্ছেমতো গড়েপিটে নিতে পারেন নির্দেশকরা। দেখলাম সুযোগের ষোলো আনা উশুল করছেন তারা। দশ দিনে ছয়-সাত রকম মঞ্চ বিন্যাস দেখলাম।


আগন্তুক-এর নাটক অন্ধকারে মিথেন

চিন থেকে দু’টি দল এসেছিল চাইনিজ অপেরা নিয়ে। ইংল্যান্ডের থিয়েটার ফোকস আদতে অক্সফোর্ডে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের সংস্থা। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের রেপ ভিকটিম আর ওয়র চিলড্রেনদের নিয়ে যে ঐতিহাসিক চর্চা শুরু হয়েছে, তাতে নতুন বিতর্ক উসকে দিয়েছে ‘যমুনা’। উৎসবে ভারতের পরোক্ষ প্রতিনিধি ছিলেন ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়। নাগরিকের ‘নাম-গোত্রহীন মান্টোর মেয়েরা’ গেল বছর জুনে ঊষার নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয়েছিল। ন্যাশনাল থিয়েটার উপচে সবাই দেখলেন সেই নাটক। ইন্দিরা গাঁধী কালচারাল সেন্টার সুকল্যাণ ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় ‘বাঁদী-বান্দার রূপকথা’ মঞ্চায়ন করে। মণিপুর থেকে এসেছিলেন হেইসনাম কানহাইলাল তাঁর ‘দ্রৌপদী’ নিয়ে। এ নাটকের দু’টি শো হয়। দুপুরের শোয়ের পর সাবিত্রী হেইসনামকে ফুল তুলে দিতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হলেন ফিরদৌসি মজুমদার। সন্ধের শো-তেও উপচে পড়া ভিড়। বাড়তি চেয়ারেও কুলোল না যখন, তখন মেঝেতেই বসে পড়লেন অনেকে।

কেবল অভিনয় নয়, সফরকারী চিনা শিল্পীদের নিয়ে ওয়ার্কশপও করিয়েছেন উদ্যোক্তারা। রোজ বিকেলে তকতকে কাগজে ঝকঝকে ছাপা থিয়েটার বুলেটিন বেরিয়েছে। তাতে আইটিআই বাংলাদেশের প্রধান নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, সচিব দেবপ্রসাদ দেবনাথ, মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর থেকে শুরু করে হেইসনাম কানহাইলাল নিবন্ধ লিখেছেন। ২০ তারিখ সকাল থেকে সেমিনার রুমে নাট্য সংলাপ জমেছিল দারুণ।

ছবি: লেখক

ঢাকা আন্তর্জাতিক নাট্যোত্সব-এর আরও ছবি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement